ধ্যানবিদ্যা পরিপূর্ণ হয় এর সহায়ক যেসব দর্শন, তা গ্রহণের মাধ্যমে। এই কারণেই মহামতি বুদ্ধের কথাটা প্রযোজ্য-
প্রজ্ঞা ছাড়া ধ্যান নাই, ধ্যান ছাড়া প্রজ্ঞা নাই। যার প্রজ্ঞা ও ধ্যানের সম্মিলন ঘটেছে, তারই নির্বাণ স্তরে পদার্পণ ঘটেছে।
আহা, নির্বাণ। নির্বাণ নিয়ে কিছু বিষয় ছিল, আসবে আশা করি।
ধ্যান মূলত একই কারণে, আর তা হল মস্তিষ্কের সুব্যবস্থাপনা ফলশ্রুতিতে দেহের সুব্যবস্থাপনা ফলত: মনের ও জীবনের সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূলের দিকে ধাবিত হওয়া।
মস্তিষ্কের সুব্যবস্থাপনা, যাকে মজা করে আমরা বলতে পারি, ফাইল ম্যানেজমেন্ট প্লাস সফটওয়্যার ডিবাগিঙ- সেটার জন্য মস্তিষ্কের সফটওয়্যারের বাগগুলোকে ডিটেক্ট করে রিমুভ করাটা আবশ্যক।
ধরা যাক, আমি সিগারেটে অভ্যস্ত। মনের ভিতরে সামান্য খুঁতখুঁত, সিগারেট হলে ক্যান্সারের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। পৃথিবীতে মিলিয়ন ধরে মানুষ মরে সিগারেট জনিত কারণে। আর খুঁতখুঁত, নিকোটিন জমা, কাজের সময় সিগারেটের টানাটানি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু, এই শারীরিক ক্ষতিটার বিষয় আমরা একপাশে সরিয়ে রাখি।
ধ্যানজগতে সবচে বেশি সমস্যা যেটা তৈরি করবে, তা হল মানসিক বিষয়। একেই বলতে পারি চক্র।
আমার কাছে সিগারেট খুব স্বাভাবিক বিষয়। আমি ব্যস্ত মানুষ। দিনে পনের ঘন্টা খাটি। কিন্তু সিগারেটে আর কতটা সময় ব্যয় হয়? ছটা সিগারেটই তো খাই। ষাটটা মিনিটই হবে সব মিলিয়ে। বিষয় কিন্তু তা নয়।
ধরা যাক, সকাল আটটা, এগারোটা, দুটা, পাঁচটা, সন্ধ্যা্ ছটা আর ঘুমানোর আগে একবার। ব্যস। এ আর এমন কী।
আটটা থেকেই শুরু হোক।
আটটায় ব্রেন সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। নিকোটিন চাই। নিকোটিন। তারস্বর।
সিগারেট প্যাক হাতে নিলাম, হালকা একটা প্রশান্তি। প্যাক খোলার পর আরো একটু। শলাকাটা ঠোঁটে ঝুলানোর পরই কিন্তু পুরোপুরি শান্তি। অথচ, সিগারেট ধরাইনি, মুখের ভিতর জিভ দিয়ে ধোঁয়াটাকে নেড়েচেড়ে নাকে লম্বা দম নিয়ে ফুসফুসে পাঠিয়ে দিইনি। তাহলে শান্তি কেন? মন সুনিশ্চিত, এখনি আসবে নিকোটিন। আহ! নিকোটিনের যা যা প্রভাব, সব সে অবচেতন থেকে সচেতনে ট্রান্সফার করা শুরু করেছে। ফলে, ব্রেনের যে যে জায়গাতে সিগারেট আসার পর আরামের সিগন্যাল ট্রান্সফার হওয়া শুরু হবে, তা শুরু হয়ে গেছে এখনি। বেড়ে গেছে হার্টরেট একটুখানি। রক্ত পাম্প করতে হবে তো। নিকোটিনটাকে ব্রেনে পাঠাতে হবে।
তারপর ধরানো। ফুসফুসে চলে গেল নিকোটিন। স্বচ্ছ্ব ঝিল্লি, যার অনেকটাকে আমরা কফ নাম দিই, সেটা ভেদ করে ফুসফুসের অগণিত কোটি কোটি অ্যালভিওলাই’র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্যাক ভরে উঠল ধোঁয়ায়। এগিয়ে এল অযুত নিযুত কোটি রেডব্লাডসেল। প্রতি সেলে আরো বহুগুণ অক্সিজেন ধারণ করার কথা তার। ধারণ করল সে। সেইসাথে রক্তস্রোতে মিশে গেল নিকোটিন।
স্বভাবতই, আমি সারাদিন ঠিকমত দম নেই না। ফলে মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের একটা ঘাটতিতেই চলতে থাকে। এখন নিচ্ছি লম্বা লম্বা দম। অতুল অক্সিজেন তরতাজা করে তুলছে মস্তিষ্ককে। তার উপর আছে রক্তস্রোতে প্রবল নিকো। সুন্দরভাবে ঘুম থেকে জাগছে অনেক সেল। কারণ, অক্সিজেন। সেইসাথে সেসব সেল অবশ্যই রিল্যাক্সড হয়ে যাচ্ছে। কারণ, নিকো বাবারা নউরনের সেল থেকে সেল সেলান্তরে স্থানান্তরিত হচ্ছে সিগন্যাল আকারে। আর নিকোটিন যেহেতু বিষ, নেতিয়ে পড়ছে মস্তিষ্কের কোষগুলো।
এই বিষের মুখে নেতিয়ে পড়াতেই আরাম। এটাই আমার সার্থকতা।
এ পর্যন্ত ঠিক আছে। তারপর?
সিগারেটটা শেষ হল। আমার অবচেতন থেকে তথ্য নিয়ে সচেতন মন ব্রেনকে জানানো শুরু করল, তুই ভাল আছিস, বুঝলি, আচ্ছামত নিকোটিন এসেছে এবার। এখন আর তোর সিগারেট লাগবে না। দেখিস, তোর ব্রেন খেলবে এবার। প্ল্যান আসবে ভালমত। ক্রিয়েটিভিটি উপচে পড়বে।
তো, অবচেতন যদি সিগন্যাল দেয় যে, ক্রিয়েটিভিটি উপচে পড়বে, আর কি উপায় আছে ক্রিয়েটিভিটির না এসে? অবচেতন মন যা ধারণা দেয়, সচেতন মন কিছু না জেনে না বুঝে সেটাই করা শুরু করে দেয় ব্রেনের সহায়তায়। আর অবচেতন মন কেন একটা সিগন্যাল দেয়? সে বর্তমান বা ভবিষ্যত থেকে সিগন্যাল দেয় না। তার কাজ অতীত অভিজ্ঞতা ও অতীত বিশ্বাস বা সংস্কারের সাথে ট্যাগ হয়ে থাকা। এবং এই ট্যাগিঙে যে বাহ্যিক সিগন্যাল সে পাবে, সেটার উপর ভিত্তি করে বাকিটার স্রোত তৈরি করবে।
ধরা যাক, সচেতন মন জানাল, এবার নিকোটিন এসেছে। অবচেতন মন জানল, নিকোটিন এলে আমার কী কী হয়? আমার মেজাজ তরল হয়, অ্যাই মেজাজ, এবারো তরল হ। ম্যাজাজ তরল হবার সাথে কী সম্পর্কিত? শান্তি ও প্ল্যানিঙে এক্সপার্টিজ, সৃষ্টিশীলতা। তোমরা সবাই উঠে আস। এর আগে যতবার নিকোটিনের চালান এস্চে, ততবার তোমরা উঠে এসেছিলে।
এই চক্রবদ্ধ হয়েই আর্কিটেক্ট বলেন, একটু সিগ্রেট না হলে আমি ড্র করতে পারি না। কিছু মনে করবেন না আঙ্কেল। বা লেখক, বা কবি।
কিন্তু তারপর?
ব্রেন শুধু হিসাব করতে থাকবে। দশ মিনিট আগে নিকোর চালান এসেছিল। সব ঠিক আছে। আধঘন্টা আগে এসেছিল। এখন সিগারেটের প্রশ্নই ওঠে না। একঘন্টা আগে সিগারেট এসেছিল। বেশ ভাল লেগেছিল। দেড়ঘন্টা আগে এসেছিল। আহ, কী শান্তি। এখন একটু অশান্তি লাগছে।
ব্রেন। কী? অশান্তি? অশান্তির সময় রক্তের কাজ বাড়াতে হয়। সারা শরীরে প্রবাহিত করতে হয় বেশি বেশি। হার্টবিট বাড়া। হার্টবিট বাড়লে পাকস্থলীকে একটু বেশি প্রেশারে রাখতে হবে। আরো চিনি চাই। গ্লুকোজ ফ্রুক্টোজ। ওকে কাজ করাতে হলে চাই হরমোন। হরমোন ট্রিগার করতে চাই আরেক হরমোন। ওটা ট্রিগার করতে চাই আরো অশান্তি। আরো অশান্তি প্রডউস কর। অশান্তির সিগন্যাল পাঠাও হাইপোকে। হাইপোথ্যালামাস সাথে সাথে খোঁজ শুরু করল। আরো অশান্তি যেহেতু দরকার, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, দেখতো, পরিবেশে কোন অশান্তির কারণ আছে কিনা?
এইতো, কেল্লা ফতে। পরিবেশে আবার কোনদিন অশান্তির এলিমেন্ট না থেকে পারে? ওইতো, পিয়ন ব্যাটা এখনো পানি দিয়ে যায়নি। আর যদি দিয়ে গিয়ে থাকে, তো আধগ্লাস দিয়েছে। আর যদি আধগ্লাস না দিয়ে ফুলগ্লাস দিয়ে থাকে, তো ঢেকে রাখেনি। যদি ঢেকে রেখেছে তো পানি ঠান্ডা নাই আর ঠান্ডাও যদি হয়ে থাকে, শালার পানি টেবিলের ওই কোণায় কেন? উঠে গিয়েই যদি আনতে হয় তো তুমি পিয়ন নবাবজাদারে রাইখা লাভ হইল কী? লাথি দিয়ে বিদায় করতে হবে।
হাইপোবাবা এত শক্তিমান, তিনি সমস্যা খুজে বের করবেনই।
এ হল শেষবার সিগারেট খাবার দেড়ঘন্টার মাথায় ঘটনাক্রম।
তার আধঘন্টা ম্যাজাজ খারাপ খারাপ ভাব। পরের আধঘন্টা ভালই খারাপ। কাজে ঠিক মন বসছে না। পরের আঘধন্টা সারা মস্তিষ্কের যথাসম্ভব পরিমাণ কোষের চিৎকার। সে কী সম্মিলিত চিৎকার! নিকোটিন চাই, নিকোটিন। ব্রেনের অন্যান্য অংশগুলো সিগন্যাল গ্রহণ করল। ক্রাইসিস চলছে। ক্রাইসিসের সময় দেখার ক্ষমতা বাড়াতে হয়, চোখ হয়ে যাবে বড়বড়। চোখের পেশিগুলো হবে টানটান, লেন্স এ যাবে এক্সট্রা স্ট্রেস। এভাবে রোমকূপ থেকে রোমকূপ পর্যন্ত, মাথার তালু থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত প্রতিটা প্রত্যঙ্গে যুদ্ধপ্রস্তুতি। স্বাভাবিক দৈহিক কাজকর্ম লোপ।
অবশেষে, নিজের অজান্তেই মহাক্ষমতাধর, আমাকে চালানেওয়ালা অবচেতন মন সাহেবের হস্তক্ষেপ। আর ডান হাত নিজের অজান্তেই চলে গেল ব্যাকপকেটে।
সিগারেট, আহ সিগারেট। তীব্র প্রশান্তির অনুভূতি সারা শরীরে।
সমস্যাটা হল, এই যে আমার মহামূল্যবান জীবন, এই জীবনের চব্বিশটা ঘন্টা ব্রেন যদি শুধু সিগারেট খাবার সময়ের দূরত্ব ও তার প্রতি মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া গণনায় ব্যস্ত থাকে ও এই সিগন্যালে দেহকে পরিবর্তিত করতে থাকে, তাহলে সার্থকতা কোথায় গেল?
সিগারেটের দূরত্ব গণনার জন্য তো আমার মস্তিষ্ক ডেভলপ করেনি।
এই পরিমাপে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমার মস্তিষ্কের প্রকাশ্য স্ট্রাকচার অবশ্যই দৃশ্যমানভাবে বদলে যায়। হাজার হাজার সায়েন্টিফিক পেপার বের হয়েছে, তীব্র নেশাকারীর মস্তিষ্কের স্ট্রাকচার এত বেশি ভিন্ন যে, বিজ্ঞানীরা দ্বিধায় পড়ে গেছেন এমনো, তারা কি নেশা করে নউরনের স্ট্রাকচারকে এতটা চেঞ্জ করতে পারবে কোনদিন? নাকি যাদের মস্তিষ্ক এমন, তারাই নেশা করে? না, সবার মস্তিষ্ক একই রকম ছিল। তারপর, প্রণোদনা। প্রণোদনা। নিজ থেকে দূর, অনেক অনেক দূরে চলে যাওয়া। এত দূরে চলে যাওয়া যে, আমার মস্তিষ্কটাও আর মানুষের মত নেই। একটু গেছে বদলে।
মস্তিষ্ক ডেভেলপ করেনি এক ইন্টারকোর্স থেকে আরেক ইন্টারকোর্স পর্যন্ত দূরত্বটা মাপতে থাকার জন্য, একবেলা খাবার পর পরের বেলা খাবার সময় হওয়া পর্যন্ত দূরত্ব মাপতে থাকার জন্য, একবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর পরের ঘুমটা কখন হবে সেটা মাপতে থাকার জন্য, কার সাথে দেখা করলে আমার মুখের কোন পেশী কতটা শক্ত হয়ে উঠবে বা কীভাবে তাকে জুতা দেখাব সে পরিমাপে ব্যস্ত থাকার জন্য! সচেতন মস্তিষ্ককে এইভাবে অপপরিমাপে ব্যস্ত রাখার ফলেই আত্মশক্তির বিন্দুমাত্র আমরা অনুভব না করেই সত্তর বা আশি বছরের একটা জীবন কোনক্রমে কাটিয়ে দেই।
হয়ত মন্ত্রি হই, অথবা হালচাষের চাষি, ডাক্তার হই বা উকিলের মোক্তার- কিন্তু জীবনটা কোনক্রমে কাটিয়ে মরার পথে চলে যাই। মস্তিষ্ক সারা জীবন কী নিয়ে ব্যস্ত থাকল এবং ফলে উপলব্ধি বা মস্তিষ্কের প্রভাবে আমার আচরণ ও অর্জন কীভাবে পরিবর্তিত হল, তা একদিন, একবার, এক মুহূর্তের জন্যও অণ্বিত হয়নি।
তাইতো রাসূল দ. বলেছেন,
এক প্রহরের গভীর ধ্যান সত্তর বছর একাধারে নফল ইবাদাতের চেয়ে উত্তম।
কারণ, সত্তর বছরেও যে উপলব্ধিতে আমি পৌছিনি, এক প্রহরের গভীর ধ্যান আমাকে সে সন্ধান দিতে পারে, যদি আমি ধ্যানে প্রোপারলি পৌছতে শিখে থাকি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:২৬