একশো বছর বাঁচতে চাই, এখন আমার ষাট,
তিরিশ বছর পরে খোকার হবে উনষাট,
... সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণরকম-
মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম।
ঠিক তাই, আমাদের ভাবনা, আমাদের কাজের ধারা ও আমাদের মনের অবস্থাই নির্ধারণ করে, কতকাল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাঁচতে পারি। ঐশী হস্তক্ষেপ মানে হল ঐশী হস্তক্ষেপ। ওটা বাদ রইল।
কোনদিন যে কথা কল্পনাও হয়ত করিনি, এমন একটা পোস্টে স্বাগতম। এখানে যে কথা আসবে, তার মূলসূত্র অজানা হবার সম্ভাবনা সবচে বেশি।
আসুন, জেনে নেয়া যাক, আপনি কতকাল বাঁচতে চান? একটু থিতু হয়ে ভাবুনতো...
উম...
... দূরো! জীবন মাত্র শুরু। এখনো কিসসু ভাবিনি।
... সম্ভবত কোনমতে সুস্থ থেকে ষাট হলে চলে (আগে আমার ভাবনা এমনি ছিল)
... সত্তর পঁচাত্তর হলে তো লাকি
...শতায়ূ অঙ্গনের পাশ দিয়ে যাই, আর মনে মনে ভাবি, মানুষ এতদিন বাঁচে নাকি?
...মামা, দুধ চিনি ছাড়া আদা মেরে হাল্কা লিকারের একশো বিশ বছর চা দাও একটা।
আসলে, এই হল অবস্থা।
বডিপার্টস তো একশো নব্বই বছর পর্যন্ত সাপোর্ট দেয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আমরা কতটা পারব?
স্বল্পজীবন নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে আমরা পারি নব্বই থেকে একশো দশ।
সাধনার জীবন দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি নিয়মিত সামান্য সাধনা জীবনের দৈর্ঘকে করবে একশো পঁচিশ-ত্রিশ তক।
উচ্চতর সাধক উচ্চতর সাধক যদি হতে পারেন, এবং আসলেই জীবনের কোন উদ্দেশ্য পান, বয়স ত্রিশের কোটা না পেরিয়ে থাকলে আপনিও পারবেন খুব সহজেই একশো চল্লিশ, একশো পঞ্চাশ। কিন্তু একশো ষাটের বেশি যাওয়াটা হবে চরম দুষ্কর।
পৃথিবীতে সাধারণত সবচে বেশি বাঁচে কারা?
কচ্ছপ।
একটা কচ্ছপ সাড়ে তিনশো বছর বাঁচবে, আর মানুষ এত কম- এটাই ছিল মহান লেখক হুমায়ূন আহমেদের যন্ত্রণা। আহা, জীবন অ্যাতো ছোটো ক্যানে।
খুব সিরিয়াসলি বলছি, এই পোস্টটা সিরিয়াসই। আপনিও সাড়ে তিনশো বছর পর্যন্ত যেতে পারেন। তবে, আমি চাই না যেতে। কারণ, তাতে আমার আর একটা পাথরের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য থাকবে। মহাপ্রেমীরা মাঝে মাঝে এই অবস্থানে চলে যান, কিন্তু এতে একটা সমস্যা আছে, তাঁরা লাইফ রিজউম করতে পারেন না। অর্থাৎ, শুধু মস্তিষ্ক কার্যক্ষম থাকে, আর ভিতরের অতি সামান্য কিছু জিনিস।
ছোট থেকে শুরু করব কেন? বড় থেকেই করি!
দুই থেকে সাড়ে তিনশো বছর কীভাবে বাঁচতে পারি?
প্রথমেই, পরিপূর্ণ দর্শন ভিতরে থাকতে হবে। এই দর্শন জিনিসটা বড় আজব বিষয়। বিল গেটস, সিআইএ চিফ বা খান অ্যাকাডেমির সালমান খানের মত জানার পরিধি পৃথিবীতে খুব কম মানুষের আছে, কিন্তু তাদের এই দর্শন নেই। জানার সাথে, উপলব্ধির-দর্শনের তফাত এখানে, যে, জানা হল এই বিষয়, আমি জানলাম, এক কোটি মানে আট শূণ্যের পাশাপাশি অবস্থান। আর দর্শন মানে কিন্তু বিষয়টা ধারণ করা। অর্থাৎ, দর্শনের ক্ষেত্রে, আমি শুনে ফেললাম, এক কোটি টাকা, কিন্তু তাতে আমি তা ধারণ করলাম না।
পরিপূর্ণ দর্শন ভিতরে আসার পর কী হবে? জ্ঞানতৃষা নিবে যাবে। আমি অনেক অনেক কিছু জানি না। কিন্তু কার্যকারণ জানি। এ যে কী প্রশান্তি, কী উপলব্ধির স্তরে পৌছে দিবে, তা অকল্প। প্রথমেই, পরিপূর্ণ দর্শনপ্রাপ্ত মানুষ হন পরিপূর্ণ প্রশান্ত।
ছবি: সপ্তম শতাব্দীর পশমি কাপড় পরিহিত সূফি সাধক... গাউসে জিঁলী আলাইহির রাহমাহ্ 'র সময়ে।
-পরিপূর্ণ প্রশান্তি মানেই কিঙডম অভ হ্যাভেন বা জান্নাতুল মা’ওয়া (সিররুল আসরার, শাইখে জিঁলী আলাইহির রাহমাহ। সেখানকার বর্ণনা অনুযায়ী... জান্নাতুল মা’ওয়া হল পৃথিবীতে স্রষ্টা-উপলব্ধিকারীর অবস্থানের নাম।)
-পরিপূর্ণ প্রশান্তি মানেই আইয়ূহাল মুজজাম্মিল, আইয়ূহাল মুদ্দাসসির, ক্বালবুস সালিম। কম্বল আবৃত ব্যক্তি, চাদর আবৃত ব্যক্তি, প্রশান্তচিত্ত।
-পরিপূর্ণ প্রশান্তি মানেই ওম শান্তি! জগতের রহস্য ওম স্থাপিত হোক তোমার অন্তরে।
-পরিপূর্ণ প্রশান্তি মানেই নির্বাণ। নির্বাণ পরম সুখ। নির্বাণ পরম শান্তি। নির্বাণ, মানে, সমস্ত অস্থিরতা নিভে যাওয়া।
নির্বাণ, জান্নাতুল মা’ওয়া বা ক্বালবুস সালিম নিয়ে মূল হার্ডকোর পোস্টটা আসবে পরে।
তো যাই হোক, খুব সংক্ষেপে দু-চারশো বছরের হিসাব শেষ করছি। আপনি নির্বাণপ্রাপ্ত হলেন। নির্বাণপ্রাপ্ত হওয়া মানে, নিজের শরীরের প্রতিটা রোমকূপের উপর ইস্পাতকঠিন হাত পড়া। নিয়ন্ত্রণ প্রতিটা হরমোন ও সমস্ত ধরনের শারীরিক তরল উৎপাদনের উপর, এমনকি নিজের প্রতিটা জেনেটিক এক্সপ্রেশনের উপরও!
অবশ্যই তুষ্টির সাথে এই পৃথিবীর সব কাজ শেষ করবেন। তারপর যা হবে, একটা ফ্ল্যাশের মত করে বলে গেলে, প্রস্তুত হয়ে নির্জনতায় চলে যাবেন। ততদিনে আপনার বডি কন্ডিশন্ড। আপনি মাসাধিককাল একাধারে অনড় ধ্যান করে অভ্যস্ত। এবার যা হবে, তা এমন-
*এবারের ধ্যানটায়, মাইন্ড চলে যাবে সুপার ট্রেন্সে। অর্থাৎ, মস্তিষ্কর পুরোটা থাকবে সুপার অকার্যকর, শুধু দেহের মেটাবোলিক রেইট নিয়ন্ত্রণের পার্ট এবং ভাবনার অংশটুকু বাদে। ফলে, মস্তিষ্কের চলার জন্য রক্ত লাগবে অত্যন্ত কম, পুষ্টিগুণও অত্যন্ত কম।
*এখন থেকে, এই শরীরটা মৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত (আগামী ২/৩০০ বছর!) চোখ যেহেতু আর খুলবে না, যেহেতু আর ঘামবেন না, কোন ধরনের রেচনও হবে না, তাই কিডনি, পাকস্থলী, চোখ, হাত, পা, পিঠ, এইসব জায়গাতে রক্ত যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। প্রয়োজনীয় সব ধরনের দৈহিক তরল, যেমন পাকস্থলীর অ্যাসিড ও শুক্রগ্রন্থির শুক্র থেকে শুরু করে চোখ ভেজানোর অশ্রু পর্যন্ত তৈরি হবার প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি রহিত হবে। হৃদপেশি, ফুসফুস পেশি, নার্ভ, রক্তনালী ও নউরন ছাড়া আর কোন পেশি নড়বে না দেখে সেসব পেশির জন্য বিন্দুমাত্র শক্তি তথা গ্লুকোজ-সুক্রোজ তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
*এরপর যা হবে, সেটা আরো মজার। হৃদপিন্ড পাম্পকরবে শুধু সেইটুকু রক্ত, যেটুকু দেহের দরকার। আপনি, পূর্ণ সজাগ ও সজ্ঞাত আছেন, অথচ আপনার হার্টের বিটরেট দিনে দিনে কমতে থাকবে। প্রথমেই, ধ্যানে বসার আগেই কমে যাবে বিশভাগ (যেহেতু আপনার বডি এর মধ্যেই কন্ডিশন্ড।), ধ্যানে বসার সাথে সাথে কমবে আরো। তারপর, দিন কয়েক যেতে না যেতেই শ্বাস নেয়ার হার এত কমবে যে, মানুষ যদি নাকের ভিতরে একটা সুতা ধরে, সেই সূতাকে নড়তে দেখবে না। আরো কয়েকদিনের মধ্যে হার্টরেট এত কমে যাবে যে, কেউ নাড়ি টিপলে বা বুকে হাত রাখলেও ধরতে পারবে না, আপনি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন।
অথচ হার্ট বিট করছে, অথচ শ্বাস নেয়া চলছে। অতি অতি ধীর গতিতে। পরে তা নামতে থাকবে আরো নিচে।
*এই পয়েন্টটা আরো মজার, এখন যা হবে, তা হল, শরীরের তাপমাত্রা প্রাকৃতিক তাপমাত্রার প্রায় কাছাকাছি পৌছে যাবে। কেউ যদি তাপ-ক্যামেরায় দেখে, তাহলে মানুষ হিসাবে দেখবে না! দেখবে, একটা গাছ হিসাবে, যার উপরে গোড়া, মাঝামাঝি জ্বলছে, আর চারদিকে সামান্য ঘাসের মত পাতা ছড়ানো। আসলে তা আপনার শিরা ও উপশিরা। যাই হোক, এখন যা হবে তা হল, ব্রেনটা কোন কাজেই ব্যস্ত থাকবে না। মজার না? দেহের কাজ করার রেইট আপনি এমনিতেই ধরা যাক, হাজার ভাগের একভাগ করে ফেলেছেন।
ছবি: সাধারণ জীবনযাপন করে যারা সামান্য মেডিটেশন করেন নিয়মিত, তাদের ব্রেনের সক্রিয়তার আশ্চর্যজনক বিস্তৃতি
*ব্রেইন তখন কী করবে? ব্রেইন তখন যা করবে, সেইজন্যই এতকিছু। ব্রেইন তখন একে একে স্লেটের মত মুছে ফেলবে চোখের জন্য বরাদ্দ রাখা অংশটুকু, পেশীর জন্য এবং কষ্ট বেদনার জন্য বরাদ্দ রাখা নিউরনগুলোকে। এবং বেশিরভাগ স্মৃতিকে। আপনি তখন কী করবেন? সচেতনভাবে পুরো ব্রেইনে ছড়ানো শুরু করবেন একই স্মৃতির ও একই বিশ্লেষণের কপি।
ফলাফল?
আমরা ঘুমে মাত্র তিন সেকেন্ডে স্বপ্ন দেখি আট ঘন্টার সমান। কারণ, ব্রেইন অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে না, অথচ জৈবিক কাজগুলোতে তখন তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়।
আর এই সাধক, সচেতন থেকে যে ট্রেন্সে গেছেন, সেখানে সক্ষমতা কতগুণ বাড়বে? অকল্প অকল্প। ঘুমে থাকার সময় ব্রেন সাইকেল ফাইভ থেকে থ্রিতে যদি দেখার-অনুভবের-বিশ্লেষণ করার শক্তি ৬০ গুণন ৮ সমান ৪৮০ গুণ বাড়তে পারে, তাহলে যিনি ট্রেন্সে গেছেন, তাঁর একটা সেকেন্ড মানে তো বাস্তবে অন্তত পক্ষে ২,০০০ গুণ হবেই। কারণ, তাঁর ব্রেইন সাইকেল মাত্র পয়েন্ট ফাইভ। বরং দুহাজার গুণ কম বলা হল।
এই উপলব্ধি কালভেদীরাও, স্থানভেদীরাও বুঝতে পারে না। বুঝতে পারেন তিনিই, যিনি শুধু বিশাল বিশাল মহাযোগ সম্পন্ন করেছেন।
আর বিটরেট অনেকগুণ কমে যাওয়ায়, হার্টের স্বাভাবিক বয়স হতে লাগবে অনেক গুণ বেশি বছর। হার্টের বিটরেট যদি দুইশ গুণ কমে থাকে, তাহলে দুইশ বছরে হার্টের কার্যকারিতা কমবে মাত্র ব্যবহারিক জীবনের এক বছরের মত। ফুসফুসের কার্যকারিতা দুইশ বছরে কমবে মাত্র এক বছরের মত। শরীরে যতটা অতিসামান্য শক্তির দরকার, তা আসা শুরু করবে প্রথমে সমস্ত চর্বি গলিয়ে, তারপর একে একে অঙ্গকে শুকিয়ে এক অন্যরকম ফ্যাগোসাইটোসিস। তাও দুইশ গুণ ধীর। এই ফ্যাগোসাইটোসিসই, রিসাইক্লিঙ অভ ফ্লুইডই টিকিয়ে রাখবে শরীরটাকে।
অবস্থা এমন দেখাচ্ছে যে, তাহলে তো ওই ট্রেন্সে যেতে পারলে দুইশ বছরে এক দু বছর বয়স বাড়ার কথা, তারা আর বাস্তবে ফিরে আসতে পারবে না কেন? বা তারা মাত্র এক দুই বছর বয়স বাড়ার পর তখন মারা যাবে কেন?
পারবে না, কারণ, এই অঙ্গগুলোর রিজুভিনেশন হবে না। তবে, যদি তাকে লম্বা সময় ধরে বাইরে থেকে চেষ্টা করা হয়, তবে তাও সম্ভব হতে পারে। আর বাইরে থেকে প্রকৃতির চাপতো আছেই, সময়ের একটা প্রভাবতো আছেই, তাই মাত্র দু চার বছর বয়স বাড়লেও তাই হবে ওই নিভুনিভু প্রদীপের মৃততুর কারণ।
তিনি এভাবেই থাকবেন, নড়ার ক্ষমতা নেই, অথচ সারা সৃষ্টিজগত চষে ফেলছেন, সর্বকালের সব ঘটনা দেখা শুরু করেছেন, আর এক ধরনের গোপন মজা নেয়া শুরু করেছেন, যা তুলে আনা এভাবে লেখা পোস্টে বেমানান।
তিনি, যদি ট্রেন্সে মাত্র দুইশ বছর থাকেন, তবে তাঁর মস্তিষ্কের ও অভিজ্ঞতার বয়স হবে চার লক্ষ বছর!
তাসাউউফের চির অচেনা রহস্যময় ভুবনে স্বাগতম!
(আসলে এখানে লিখতে চেয়েছিলাম আমরা কীভাবে একশো বিশ বছর অনায়াসে জীবনযাপন করতে পারি... কিন্তু আলোচনা চলে গেল অন্যদিকে। পরের কোন পর্বে আশা রাখি।)
সহব্লগারদের কাছ থেকে মতামত চাই, চাই বিস্তারিত আলোচনা ও প্রয়োজনে প্রশ্ন। সবার জানাটা শেয়ার হোক, উপলব্ধির অণ্বয় হোক।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:৫৬