যদিও জ্ঞানযুগে প্রবেশ করেছি আমরা, কিন্তু তা বোধযুগে পড়েনি। বরঙ অবাক হয়ে দেখতে হয়, বোধযুগ চলে গেছে যুগে যুগে। বোধযুগ চলে গেছে মহামহিম নবী ইব্রাহিম আ.’র সময়। তারপর বোধযুগের আগমন মূসা আ., ঈসা আ., মহামতি গৌতম বুদ্ধ, মহামতি মহাবীর, দয়াময় রাসূল দ., তাঁর চার খলিফা রা. বা গাউসে জিলানী রা.’র সময়।
বোধযুগ তাকেই আমরা বলতে পারি, যে সময়টায় মানুষের মস্তিষ্কে তথ্যের সাথে সাথে উপলব্ধির প্রবেশ ঘটে। যখন উপলব্ধির প্রবেশ ঘটে, তখনি বদলে যায় আমূল, সবকিছু। বদলে যায় কল্যাণের দিকে। বোধের উন্মেষ ঘটায় সার্বিক-সামগ্রিক অনুভবের যোগফলের সমন্বয়। আর সার্বিক-সামগ্রিক অনুভব আসার একটা পূর্বশর্ত ওই, যাকে আমরা গালভরে কেরামতি নাম দেই।
বিশ্বের প্রতিটা তথ্য এখন বলাচলে কোন না কোনভাবে সাতশো কোটি মানুষের আঙুলের ডগায়। এই জ্ঞানযুগের কথা মানুষ কোনভাবে ভাবতেই পারত না দেড়শো বছর আগেও। আজ আর কোন প্রবাহক্ষম জ্ঞান গুপ্ত নেই। তথ্য ও উপাত্ত আজ ডালপালা ছড়িয়েছে চিরহরিৎবৃক্ষের মিথিক মহাপাখির মত।
এ যুগের সবচে বড় প্রাপ্তি, আমরা যা জানতে চাই, তাই জানতে পারি। সবচে বড় অপ্রাপ্তি, আমাদের তৃতীয় নয়ন-ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়-অলৌকিক ক্ষমতা-টেলিপ্যাথি বা ইলহাম নেমে এসেছে সর্বনিম্ন স্তরে।
একেই বোধহয় বলে, আয়রনি।
হাজারো বছর ধরে আমরা যে সাধরণ অতিচেতনার ধারক ছিলাম, সেই সাধারণ অতিচেতনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াতে সবচে বড় জ্ঞানযুগে প্রবেশ করেও বোধযুগের প্রশান্তিময় স্থিরতা থেকে আছি যোজন যোজন দূরে।
আমরা আজকে বিশ্বাস করি- মানুষ সাইকেল চালাতে পারে, মানুষ পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। কিন্তু এটা বিশ্বাস করি না- মানুষ তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার এতবড় স্বভাবজাত ও সহজাত ধারক-বাহক, যে, অলৌকিক শব্দটাই আসলে অলীক। ওই অলৌকিকতা মানুষের জন্মগত। স্বভাবগত। স্থান, কাল, পাত্র, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সেটাই এক চিরায়ত সত্য।
অথচ, যুগ বোধযুগে তখনি প্রবেশ করে, যখন একটা সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এই চেতনার ধারক ও বাহক হয়। তা-ই আমরা দেখি মহামতি গৌতম বুদ্ধের সময়কালে সব অনুসারীর মধ্যে। কিছু না কিছু অতিক্ষমতা। দেখি ঈসা আ.’র অঙুলিতে শিফায়ে কুল, সেইসাথে তাঁর অনুসারীদেরও অসম্ভব অবাস্তব সক্ষমতা। আমরা তখন সেটাকে হেসে মিথিক প্রক্রিয়ায় ফেলে দেই। আমরা মুসা আ.’র কম্যুনিটিতে দেখি সেই প্রোজ্জ্বল্য। দেখি, রাসূল দ.’র অনুসারী সাহাবী রা.’র হুকুমে বাঘ উল্টে দৌড় দেয়, দুর্গের দ্বার খুলে ঢাল বানান তাঁরা, বা সেই বিখ্যাত, উক্তি, মদিনা থেকে দূরের পাহাড়ে যুদ্ধনির্দেশ পৌছানো, ইয়া সারিয়া! আল জাবাল!
সারিয়া! পাহাড়ের দিক থেকে শত্রু আসছে!
দেখি, গাউসে জিলানী রা.’র সময়কালে ও কাছাকাছি সময়ের মধ্যে প্রায় পাঁচজন ইমামুত তরিক্বতের আগমন ও অধিলৌকিকতার ছড়াছড়ি বাগদাদের পথে প্রান্তরে। দেখি, হাসান আজমিরি রা. যার দিকে তাকান তারই সত্যদর্শন হয়ে যায়, ভারতের এক কোটি মানুষের।
বোধযুগ কি পুরোপুরি তিরোহিত?
এখনো আছে, কোথাও ব্যক্তিভিত্তিক, কোথাও কাল্টভিত্তিক, কোথাওবা কম্যুনিটিভিত্তিক। কিন্তু বিস্তৃত কম্যুনিটিতে আজ আর বোধযুগের দেখা পাই না। পৃথিবীর প্রতিটা তথ্য-উপাত্ত-জ্ঞান-বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ যখন আঙুলের ডগায়, তখন আমরাই এই বোধযুগকে মিথযুগে ঠেলে দিয়েছি। অথচ বোধযুগ উল্টো আমাদের ভিতরে প্রবেশ করার কথা ছিল।
যদি বলি, সুফিবাদে কিছু একটা গুপ্ত আছে, এই সেই গোপন বিষয়। যাকে আমরা চলতি ভাষায় বলি অলৌকিকতা, তাই।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:০৬