কত কিছু লিখলাম, স্ট্যাটাস-পোস্ট-কমেন্টে বাংলা-ইংলিশ ও বাংলিশে, এটা আর হয়ে উঠছিল না। কেমন যেন মিলিয়ে তুলতে পারছিলাম না কথাগুলো। কয়েকবার তৈরি করলাম, পছন্দ হল না নিজেরি।
অলৌকিকতায় এক আজব বিশ্বাস আগে থেকেই ছিল। কিন্তু 'অলৌকিকের' এই গালভরা নাম ও প্রক্রিয়ার সাথে ছিলাম অপরিচিত। সাইকিক হিলিঙের কথাটা প্রথম চোখে পড়ে দু হাজারে। আত্মসম্মোহন বইটা পড়ে তখন বিদদুত মিত্রে ফিদা। তারপরই আত্মউন্নয়ন! উফ্ ! ওই পুরনো, আট টাকায় কেনা পেঁজাপেঁজা বইটাকে কীভাবে যে আগলে রাখছিলাম ছ-সাত বছর!
মানুষের স্বভাবই সবচে কঠিন ও অবাস্তবটায় আগে আকৃষ্ট হবে। তাই হল। সমস্ত আকর্ষণ গিয়ে পড়ল ওই সাইকিক হিলিঙ বিষয়ক পাতাগুলোয়।
এখনো মনে পড়ে, লেখাগুলো ছিল অনেকটা এরকম,
শিক্ষানবীশ হিলারের পাশে বসে ভয়েস সাপোর্ট দিচ্ছেন সিনিয়র হিলার।
শিক্ষানবীশ হিলার ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই বলছে,
-আমার বিশ্বাস হয় না! এটা সম্ভব না।
-যা দেখছ শুধু বলে যাও। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নেই।
-আরে আমার কোর্সটা ঠিকমত করা হয়নি। উল্টাপাল্টা হাস্যকর বিষয় দেখছি।
-যা দেখছ শুধু বলে যাও। কোন খুঁটিনাটি ভাবতে হবে না। শুধু দেখাটুকু বলে যাও।
-সাবজেক্টের একপাশের ফুসফুস নেই, অন্যপাশের কান নেই- অবাস্তব।
-শুধু পর্যবেক্ষণ বলে যাও।
-আর ওই (ডান বা বাম) পায়ের হাড় ভাঙা।
এরপর ছাত্র হিলার বেরিয়ে এল ধ্যান থেকে।
তাকে জানানো হল, কথা সত্যি, যে সাবজেক্টের নাম-ঠিকানা-বয়স ছাড়া আর কিছু জানা ছিল না, তার কোনপাশের ফুসফুস নেই এবং কোন পাশের কান নেই, তাও বলে দিয়েছে শিক্ষার্থী হিলার। তবে পায়ের হাড় ভাঙার বিষয়টা তালিকায় নেই।
সাবজেক্টকে ফোন করা হল, তিনি জানালেন যে, ওই পায়ের ওই হাড় ভেঙেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। তিনি হিলিঙ রিকোয়েস্টে সেটা লিখে পাঠাতে ভুলে গিয়েছিলেন।
আমার লজিক তখন একটু অন্যরকম ছিল। ভাবলাম, কাজী আনোয়ার হোসেন, বিদদুত মিত্র নামে যিনি লেখেন, তাঁর টাকার জন্য এত খাই যদি থাকত, তিনি হোয়াইট প্রিন্ট বই বের করে আরো বহুগুণ লাভ করতে পারতেন। আর এই বইটা আত্মউন্নয়নমূলক বই, শুধু কয়েক কপি বিক্রি করার জন্য তাঁর মত একজন লেখক গাঁজাখুরি ফাঁদবেন না।
এই শুরু হল আমার যাত্রা।
শুরু করলাম যেটা করা সম্ভব। বই দেখে দেখে প্রতিদিন মেডিটেশন। তখন একটা খেলা হয়ে গিয়েছিল পরপর তিনমাসের জন্য। রাতে ঘুমানোর সময় বলতাম, ভোর চারটা আটত্রিশ মিনিট বারো সেকেন্ডে আমি ঘুম থেকে উঠব এবং গুণে গুণে ছ সেকেন্ড পর ঘড়ির অ্যালার্ম বাজতে দেখব।
এবং প্রথম দু এক সপ্তাহ রপ্ত হবার প্রক্রিয়ায় গেল। পরপর তিনমাস, কোনদিন আমি ব্যর্থ হলাম না কাঙ্ক্ষিত সেকেন্ডে ঘুম থেকে ওঠার প্রচেষ্টায়।
তারপর যা হয়, মজা লাগে, কদিন পর আর করা হয়ে ওঠে না।
কিন্তু মনে গভীরে সুপ্ত সেই সাইকিক হিলিঙ।
এরপর ঘোড়ার মত ছুটে যাওয়া। একের পর এক স্বপ্ন তৈরি এবং তার পিছু কিছুদূর গিয়ে নতুন স্বপ্নের জাল।
কীভাবে কীভাবে যেন, দু হাজার এগারোতে অ্যাকাডেমিকভাবে আবারো মেডিটেশন শিখলাম।
বারোতে সাইকিক হিলিঙ।
আহ! আমার সেই স্বপ্নের ঘুড়ি ওড়ানো এবার সত্যি হবে! কিন্তু কীভাবে? আমিতো ঠিক জাতের প্র্যাকটিশনার নই। তিনদিন নিয়ম করে ধ্যানে বসলাম তো দুদিন খবর নেই... হবে কি? হলে কদ্দূর হবে? স্ট্রেঙথ থাকবে কতটা?
অভিজ্ঞতাগুলো ব্যক্তিগত। তারপরও, না জানালে যেন দায়ভার থেকে যায়।
ক্লাস চলছে। লাঞ্চব্রেকে বেরিয়েই ফ্যামিলি মেম্বারের সাথে আলাপ,
-তুমি কেমন দেখলে মহিলাকে? কাঁচাপাকা চুল আর বলিরেখা চেহারার কথা বলো না। ষাটের কোটা বয়েসি মহিলা দেখতে এমনি হবার কথা।
-শাড়ি দেখলাম সাদা, মোটাপাড়। হালকা সবুজ।
খুশি হয়ে উঠলাম আমি, যাক, আমিও সাদা শাড়িই দেখেছি, পাড়ও মোটা, হালকা নীল। তার ব্রেনে মনে হয় প্রচুর কষ্টের স্মৃতি।
-চোখে চশমা দেখেছ?
-দেখিনাই তো। আমি দেখলাম চোখে সমস্যা আছে। বলতো তাঁর মূল সমস্যাটা কোথায়?
-শ্বাসকষ্ট।
-মাই গড! ও মাই গড! হিলার হয়ে গেলাম! আমি দেখলাম কি, তাঁর ফুসফুসভর্তি কফ, ফুসফুসে প্রচুর অতিরিক্ত ময়লা, তিনদিন ধরে রীতিমত অসুস্থতা। আচ্ছা, ব্লাডপ্রেশার বুঝতে পারসিলা? রক্তের লোহিত কণিকার কাউন্ট?
-প্রেশার লো, কিন্তু ক্ষতিকর না। রেডব্লাডসেল কাউন্ট অনেক কম।
-খাইসে! আর পীঠে পেশীর জড়তা?
-না, এমন কিছু টের পাইনি। তবে মেরুদন্ড একটু বাঁকা। এতকিছু মিলল কিভাবে দুইজনেরই?
-আল্লা মাবুদ জানে! আমি দেখলাম মেরুদন্ডের হাড়ে ক্ষয়।
-পেটের ডানপাশে কালো একটা অঞ্চল দেখলাম।
-আমি তো ওইখানে অপারেশনের দাগ দেখেছি!
-হাঁটু? হাঁটু?
-দুই হাঁটুতে বাতের ব্যথা।
-হোয়াট দ্য! আমি দেখলাম নিক্যাপের আধতরল জয়েন্টগুলো দুর্বল, নিয়মিত ব্যথা পায় ওই কারণে!
-বাম পায়ের পাতার তলায় ব্যথা।
-শিট শিট শিট! বাম পায়ের পাতার তলায় ব্যথা! আর ডান পায়ের হাড়ে সমস্যা।
-না, এমন কিছু আমি দেখিনি।
-আর মহিলার পরিবার?
-ভয় ভয় থাকে। আশ্রিতভাব আছে। ছেলের বউ আর সংসারের ঝগড়া নিয়ে চিন্তিত। এজন্যই বেশি বলিরেখা মুখে।
এই ছিল আমার হিলার হবার বারো বছরের স্বপ্নপূরণ!
ব্রেক শেষে ক্লাসে ফিরে গেলাম। ইভালুয়েশন ক্লাসে এবং আমার পর্যবেক্ষণের ৮৫% মিল পেলাম। সাথেরজনের ১০০%! সে তো মহিলার ওজন এক্সাক্টলি ছাপ্পান্ন কেজিও বলে দিয়েছিল।
যার কিচ্ছু হয়নি ওই ক্লাসে, তার পর্যবেক্ষণেরও সত্তরভাগ ঠিক হয়েছিল।
এরপর মাত্র দুটা ঘটনার বর্ণনা।
এক.
হিলিঙ মেডিটেশনে ছোটভাইটাকে দেখলাম পিঠের ডানপাশে, ফুসফুসের পিছনে উপরদিকে একটা ডিম্বাকার অঞ্চলজুড়ে মাংসপেশী শক্ত হয়ে আছে।
পরদিনের পরদিন।
বসে একটু অস্বস্তি করছিল ও।বললাম, কীরে, সমস্যা কোন?
-হু। পিঠব্যথা। গত একসপ্তাহ প্র্যাক্টিসে চাপ বেশি পড়ে গেছিল।
আমি পিছনে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখলাম এবং চমকে উঠে দেখলাম, ঠিক ওই জায়গায়, ওই অবস্থানে এবং ওই আকৃতিতে পেশী শক্ত হয়ে আছে।
চমকে উঠল ও-ও।
দুই.
আমার বাসার তৃতীয়জনের কোর্স অভিজ্ঞতা।
সাবজেক্ট ভদ্রলোকের ডানহাতের অনামিকার মাঝখানের হাড়টা ভাঙা!
বুকে সিগারেট খাওয়ার কারণে প্রচুর কফ জমা ও প্রচুর নিকোটিন সারা শরীরে।
ব্রেনের ফাঙশনে মৌলিক সমস্যা আছে (পাগলামি)।
শরীরে রক্ত শোধন মোটেও ভাল হচ্ছে না। লিভার কাজ করছে কম।
গেস হোয়াট!
চারটাই ঠিক।
টিএম মেডিটেশন, ওশো রজনীশের সিদ্ধি কোর্স, বোধিজ্ঞানা ভাবনাকেন্দ্রের সাধক, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের রামকৃষ্ণমিশন ধ্যান কোর্স, বাহা'ই মোরাকাবা কোর্স, কোয়ান্টাম মেথড, সিলভা মেথড, সূফী মেথড, তরিক্বতের দরবার মায় লালন সাঁইজির আস্তানা, কত জায়গায় কতভাবে যে এই একবিদ্যা শিখানো হচ্ছে, তার অন্ত নেই।
প্রতিদিন এই বিস্ময়ের মুখোমুখি হচ্ছে সারা পৃথিবীতে অন্তত কয়েক হাজার শিক্ষার্থী-দীক্ষার্থী। তারপর তা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা, গণিত দিয়ে মিলানোর চেষ্টা, ধর্ম দিয়ে প্রলেপের প্রয়াস- কিন্তু তারা ব্যাখ্যায় শান্তি পায় না। অবাক হয়ে প্রতিদিন প্রতিবার পর্যবেক্ষণ এবং পর্যবেক্ষিতকে সহায়তা করে করে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
ভেঙে যাচ্ছে তাদের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের বলয়।
বিশ্বাস পরিণত হচ্ছে পর্যবেক্ষণে।
পর্যবেক্ষণের সহস্র অভিজ্ঞতায় তা হয়ে উঠছে স্থানকালভেদী।
দরকার নেই কোয়ান্টাম বা সিলভাকে গন্ডাগন্ডা টাকা দেয়ার।
ওরা তো পাঁড় ব্যবসায়ীও হতে পারে। শুধু একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক না, আসলেই মানুষ স্থান-কাল ও বস্তু ভেদ করে দেখতে ও দেখা জিনিসে পজিটিভ প্রভাব রাখতে সক্ষম কিনা? পদ্ধতিগতভাবে, যে কোন একটা পদ্ধতি ধরে, নিখুতভাবে মাত্র তিন সপ্তাহের চর্চা। ইন্টারনেটেই সহজলভ্য সেসব সোর্স। অবশ্য আমরা জানি যে এ বিষয়টা সরাসরি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকলে কাজ হয় ভাল।
আহা! কোনদিন কাউকে সাঁতার কাটতে দেখিনি আমি। সাঁতারের নাম শুনেছি শুধু। বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই না করে চেষ্টা করেছি তারপর নাকমুখ দিয়ে পানি খেয়ে ক্ষান্ত দিয়েছি।
আমি তো চোখ বন্ধ করে আজীবন বলেই যাব, পানিরচে ঘনত্ব মানবদেহের বেশি। মানুষ মাছও না যে পানিতে ভাসবে। সুতরাং, কোনকালেই মানুষ নিজে নিজে পানিতে ভাসতে পারে না। বিজ্ঞান ভুল হতে পারে না, বিজ্ঞান ভুল হতে পারে না। সারা পৃথিবীর সব মানুষ যদি বলেও, সাঁতার আছে, আমি বলি, মানুষ মাছ না এবং তার ঘনত্ব পানিরচে বেশি তাই সে ভাসতে পারে না।
এখন করণীয় মাত্র চারটা দিক বাকি আছে,
হয় একদিন আবিষ্কার হবে এই আশায় বিজ্ঞানের বলার দিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। (তা আমার মৃতুর পরও হতে পারে।)।
অথবা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করি এমন কারো কাছ থেকে শুনে অবাক হওয়া। (পৃথিবীতে এমন মানুষ প্রায় নেই, যে কাউকে বিশ্বাস করে না।)
অথবা, নিজে চেষ্টা করে দেখা। জাত তো আর চলে যাচ্ছে না! (সাইকেল চালানো, সাঁতার শেখা বা ড্রাইভিঙের মত স্মুদ একটা কাজ এই হিলিঙ শেখা। বারো বছরের সাধনা প্রয়োজন নেই।)
অথবা, সর্বশেষ, বলা যে, সাইকিক হিলিঙ বলতে কিছু সবই ভূয়া। সব খ্যাতিলোভী, অর্থলোভী, ক্ষমতালোভী অথবা মোহগ্রস্ত।
আমি কৃতজ্ঞ, একটা জীবনে দেখার নতুন মাত্রা পেলাম। আমার কাছে হিলিঙ বিষয়টা ঠিক এমনি, সাঁতারের মত।
(উৎসর্গ: ফারজুল আরেফিন, আমার অন্ধকুঠুরী ব্লগে এখন পর্যন্ত একমাত্র কথা বলার সঙ্গী।)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:০৪