মালাউন, মালু, হোমো, গে- এসব শব্দ মুসলমানরা যখন কোন মানুষ সম্পর্কে ব্যবহার করেন, তখন যিনি এই শব্দগুলো ব্যবহার করছেন, তিনিও ইসলাম এর মূল শিক্ষা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
একটা কথা কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে- মানুষের হিন্দু থাকার অধিকার আছে, অধিকার আছে খ্রিস্টান থাকার, ইহুদি থাকার, পাকিস্তানি থাকার, ভারতীয় থাকার, মুসলমান থাকার। অধিকার আছে নাস্তিক থাকার বা বাউল থাকার। ইসলামও তাদের এই অধিকার দেয়।
আমাদের রাসূল দ. কোনদিন, কোনকালে কাউকে জোর করে মুসলমান বানাননি। কাউকে ট্র্যাপে ফেলে মুসলমান বানাননি। এমনকি যে মুসলমান নয়, তাকেও মুসলমানের চেয়ে কম সম্মান দেননি।
নিজের আলোকিত চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন- আমরা দিই গালি। নিজের মুখের খাবার তুলে দিয়েছেন- আমরা কেড়ে নিতে চাই তাদের মুখের খাবার। নিজের বিছানা ছেড়ে দিয়েছেন- আমরা ওদের বিছানার শান্তি কেড়ে নিতে চাই। নিজের উপাসনালয় ছেড়ে দিয়েছেন- আমরা ওদের উপাসনালয় ভেঙে ফেলতে চাই।
ধিক আমার নিজেকে, আমি মুসলিম- আমিও আগে না বুঝে এমন মনোভাব রাখতাম।
আপনার রাসূল নিজের রক্ত প্রবাহিত হবার পর বলেছেন, ওদের ক্ষমা কর, ওরা তো একদিন বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। ওরা যদি স্থাপন না করে, ওদের সন্তানরাতো পারে? ওদের ভাল রাখ, আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা কর। আমরা কী করি? ওদের রক্ত প্রবাহিত করতে চাই।
আমরা উপলব্ধি কেন করছি না, যে মানুষের সম্মান এটাতে- তিনি মানুষ। তিনি আমার নবীর গড়ন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন।
মানুষ তো ভুল করবেই। ভুল করতে করতে একদিন মানুষ উপনীত হতেও পারে মহামানবে। সেই মহামানবে উত্তরণ যে কী অদৃষ্টপূর্ব, কী অপূর্ববর্ণিত, কী অকল্পচিত্রিত, তা আমরা ভাবতেও পারছি না।
পোস্টে ব্যক্তিগত উদাহরণ এলে লজ্জিত হই। বলতে হচ্ছে, আমি যখন মনে করলাম, আমার ত্রুটির সংখ্যা বড়জোর পনের থেকে পচিশটা হবে, তখন নিজের ভিতরে দৃষ্টি দিলাম ধ্যানমগ্ন হয়ে। আর দেখলাম, আমার ত্রুটির সংখ্যা একশ পচাত্তরটার উপরে। না করা কাজের সংখ্যা পঞ্চান্নটার উপরে।
আমরা মাত্র মুসলমান হয়েছি, সত্যি, মাত্র মুসলমান হয়েছি। মুসলমান শব্দের অর্থ যে সমর্পিত ও শান্ত, সেটা কিন্তু হইনি। শুধু মুসলমান হয়েছি, এই গর্বে গর্বিত হয়ে যেন আমরা অন্যকে হেয় না করি। মুসলমানের স্বরূপ আমরা এক বিন্দুও দেখিনি। আমার নিজের একশ পচাত্তরটা ত্রুটির যে কোন দশটা যদি কেউ এক নাগাড়ে দেখে, জীবনেও আর ফিরে তাকাবে না আমার দিকে।
ঠিক তেমনি আপনার ক্ষেত্রে। আপনার ত্রুটি যদি সাকুল্যে মাত্র দশটা হয়, সেই দশটা ত্রুটি যদি কারো কাছে ধরা পড়ে, মুখ লুকাতে পারবেন না।
আবার উল্টোটা দেখুন, আমার অন্তত দশটা গুণতো আছে? আপনারও। আমার বা আপনার এই দশটা গুণ যদি কারো চোখে পড়ে, আর কখনো তারা আমাদের থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না।
এভাবে, ভাল দেখতে থাকলে, ভালর চর্চা করতে থাকলে এবং নিজের জন্য উপযুক্ত দীক্ষাদাতার হাতে দীক্ষিত হতে থাকলে একদিন মানুষ মানুষ হবে। একদিন মানব মহামানব হবে। ভাইরে, আমি আপনি শব্দগতভাবে মুসলমান, আসলটায় আত্মসমর্পিত ও শান্তিদূত নই। প্রকৃত ফলাফলে সমর্পিতর কোন ত্রুটি নেই। বিশ্বাস করেন, আমরা জানি।
আমি আর ওই নাস্তিক-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ভাই একই রকম। আমরা সবাই মনে করে বসে আছি, আমি সত্য জানি- তারপর আমার হিসাবে অসত্যপথের অনুসারীরা যা করে, সেই গালাগালি করে বেড়াচ্ছি।
যখন নিজের ভিতরের তাকে দেখতে পাবেন, কী মোহনবাশি বাজবে তা তারা বোঝাতে পারেননি, যারা নিজে দেখেছেন। কারণ, দেখার হাতি বোঝাতে গেলে হয়ে যায় থামের মত, নাহলে তলোয়ারের মত।
যখন নিজের ভিতরে নিজেকে চিনতে পারবেন, তখন এত শক্তিমত্তা টের পাবেন, এত বিশালত্ব অনুভব করবেন, যে এই কানকথা আর কথার যুক্তিতর্ক আর থাকবে না। নিজের এই নগ্ন শক্তিমত্তাকে বেশিক্ষণ ভাল লাগবে না। তারপর, সেটা পরদিন হতে পারে, আবার বারো বছর পর হতে পারে, ঢাকবেন নিজেকে। যখন ঢাকবেন বিলীনতার চাদর দিয়ে, সমর্পণের কাপড়ে, তখন হবেন শান্ত।
এই চাদর ঢেকে যিনি শান্ত হন, তাকে বলা হয় আইউহাল মুজজামমিল। বলা হয় ইনসানে কামিল।
এমনিতে তো কালিমা পড়লেই মুসলিম হিসাবে আমরা বিবেচিত হই, কিন্তু সেই নিজের মহামহিম ক্ষমতার স্বরূপ দেখে উন্মাদ হয়ে আবার যখন শান্ত ও প্রভুতে সপে দিবেন, তখন বুঝতে পারবেন, ইসলাম বলে কাহাকে, মুসলিম বলে আপনাকে। তখন বুঝতে পারবেন, লালন কেন বলেছিলেন,
বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথা এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১২:২৮