ইসলাম নিয়ে ন্যূনতম ভাবতে গেলেই হাদিসের শুদ্ধতা বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সমস্যাটা হল, মানুষের শুদ্ধ হাদিস চাই। আর সেটাকে এতই গুরুত্ব দেয় সব মত-উপমত যে, হাদিসের কথাগুলো ক্বুরআনের মতই- তফাৎ? ক্বুরআনের বাণি নামাজে পড়া যায়- এটা যায় না।
সত্যি, হাদিসটা এতই অবিসংবাদিত। কারণ? ক্বুরআন বলছে, এই রাসূল দ. নিজ প্রবৃত্তি থেকে কিছুই বলেন না। যাই তিনি বলে থাকুন না কেন, তা সরাসরি ওয়াহয়ি (ঐশীবার্তা) হয়ে থাকে!
তার মানে, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন শুদ্ধ হাদিস অনুসরণ করি। এটাও খেয়াল রাখতে হবে, তাঁর একটা বাণিকে যদি ‘জাল’ বা ফ্যাব্রিকেটেড বলে ফেলি- নিশ্চিত, আমরা একটা ওয়াহয়িকে অস্বীকার করার কারণে অস্বীকারকারী হয়ে গেলাম। আর অস্বীকারকারীকে আরবিতে বলে ক্বাফির। এইজন্য, যে হাদীসটা আমাদের জানা-বিশুদ্ধ ও সুন্দর হাদিস, তা তো মানলাম, কিন্তু আর হাদিসের লাখো ভান্ডারের খুব কমসংখ্যককেই অস্বীকার করতে পারব। কারণ, ফ্যাব্রিকেটেড বা জাল বা মওদ্বু হাদিসও আছে, কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা যতই হোক না কেন, প্রচলিত ছয় থেকে পনের হাজার বাণীই দেননি রাসূল দ. তাঁর ২৩ বছরের জীবনে। যে হাদিসগুলোকে আমরা নিশ্চিতভাবে, ১০০% প্রমাণের সাথে ধরতে না পারি জাল হিসাবে, সে হাদিসগুলোকে সব সময় আমাদের সম্ভাব্য হাদিস বিবেচনা করে সাবধানে থাকতে হবে।
আমরা সাধারণ মানুষরা ধরেই নিয়েছি, সহীহ্ হাদিস মানে শুদ্ধ হাদিস। কিন্তু সহীহ্ শব্দটার দুটা মানে-
১. প্রচলিত শুদ্ধ অর্থে সহীহ্, শুদ্ধের সরাসরি আরবি শব্দ।
২. ইসনাদে সহীহ্, বা একটা গ্রামাটিক্যাল ফরম্যাট, যে ফরম্যাটকে স্বয়ং নামকরণ করা হয়েছে সহীহ্।
সহীহ্ আর হ্বাসান- এই দু শ্রেণির হাদিস বিনা বিতর্কে শুদ্ধ। কারণ, হাদিসগুলো বর্ণিত হয়েছে অ-বিতর্কিত ও মানবিক-চারিত্রিক-ধর্মীয় দিক দিয়ে পুরো স্বচ্ছ ব্যক্তিদের মাধ্যমে, তারপর গ্রন্থিত হয়েছে কোন স্বীকৃত হাদিস গ্রন্থে। তার উপর আবার, এই বর্ণনাকারীদের প্রতি জেনারেশনে বর্ণনাকারীর সংখ্যা যথেষ্ট থাকাটাও সহীহ্ ইসনাদ গ্রামাটিক্যাল ক্যাটাগরির একটা শরত।
এরপর গারীব ও দ্বায়িফ হাদিসের কথাই ধরা যাক, গারীব হাদিসকে তো কউ কোনদিন জাল বলতে পারবেই না, কারণ হাদিসের প্রকৃতি নিয়ে বিন্দুমাত্র কথা নেই এই গারিব শব্দটায়, বরং, বর্ণনাকারীদের সংখ্যায় সমস্যা। এমনকি দ্বয়িফ হাদিসের বিবরণকারীদের জন্য হাদিসটিকে কমজোর বলা হয়, হাদিসের প্রকৃতির জন্য নয়। বাণির অশুদ্ধতার জন্য নয়।
সবচে অবাক ব্যাপার, মাওদ্বু হাদিস, যেটাকে আমরা সরাসরি বানানো হাদিস বা জাল হাদিস মনে করি, সেটাও জাল নাও হতে পারে। বিবরণকারীর সাথেও সংশ্লিষ্ট এই হাদিস। সেইসাথে হাদিসটা জাল বা বানানো, এমন সন্দেহের কথাও উঠে আসতে পারে- যেজন্য সেটাকে মাওদ্বু বলা হচ্ছে। আবার, হাদিস হিসেবে প্রচলিত কথাটা আসলেই নিরজলা মিথ্যা, এই ক্যাটাগরির হাদিসকেও মাওদ্বু বলা হয়।
সবশেষের কথা, এমন কোন প্রাচিণ বিবরণকারী নেই, যিনি সকল শুদ্ধ হাদিসকে গ্রন্থিত করেছেন।এমনটা দাবিও করেননি কউ। প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থকারদের সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রত্যেকের হাদিস গ্রন্থ লেখার পিছনে কাজ করেছে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য।
যেমন, ইমাম বুখারি রা. যে বই কম্পাইল করেছেন, সেটা লেখার উদ্দেশ্য ছিল, নিজস্ব একটা স্কুল অফ থট তৈরি করা। যাকে বলে মাজহাব। এজন্যই, তিনি অন্য স্কুল অফ থটের ইমাম, ইমাম আবু হানিফার রা. মাধ্যমে কোন হাদিস রেওয়ায়েত দেননি। তিনি এও বলেছেন, আমার ইমাম আবু হানিফা রা.’র মাধ্যমে বিবরণ গ্রহণ না করার মানে এই নয় যে, তিনি অবিশুদ্ধ। একই বিষয় দেখা যায় ইমাম বুখারি রা.’র প্রধান ছাত্র ইমাম মুসলিম রা.’র হাদিসে। তিনি তাঁর গ্রন্থে এক জায়গাতেও ইমাম বুখারি রা.’র বিবরণ নেননি। আবার তাঁরা দুজনেই বলেছেন, এর বাইরে অনেক অনেক সহীহ্ হাদিস রয়েছে, যা তাঁদের উদ্দেশ্যের সাথে অপরিহার্য ছিল না বলেই গ্রন্থিত করেননি।
সুতরাং,
১. আমরা যদি মনে করি, সমস্ত শুদ্ধ হাদিস শুধু বুখারি-মুসলিমে রয়েছে, নি:সন্দেহে ইসলামি হিসাবে আমরা অসম্পূর্ণ ঈমানের অধিকারী।
২. একই ভাবে যদি মনে করি, রাসূল দ.’র কথা-কাজ ও সম্মতি, যা আল্লাহ্ আজ্জাওয়াজাল্লার সরাসরি বাণি, তা অন্য গ্রন্থে নেই, তাও আমাদের বিশ্বাস অস্বীকৃতি তথা কুফরে পরিণত হচ্ছে।
৩. আমরা যদি মাত্র একটা সহীহ-হাসান-গারীব-দ্বায়িফ হাদিসকেও, যা আসলে ছিল রাসূল দ.’র বাণি, কিন্তু আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি- সরাসরি বানানো বা জাল হিসেবে উপস্থাপন করি; পক্ষান্তরে ধর্মের অপূরণীয় ক্ষতি করার পাপে, সমস্ত মুসলিম জাতিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে খোদায়ি বাণি অস্বীকার করার ভয়ানক অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে শেষদিবসে- যে ভার বহন করার মত শক্তি আমাদের রূহে থাকবে না... যদি আমরা শেষ দিবসে বিশ্বাসী হয়ে থাকি, এ সময় আমাদের আসবেই।
প্রিয় সুহৃদ, এই তথ্যটুকু জানা সব বিশ্বাসী মুসলিমের জন্য অবশ্যকর্তব্য হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ১১:৫৯