somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিছিল

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লঞ্চটা নির্দিষ্ট সময়ের দু-ঘন্টা পরে কালীর চর ঘাটে ভিড়ল। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছাওয়া, টিপ, টিপ বৃষ্টি পড়ছে। ঘাটে দু'এক জন যাত্রী নামল, কিন্তু সোনাকান্দা যাওয়ার একজন সাথীও মিলল না। বাজারের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নেয়ার ইচ্ছে হল।

চা খেতে - খেতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল, আকাশ আরো কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল। ঘন অন্ধকার, সেই সাথে টিপ টিপ বৃষ্টি, স্যাঁত স্যাঁতে পিচ্ছিল গাঁয়ের মেঠো পথ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা ভীষন হয়ে গেল। মেঘের গর্জন, ঘন ঘন বিদ্যূতের ঝলক। সঙ্গে টর্চ না আনার জন্যে আফসোস হতে লাগল। হাতে সময়ও বেশী নেই, যে করেই হোক রাত্রিতেই সোনাকান্দা পৌঁছাতে হবে। কাল আবার শহরে না পৌঁছালে মক্কেলরা কষ্ট পাবে। কোন দিক চিন্তা না করে নিজ সাহসের ওপর ভর করে গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করলাম, মাত্র তিন মাইল পথই তো ! তাছাড়া পথও চেনা। এমন কি আর অসুবিধা হবে। বাজার ছেড়ে তিন রাস্তার মোড়ে বহু বছরের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা বট গাছটার নিচে আসতেই পেছন থেকে ডাক এলো " ভাইজান খাড়ান " । আমি থমকে দাড়ালাম।

কৈ যাইবেন ? সোনাকান্দা মিঞা বাড়ী বুঝি ? নানীর অসুখ দেখতে আইছেন ?

তা তুমি জানলে কি করে ?

কি যে কন মিয়াভাই, আমি বুঝি আফনেরে চিনিনা ! আফনে রফিক ভাইজান না। ছোড কালে যখন আফনে নানী বাড়ী থাইক্যা পড়ালেহা করতেন, হেই সময়ের কথা মনে নাই আফনের। উত্তর মুরার কৈলার ভিটায় আফনেরে লইয়া কত আম খাইতে গেছি ! হাঁটের দিন আমার কান্দে চইড়া কত হাটে গেছেন।

শৈশবের কথা কত মনে থাকে আর। বুঝতে পারলাম সোনাকান্দা গ্রামেরই কেউ একজন হবে। যাহোক চলার পথে একজন সাথী পেয়েছি সেই যথেষ্ট। আমি নীরবে পথ চলছি। সে কিন্তু থেমে নেই, প্রশ্ন করছে আর আমাকে নিরুত্তর দেখে নিজেই আপন মনে উত্তর দিয়ে চলছে।

তাহের ঘড়ামির কথা মনে পড়েনি ভাইজান ? গেরামের পুব মাথায় বাড়ী আছিল। ঘড়ের কামে ঘড়ামির খু-উ-ব নাম ডাক আছিল। মুক্তিযুদ্ধে গেছিল, যুদ্ধের থন আর ফিরে নাই। মাইনষে কয় মইরা গেছে। ঘড়ামীরে না পাইয়া পাক সেনারা বৌডারে ধইরা নিয়া গেছিল। সব রকমের অত্যাচার করনের পর ছাইরা দিছিল। জানে মরে নাই, তয় পাগল হইয়া গেছে। দিনের বেলায় দেখবেন বাজারের বট গাছটার তলায় বইয়া থাকে। কেউ ডাইক্যাও জিগায় না। ফোঁস করে একটা নিঃস্বাশ ছাড়ল সে।

ভাইজান, কোরবানের কথা মনে পড়ে ? হেই যে পচ্চিম কান্দার কোরবান ! আপনের মনে থাকব কেমনে। আইজের কতাতো না। আফনে হেইজে লেহাপড়ার লইগা শহরে গেলেন আরতো গেরামে ফিইরা আইলেন না। গেরামডারে আর চিনন যায়না ভাইজান। যে দুই বেলা ভরপেট ভাত খাইত হে এহন একবেলা রুডিও খাইবার পায়না। কোরবান ও হেই দলের একজন। বৌ - পোলাপানরে ভাত - কাপড় জোগার করতে না পাইরা গলায় দড়ি দিয়া মরছে। জ্বালা জুড়াইছে।

ছাদেম আলীর কতাও আপনের মনে নাই মনে কয় ! ছাদেম আলি শহরে গিয়া গুল্লি খাইয়া মরছে। গেরামে কাম জোগাড় করতে না পাইরা রুজির ধান্দায় শহরে গেছিল। শহরে কাম দিব কেডায় ? কয়দিন এদিক - ওদিক ঘুইরা হেষে সহজ পথটাই রাইছা লইছিল। মাইনষের কাছে হাত পাইতা ভিক্ষা করত। রাইত হইলে ইষ্টিশনে ঘুমাইয়া থাকত। একদিন ভোর বেলা কয়েকজন ভদ্রলোক আইয়া ছাদেম আলীর হাতে দশটা টাহা দিয়া কইল ল' আমাগো সাথে। তগ লইয়া মিছিল করুম। তোরা কাম পাবি, দুই বেলা পেট ভইরা খাইবার পাবি। ছাদেম আলী আলী সুখ স্বপ্নের লোভে মিছিলে গেছিল। মিছিলের উপরে পুলিশ গুলি চালাইছিল। আর হেই গুলি খাইয়া ছাদেম আলী মইরা গেছে। ছাদেমের লাশ লইয়া হেই লোকগুলা টানা হেঁচড়া করছিল কিন্তু লাশ রাখতে পারে নাই। পুলিশ আরও লাশের সাথে ছাদেমের লাশও কই জানি লইয়া গ্যাছে। ছাদেম এর মরন লইয়া হেই লোকেরা সভা করছিল। কিন্তু হেতে ছাদেমের কি লাভ হইল কন ভাইজান ? বৌ-পোলাপন গুলা ভিক্ষা আর চুরি - বাটপারি কইরা জীবন চালায়।

উত্তর কান্দার রশিদের বড় মাইয়া সোনাবানের কতা মনে অইলে দুঃখে বুকটা ফাইট্টা যায়। যেমন নাম তেমন সোনার মতই দেখতে আছিল। বড় হাউস কইরা বাপে বিয়া দিছিল। জামাইরে খায়েশের রেডিও দিতে পারে নাই বইল্যা অত্যাচার করত। নিত্যদিনের অত্যাচার সহ্য করতে না পাইরা বাপের বাড়ী চইলা আইছিল। অভাবের সংসার বাপেরই চলেনা মাইয়া চালাইবো কইথ্যন ! মাঝে মধ্যেই মনের কষ্টে মাইয়াডারে বকাঝকা করত। মাইয়াডাও এইসব সহ্য করতে না পাইরা একদিন রাইতে পালাইয়া শহরে চইলা গেল। হেইহানে গিয়াও শান্তি নাই, খারাপ মাইনষের খপ্পরে পইরা খারাপ পাড়ায় নাম লেহাইছে। অর ছোড বইনডারও একই কপাল। শহরে গিয়া এক সাহেবের বাসায় কাম নিছিল। সাহেবের পোলার খপ্পরে পইরা পোঁয়াতি হইল। সাহেব নিজের ইজ্জত বাচানের লাইগ্গ্যা অরে কামের থন বাইর কইরা দিছে। গেরামে আইয়া মাইনষের কথার চোটে থাকতে না পাইরা আবার শহরে চইলা গ্যাছে। অহন পোলা কোলে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে। আমার লগে গত বছর দেহা হইছিল।

রাতের অন্ধকারে পিচ্ছিল রাস্তায় হাঁটতে এমনিতেই কষ্ট হচ্ছে তার মধ্যে এই এক ঘেয়েমি প্যাঁচাল আর ভাল লাগছিল না। ধমক দিয়ে বললাম, তোমার বাজে বকবক বন্ধ কর।

অবাক হয়ে সে বলল, কন কি ভাইজান ? এ্ইসব বাজে কথা ! তাইলে ভালা কতাডা কি ? আমারে কইতে পারেন ? আফনের ইচ্ছা হয়না দেশের মাইনষের সুখ-দূঃখের কতা গুলান হুনতে ! আমরা কি আছিলাম আর এহন কি হইলাম। আফনে তো শিক্ষিত মানুষ। অনেক লেহাপড়া করছেন। কনতো, ছাদেম আলি কি দোষ করছিল ? সোনাভান কেন পাপের খাতায় নাম লেহাইল ? সোনাভানের বইনডা কেন অন্যের পাপ লইয়া ঘুইরা বেড়ায় ? ঘড়ামির পাগল বৌডার খোঁজ খবর কেউ লয় না কেন্ !

মাইনষের কতা আর কত কমু। এইবার আমারডা কই। আফনে তো আবার সামনের থন বাঁয়ের পথ ধরবেন। আমিতো আর যামুনা। ভাইজান, আমি মোটামুটি ভালই আছিলাম। গা-গতর খাটাইয়া যা কামাইতাম তা দিয়া ভালই চইলা যাইত। কিন্তু বৌডার রুপটাই আমার কাল হইল। হালিম মাতব্বর এর নজর পরল আমার বৌডার ওপর। বাড়ীতে কাম করানোর কতা কইয়া লইয়া যাইয়া জোর কইরা আকাম করল। কতা ফাঁশ হওনের ডরে বৌডারে খুন কইরা আমার ঘরের মদ্যেই থুইয়া গেল। হেই দিন কামথন আইতে একটু রাইত অইছিল।
বাড়ী আইায়া দেহি আমার উঠানে পুলিশ সহ গেরামের বেবাক লোকজন জড় হইছে। পুলিশ আমারে বাইন্দা লইয়া গেল। পরে যা হউনের তাই হইল। মাতব্বরের পয়সা খাইয়া গেরামের কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিল - আমি নিজেই নাকি বৌ-ডারে মারছি। কন ভাইজান গরীব মাইনষের কি সুন্দর বৌ থাকনডা দোষ ? আমার ফাঁসি হইয়া গেল। কেউ আমগো খোঁজ খবর লয়না, আমগো ভালার লাইগা দুইডা কতাও কয়না। কেউ খোঁজ লয়না কেন ? কেউ কতা কয়না কেন ?

সে বেশ রেগে গেছ মনে হল। বলতে লাগল, আফনেগো দিয়া কিছুই অইবনা। তাইতো এত কষ্ট কইরা বাংলাদেশের গাঁও - গেরামে ঘুইরা বেড়াইতেছি - কোরবান, ছাদেম, সোনাভান, তাহের গো এক করনের লইগ্যা। আমরাও মিছিল করুম, অধিকারের মিছিল, সত্যিকারের মিছিল। হিঁ - হিঁ - হিঁ -

হাসিটা শুনেই গা টা ছম ছম করে উঠল। পেছন ফিরে দেখি কেউ নেই।


উধাও ভাবুক
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:১৩
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×