ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা, পেশা, সম্পদ ইত্যাদি অনুসারে পৃথিবীতে বিভিন্ন ভেদাভেদ তথা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে এবং একই ধরনের সম্প্রদায়ের মধ্যে আবার উপবিভাগ রয়েছে। ভাষা, ধর্ম, জাতীয়তা বা বর্ণভেদ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবগোষ্ঠির মধ্যে মাঝে মাঝে এমনই অসুস্হ বিরোধ বাধে যে, মানুষ যে 'জন্তু' নয় পৃথিবীর সোব মানুষই যে বিবর্তনের চুরান্ত পর্যায়ে একই গোত্রের প্রানী (Homo Sapien) তা যেন ভুলে যায়।
মানুষ কর্তৃক তৈরী এই কৃত্রিম ভেদাভেদ। পৃথিবীতে বিভিন্ন অন্চলের ভৌগলিক পরিবেশের প্রভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠির চেহারা, ভাষা, আচার ব্যবহার, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদির বৈচিত্র দেখা যায়। এগুলি ঈশ্বর নির্দেশিত, চিরন্তন কোন ব্যাপার নয়। নির্দিষ্ট অন্চলের মানুষ এগুলোকে অনুসরন করে বংশপরস্পরায় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বংশধরদের শেখায়। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহন করে তখন সে কোন ভাষা শিখে বা কোন ধর্মমতে বিশ্বাস নিয়ে, সে কোন দেশের নাগরিক বা কোন জাতের বা কোন পেশা গ্রহন করবে তা ঠিক করে নিয়ে জন্মায় না। কিন্তু সে যতই বড় হতে থাকে, তার বাবা মা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসকে চাপিয়ে দিতে থাকেন। বাবা-মা-প্রতিবেশীদের ভাষা অনুকরন করে সে ভাষা বা ভাব প্রকাশের উপায় শেখে, অমুক ভৌগলিক পরিসীমার মধ্যে তার দেশ, এই ধরনের জাতীয়তাবোধ জন্ম নেয়। উচুঁজাত বা ধনী হলে তা মধ্যে নীচুজাত বা গরীবের প্রতি উন্নসিকতা ঢোকান হয়। সামাজিক প্রতিযোগীতার জন্ম নেয়।
কোন হাসপাতালের প্রসূতবিভাগে যদি একজন হিন্দু ও একজন মুসলিম রমনী পাশাপাশি যদি দুইটি পুত্র সন্তান প্রসব করে, এবং নার্সের অসাবধানতায় যদি বাচ্চা দুটি পাল্টাপাল্টি হয়ে যায়, তবে পরবর্তীকালে হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তানটি মুসলিম পরিবারে বড় হবে, কোরান পড়বে, উর্দু বা আরবী ভাষা শিখবে ও মুসলিম আচার ব্যবহার আয়ত্ত করবে। অপরদিকে, মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুটি হিন্দু হয়ে বেড়ে উঠবে, বেদ-উপনিষদকে একান্ত অনুস্মরনীয় মনে করবে। দুজন বিয়েও করবে প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বি তরুনীকে। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার মত ভয়াভহ যড়যন্ত্রের শিকার যদি ওরা হয় তবে, হিন্দু বাবা মায়ের সন্তানটি মুসলিম ধর্ম রক্ষার নাম করে মুসলিম বাবা মায়ের সন্তান কিন্তু হিন্দু বলে পরিচিত, যুবকটিকে হত্যা করতে পারে বা উল্টোটিও হতে পারে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে এদের আলাদা করে চেনার কোন উপায় নেই,(যদি বংশগত বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ না পায়) এ ক্ষেত্রে বাস্তব পরিবেশই মূখ্য। এই পরিবেশই কৃত্রিমভাবে একজনকে বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম বা খ্রীষ্টান হিসেবে পরিচিত করে। বাংলাদশী, ভারতীয়, চীনা, জাপানীজ, আমেরিকান হিসেবে গড়ে তোলে, অর্থাৎ ধর্ম, ভাষা, জাতীয়তা ইত্যাদি কৃত্রিমভাবে আরোপিত ব্যাপার মাত্র।এই ধরনের ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা টিকিয়ে রাখা মানবজাতির সামগ্রীক অদুরদর্শী চিন্তার পরিচায়ক এবং কোন কোন দেশে স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের পরিচয়, দেশের তীব্র সমস্যার সময়, শাসকশ্রেণী ব্যাপক মানুষের বিক্ষোভ থেকে বাঁচার জন্য নানা কৌশলে সাম্প্রদয়িক দাঙ্গা, অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ ইত্যাদি বাঁধিয়ে দেয়, এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দুর না করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য শুধুমাত্র দুঃখ প্রকাশ বা নিন্দা জ্ঞাপন করে থাকেন।
সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দুর করা সময় সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয়, কারন এটি অনড় বা চিরন্তন নয়।
ভাষা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার অন্যতম মাধ্যম মাত্র। বিভিন্ন পরিবেশের প্রভাবে বিভিন্ন অন্চলে বিভিন্ন ধরনের ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, বাস্তব যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রন যেমন ঘটেছে, তেমনি ইচ্ছা করলে যে কেউ বিভিন্ন ভাষা শিখতে পারে বা নিজের মাতৃভাষা সহ কোন ভাষা পরিত্যাগ করতে পারে। মাতৃভাষার প্রতি যেমন, তেমনি অন্য ভাষার প্রতিও যুক্তিহীন, অহেতুক উন্নাসীন বা মোহ পোষন করা উচিৎ নয়, পাশাপাশি 'এসপ্যারেন্টার' মত কোন আন্তজার্তিক ভাষা গড়ে তোলার কথাও মোহমুক্তভাবে বিবেচনা করা উচিৎ।
বিশেষ সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিস্হিতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন অন্চলের মানুষ নানা তথাকথিত ধর্মমতের ও ধর্মীয় অনুশাসনের সৃষ্টি করেছে এবং অনুসরন করছে, এগুলি কোন ঈশ্বর বা পরমআত্নার মুখনিঃসৃত বানী যেমন নয়, তেমনি চিরন্তন স্হায়ী কোন ব্যাপার নয়। টাকার লোভে বা বিয়ের সুবিধার জন্য, আদর্শগত বা ব্যক্তিগত ভাললাগা ইত্যাদি নানা কারনে যে কেউ বাবা মায়ের ধর্মমত পরিবর্তন করে অন্যধর্ম অবলম্বন করতে পারে_করছেও। সময়ের সঙ্গে নানা ধর্মমতের খুটিনাটি অনেক কিছু পাল্টাচ্ছে। একই ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন অন্চলের মানুষ ধর্মীয় খুটিনাটির অনেক কিছু বিভিন্ন ভাবে অনুসরন করছে।
ধর্ম ও ভাষা কোন ব্যক্তির ব্যক্তগত ব্যাপার হিসেবে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রচারও রাখা উচিৎ, কারো উপর কোন ভাষা চাপিয়ে দেওয়া যেমন অন্যায়, তেমনি শাসনযন্ত্রের মাধ্যমে এগুলিকে কেন্দ্র করে সংকীর্ণ চিন্তকে প্রশ্রয় দেওয়াও উচিৎ নয়। কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে সে যে কোন ধর্মমত অনুসরন করতে পারে। রাতারাতি ও জোর করে মানুষের মধ্য থেকে হাজার বছরের এ বিশ্বাস__ ভ্রান্ত হলেও__ দুর করা সম্ভব নয়। তাই সঠিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার তুলে ধরার কাজ দীর্ঘদিন ধরে বহুজনকে করে যেতে হবে, যাতে জনগন ভালমন্দ বিচার করার, গ্রহন বর্জন করার বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস স্বাধীনভাবে অনুসরন করতে পারে।
ধর্ম ও ভাষার মত জাতীয়তাও কৃ্ত্রিম ভাবে সৃষ্ট। গোষ্ঠীপতির প্রয়োজনে, অথবা নির্দিষ্ট অন্চলের সামন্ঞ্জস্যপূর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতিকে অনুসরন করা কোন একটি গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বার্থ ও সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনে বিশেষ ভৌগলিক সীমা নির্দিষ্ট আছে। পৃথিবীর মাটিতে বিশেষ দেশের সীমানা হিসেবে চিরন্তন কোন চিহ্ন দেওয়া নাই। এই সীমা মানুষের তৈরী করা। পেশাগত, রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রয়োজনে যে কেউ তার মূল জাতীয়তা তথা মার্তৃভুমি ছেড়ে অন্য দেশের নাগরিক হতে পারে।প্রকৃতপক্ষে একটি গ্রাম, জেলা, রাজ্য বা রাষ্ট্র নয়, এই সমগ্র পৃথিবীই প্রতিটি মানুষের মার্তৃভুমি বা দেশ, কারন এই পৃথিবীতে সমস্ত মানুষ শারীরিকভাবে ও এই শরীরের গুনাবলীর দিক দিয়ে মূলগতভাবে একই রকমের। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের স্বার্থ পরস্পরে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমান ঐতিহাসিক পরিস্হিতিতে, বিভিন্ন জাতিসত্তার সঠিক বিকাশ ও তাকে বৈজ্ঞানিক সমাজ চেতনার সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন এবং এইভাবেই এই ধরনের জাতীয়তাবাদী ভেদাভেদ গুলি দুর হয়ে, মানবতাবাদী আন্তজার্তিকতাবোধ গড়ে উঠতে পারে, যা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির নয়, ব্যাপক জনগনের স্বার্থরক্ষা করবে। তবে, এই ধরনের ভেদাভেড দুর হওয়ার অন্যতম শর্ত__ অর্থনৈতিক আধিপত্য ও বৈষম্য দুর করা।
গায়ের রং সাদা বা কালো ভেদাভেদও তথাকথিত ঈশ্বরের অভিপ্রায় কিছু নয়।এটিও পরিবেশের উপর নির্ভর করে। মেলানিন নামক রাসায়নিক পদার্থ চামড়ার কালো রংয়ের জন্য দায়ী। পৃথিবীর নিরক্ষরেখার কাছাকাছি উষ্ণ অন্চলে সুর্যালোকের বিশেষ প্রাচুর্য এই মেলানিন তৈরীতে সাহায্য করে, তাই সেখানকার মানুষের গায়ের রং, শীতপ্রধান অন্চলের তুলনায় কালো হয়। বর্ণবিদ্বেষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবৈজ্ঞানিক ও সংকীর্ণ মানসিকতার প্রকাশ।এই মানবিকতা অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
যতদিন না এই প্রতিকূল সমাজিক শক্তিকে দুর করতে ও প্রতিকূল প্রাকৃতক শক্তি সম্পর্কে অহেতুক ভীতি দুর না করতে পারবে ততদিন চেতনার অতীন্দ্রিয় অলৌকিক শক্তির প্রতি ভীতি ও নির্ভরতা এবং তাকে কেন্দ্র করে তথাকথিত ধর্মচিন্তা ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ টিকে থাকবে। অন্যদিকে, শুধু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই বিোধের একমাত্র কারন নয়_ আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদাগত বৈষম্য ইত্যাদিও মানবজাতিতে ভ্রাতৃত্বমুলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধা দেয়। এই বৈষম্য দুর না করলে, শ্রেণীর উচ্ছেদ না ঘটালে, মানবজাতির প্রকৃত সংহতি, প্রগতি ও অস্তিত্বের স্হায়িত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়, এর জন্য ভিন্নতর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নরনারীর বৈবাহিক সম্পর্ক স্হাপনের মত কিছু কিছু প্রগতশীল পদক্ষেপ সহ আরো বহু বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নিতে হবে, এবং এই কাজে শুধু শিক্ষিত নয়, বিপুল সংখ্যক সচেতন জনগনের যৌথ, আন্দোলনধর্মী প্রচেষ্টা দরকার_____ যা সমাজ ব্যবস্হার আমুল পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং সমস্ত ধরনের ভেদাভেদ দুর করে পৃথিবীর সব মানুষকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ব করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৯:০৯