'Atlantis: The Antediluvian World'
স্তিমিত আটলান্টিস
গ্রীক দার্শনিক ক্রেন্টরই (খ্রীঃপূঃ ৪০০) প্রথম আটলান্টিসের অস্তিত্ব নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা শুরু করেছিলেন। তিনিও তাঁর রচনায় আটলান্টিস সম্পর্কে তথ্যের সূত্র হিসেবে ঈজিপ্টশিয়ান নগরী সাইসের শিলালিপির কথা উল্লেখ করেন। ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন বিখ্যাত দার্শনিক এবং পন্ডিতদের বিলুপ্ত মহাদেশটির অজানা তথ্য জানার জন্য রাতের ঘুম হারাম করার নজির পাওয়া যায়। তারপর হঠাৎ একদিন সব কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গেল। আটলান্টিস হয়ে রইল একান্তই প্লেটোর কল্পনা...... ধীরে ধীরে যেন গল্পটি সবার স্মৃতিতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল......।
আটলান্টিসের পুনরুত্থান
আরো ৯০০ বছর পর...... সময়টি জাগরণের...... ঘুম ভেঙ্গে পৃথিবীর জেগে উঠার...... সময়টা রেঁনাসার। জেগে উঠে আটলান্টিস নামের আলেয়াটাও। এবার আটলান্টিসের অস্তিত্বের পক্ষে ওকালতি করার জন্য অনেক পন্ডিত জুটে গেলেন...... তবে বিরুদ্ধ পক্ষও যে ছিল না তা কিন্তু নয়। অর্থাৎ পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকে নিয়ে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে আবার সদর্পে ফিরে আসল আটলান্টিস।
পন্ডিত সমাজে বিতর্কটা ঝড় তুললেও সাধারণ মানুষেরা এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল না।
সাধারণ জনগণ এই রহস্যের সংস্পর্শে আসতে আসতে পেরিয়ে যায় আরো প্রায় ৩০০ বছর অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আর এই কাজটি করলেন ঔপন্যাসিক ইগ্নাটিয়াস ডোনেলি ( ১৮৩১-১৯০১) তাঁর 'Atlantis: The Antediluvian World' বইটির মাধ্যমে। বইটিতে তিনি আটলান্টিস সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিণী এবং জনশ্রুতির সম্মিলন ঘটান।
ঔপন্যাসিক ইগ্নাটিয়াস ডোনেলি ( ১৮৩১-১৯০১)
কাহিণীগুলোতে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাটার বর্ণনার কিছু ভিন্নতা থাকলেও মহাদেশটির অস্তিত্ব সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য ছিল না। এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ডোনেলি এই উপসংহারে পৌছেন যে, স্বর্গ সদৃশ এক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল আটলান্টিসে...... তিনি ভৌগলিক একটা ধারণাও দিলেন মহাদেশটির। শুধু তাই না তিনি দাবী করলেন সেই সভ্যতা নতুন আর পুরানো পৃথিবীর মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করেছিল।
এভাবেই মানুষের মনে ধীরে ধীরে অবয়ব পেতে থাকল এক প্রাচীন ‘সুপার সিভিলাইজেসন’। এর পক্ষে-বিপক্ষে চলতে থাকল অবিরাম তর্ক-বিতর্ক...... এভাবে পরিমার্জিত হয়ে উঠতে থাকল কাহিণীটি...... ঝরে পড়তে থাকল এর কাল্পনিক অংশগুলো......।
আটলান্টিস নিয়ে অনেক রচনা থাকলেও ডোনেলিয় মূলত আকর্ষণটা বিশেষজ্ঞদের টেবিল থেকে সাধারণদের কাতারে এনে ফেলেন। তিনি যখন আটলান্টিকের মধ্যিখানে একটি সভ্যতার হারিয়ে যাবার করুণগাঁথা রচনা করেন তখনই সবাই সেই ডুবে যাওয়া মহাদেশটির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে। ১৯০৯ সালে দ্যা টাইমসে প্রত্নতাত্ত্বিক কে.টি. ফ্রস্টের আটলান্টিস বিষয়ক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি দাবী করেন আটলান্টিস সভ্যতাটা গড়ে উঠেছিল দ্যা মেডিটেরিয়ান আইল্যান্ড অফ ক্রীটের প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির উপর ভর করে। আর কি চাই বলুন...... এভাবেই ফ্রস্টের সংস্কৃতি বিষয়ক ব্যাখা আর ডোনেলির ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে আটলান্টিস হয়ে উঠতে থাকে মায়া......ইনকা... সভ্যতার মত অতিবাস্তব একটা বিলুপ্ত সভ্যতা।
আটলান্টিসের গল্প
অনেক আলোচনা হল আসুন এবার সংক্ষেপে মিথটা বলি...... এক দেশে এক রাজা ছিল...... অহু...... না না ...... এভাবে তো গল্পটা বলা যাবে না...... কারণ কোন একক রাজা রাজত্ব করত না আটলান্টিসে বরং একটা কনফেডারেসনের মাধ্যমে চলত দেশটার শাসন ব্যবস্থা। বিশাল আটলান্টিয়ান সেনাবাহিনী পাড়ি দিল আটলান্টিক মহাসাগর লক্ষ্য ইউরোপ এবং এশিয়া। তাদের এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এথেনিয়ান্সরা গঠন করল এক বিশাল কোয়ালিশন বাহিনী। কোয়ালিশন বাহিনী মুখোমুখি হল আটলান্টিয়ানদের। পদে পদে পযুর্দুস্ত হতে হতে তরুপের তাসের মত উড়ে গেল কোয়ালিশন বাহিনী। একে একে ইউরোপ-এশিয়ার অনেক দেশ কুক্ষিগত করে ফেলল আটলান্টিয়ানরা। কোয়ালিশন বাহিনী ভেঙ্গে গেলেও জেদী এথেনিয়ান্সরা পণ করেছিল ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদেনী’। মরনপণ লড়াই করে চলল তারা লক্ষ্য নিজ দেশকে এবং আটলান্টিয়ানদের কবল থেকে অন্য দেশগুলোকে নিজেদের দখলে নেওয়ার। অবশেষে জয় হল সাহসীদেরই। তারা আটলান্টিসও দখল করে নিল।
তাদের জয়ের অল্প সময়ের মধ্যেই ( মহানুভব এথেনিয়ান্সরা আটলান্টিয়ানদের রাজ্য তাদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরত আসার আগেই) মহাদেশটিকে ধাক্কা দিল ক্যাটাস্ট্রপিক ভূমিকম্প এবং জলোচ্ছ্বাস...... ডুবে গেল একটি আস্ত মহাদেশ।
আপনাদের সেই সোলনের কথা মনে আছে নিশ্চয়...... তাঁরও আটলান্টিস নিয়ে একটা গল্প ছিল। এখন সেটা বয়ান করি......
সোলনের মতে আটলান্টিসের ইতিহাস সূচনা হয় পৃথিবীর শুরুর দিকে। এটা সে সময় যখন পৃথিবীতে বিচরণ ছিল অমর দেবতাদের। তাঁরা সমগ্র পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন। দেবতা পসেডিয়ানের ভাগে পড়েছিল আটলান্টিস, যে ভুখন্ড কিনা লিবিয়া এবং এশিয়ার মিলিত ভূখন্ডের চেয়েও বৃহৎ ছিল। তিনি স্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন একজন সাধারণ মানবীকে নাম ক্লিয়েটো এবং এই ক্লিয়েটোর মাধ্যমেই পত্তন ঘটে আটলান্টিসের রাজপরিবারের।
দেবতা পসেডিয়ান তাঁর প্রিয়তমা পত্নী ক্লিয়েটোর জন্য দ্বীপের ঠিক মাঝখানে পাহাড়ের উপর গড়েন এক সুরোম্য অট্টালিকা। সেই অট্টালিকাটিকে সুরক্ষিত করার জন্য তিনি ওটার চারপাশে গড়ে তোলেন পাঁচটি জল ও স্থলের চক্র। সৃষ্টি করলেন উষ্ণ এবং শীতল পানির ঝরনা। অর্থাৎ ভবিষ্যত নগরায়নের সব ব্যবস্থা তিনি সম্পন্ন করে রাখেন।
ক্লিয়েটোর সুরক্ষিত অট্টালিকা
ক্লিয়েটোর কোল আলো করে আসে দেবতা পসেডিয়ানের পাঁচ জোড়া সন্তান। এটলাসকে, যিনি ছিলেন প্রথম জোড়ার প্রথম জন, তার পিতা এ সমগ্র ভূখন্ডের রাজা হিসেবে নিয়োগ করেন। তাঁর অন্য সন্তানেরা হন রাজকুমার এবং তাদেরকে দ্বীপটির বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটলাসেরো অনেকগুলো সন্তান ছিল এবং রাজমুকুট বংশ পরম্পরায় জেষ্ঠ্য সন্তানের মাথাতেই উঠত।
বহু বছর ধরেই আটলান্টিসের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং উন্নয়নশীল। অধিবাসীদের অধিকাংশ চাহিদাই দ্বীপের খনি, চাষের জমি এবং বন থেকেই মিটে যেত। অবশিষ্টাংশ রপ্তানী হত দ্বীপটির বাইরে থেকে।
দেবতা পসেডিয়ান আটলান্টিসের জীবনযাত্রাকে সুশৃঙ্খল জন্য কিছু আইন তৈরী করেন। কোন একক শাসক নয় বরং দশ জনের এক শাসকগোষ্ঠি পরিচালনা করত এই দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে (এটলাস এবং তার বাকি নয় জন ভাই, যারা পরাক্রমশীলতার সাথে রাজত্ব করেছিলেন)। শাসকচক্রের সব সদস্য নিয়মিত মিলিত হত দেবতা পসেডিয়ানের মন্দিরে। সেই প্রাচীন বৈঠকের শুরুতে তারা একে অপরকে সম্ভাষন করতেন। তারপর একটি তেজী ষাঁড়কে ধরে প্রথমে সেটাকে হত্যা করে রক্ত সংগ্রহ করা হত এবং পরবর্তীতে ষাঁড়টিকে স্বর্গের দেবতাদের উদ্দেশ্যে পুরানো হত আগুনে । ষাঁড়ের রক্ত ওয়াইনের সাথে মিশিয়ে কিছুটা ছিটানো হত আগুনের উপর। আর বাকি ওয়াইনের স্থান হত দশটি স্বর্ণ পাত্রে। প্রত্যেকে সেই পাত্র আগুনের সামনে উচিয়ে পিতৃদেব প্রদত্ত আইন সঠিকভাবে পালনের শপথ করতেন। শপথ গ্রহণ ও পাণীয় পানের পর স্বর্ণ পাত্রগুলো উৎসর্গ করা হত মন্দিরে।
সর্বশেষে থাকত এক প্রীতি নৈশ ভোজ যেখানে দ্বীপের অধিকর্তারা পসেডিয়ানের আইনানুযায়ী রাজ্য পালনের কর্মপন্থা ঠিক করতেন।
এভাবে ভালই কাটছিল দিন। বিচক্ষণ পসেডিয়ানের প্রদর্শিত পথে আটলান্টিস হয়ে উঠছিল স্বর্গের জন্যেও ঈর্শনীয়। কিন্তু পসেডিয়ানের বংশধরদের রক্তে যে মানুষেরও সংমিশ্রণ ছিল... আর মানুষ যে ভুলেরই সমার্থক। তারা যখন ধীরে ধীরে পসেডিয়ানের নিয়মকানুন ভুলে যেতে বসল তখনই শুরু হল বিপত্তি। বেশির ভাগ শাসকই সাধারণ মানুষকে বিয়ে করল...... তাদেরর আচরণ হয়ে উঠতে লাগল নির্বোধের মত। তাঁরা দেবতাদের কথা ভুলে হয়ে উঠতে লাগল স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতালোভী......... লালায়িত হতে লাগল আরো বৃহৎ ক্ষমতার জন্য।
দেবরাজ জিউস উপর থেকে সবই পর্যবেক্ষণ করলেন...... দেখলেন কিভাবে মানুষেরা কিভাবে দেবতাদের অনুশাস্ন ভুলে হয়ে উঠেছে শয়তানের দাস। অলিম্পাসে বসল দেবতাদের বৈঠক আর ঘোষিত হল আটলান্টিসের ভাগ্য......... এরপরের ইতিহাস সবারই জানা......
অবশেষে
আমার লেখাটা আর বড় করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা অবশিষ্ট নেই। হয়ত অনেকেই বলবেন কয়েকদিন আগেই আটলান্টিসের অস্তিত্বের স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বাহামা দ্বীপ পুঞ্জের কাছে…... সমুদ্র তলদেশে আভাস মিলছে ডুবন্ত এক নগরীর...... সেটা কেন উল্লেখ করছি না। তাদের জন্য এটুকু বলতে পারি এই যান্ত্রিক অবিশ্বাসের যুগে আমার মনটাও কিছুটা হলেও সন্দেহপ্রবণ। পশ্চিমা বিশ্বে এসব বিষয়কে পুঁজি করে চলে মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য...... হতে পারে সেটা অর্থলিপ্সু কোন গোষ্ঠির কূটচাল...... কারণ অনেকেই বাহামার প্রমাণ টিকে ভুয়া বলেছে (বিখ্যাত সান পত্রিকা এদের মধ্যে অন্যতম)। তাই আমার মনও ঐ ব্যাপারটা উল্লেখ করতে সায় দিচ্ছে না। এ লেখাটাতে পাঠক না হয় ইতিকাসেই অবগাহন করলেন...... ভবিষ্যতে হয়তো বা বর্তমানের মতবাদ নিয়ে লিখব ( এ ব্যাপারটাই আমার বর্তমান জ্ঞান খুবি কম...... সত্যি না মিথ্যা বুঝতে পারছি না...... আরেকটু জেনে না হয় লিখব)।
ধারণা করা হয় এ জায়গার আশেপাশেই ছিল আটলান্টিস
ডুবুরীটা কি সেই হারানো শহরে