সাদা পর্দা গুলো সরিয়ে সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পর একটা রুম থেকে পূর্ব বের হয়ে আসল। তানিশা পূর্ব কে দেখে অবাক। পূর্ব তানিশাকে দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তানিশা হেসে বলল কেমন আছো? পূর্ব কেমন আছোর উওর না দিয়ে তানিশার হাত ধরে তাকে খাটের কোণে নিয়ে বসিয়ে দিল। পূর্বের মা কাছে এলো। গল্প জমে উঠলো তাদের মাঝে। এমন সময় একটা ছেলে উপস্থিত হল আর তানিশা তার সাথে কথা বলতে শুরু করে। প্রচুর কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। হঠ্যৎ করে তানিশা ছেলেটার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে এটা পূর্ব না। তানিশা একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। তার মানে পূর্ব তাকে পরীক্ষা করছে? পূর্ব এমন মানুষ যে কি না অন্য কে বাজিয়ে দেখে! তানিশা একটা ধাক্কা খায় নিজের মধ্যে,পূর্ব কে খুঁজতে লাগল। এক রুম থেকে আরেক রুমে, দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা। ওর সব কিছু ভেঙ্গে চুড়ে আসছে। কিন্তু ছেলে টা তানিশা কে ছাড়ছে না, বার বার বলতে লাগলো আমি পূর্ব, তুমি ভুল করছো, আমার দিকে দেখো তানিশা। ছেলে টা এবার তানিশার হাত ধরে রাখলো আর বলতে লাগল আমি পূর্ব ভালো করে দেখো, আমার চোখের দিকে তাকাও। কিন্তু তানিশা ছেলেটার দিকে তাকালো না। চোখের দিকে তাকে যদি সে হেরে যায়, যদি পূর্ব কে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলে। বরং চোখ বন্ধ করে নিজের হাত টা কে জোরে টেনে টেনে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। ছেলেটার হাতে তার নখ দিয়ে খামচে খামচে রক্ত বের করে ফেলেছে। কিন্তু ছেলে টা কিছুতেই তানিশার হাত ছাড়ছে না। তানিশা পাগলের মতো ছুটে গেলো পূর্বের বোনের কাছে। বোনকে বলতে লাগল, তোমার ভাইয়া কোথায়? তাকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না,তাকে খুঁজতে হবে আমার সাথে চলো। পূর্বের বোনকে নিয়ে পূর্ব কে খুঁজতে তানিশা যখনি অন্য একটা রুমে দরজা খুলতে লাগলো। দেখতে পেলো দরজার ওপ্রান্তে পূর্ব দাঁড়িয়ে আছে। তানিশার দিকে তাকিয়ে আছে। তানিশা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। পূর্ব কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তানিশা সবচেয়ে ভয় পায় বাজিয়ে দেখা, ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলা। চোখ বন্ধ করে কাঁদতে কাঁদতে তানিশা যখন চোখ খুললো দেখলো ঐ ছেলেটা পাশে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা যে পরাজিত তার মুখ দেখে বুঝতে পারছে তানিশা এবং তানিশা যে পরীক্ষায় পাস করেছে এটাও সে নিশ্চিত! তানিশার চোখের পানি পূর্ব মুছে দিতে লাগলো আর বলতে লাগল-তুমি এত ভালো কেন? তানিশা মাথা নাড়িয়ে বলল- আমি তোমাকে হারাতে চাই না!
তানিশার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওর ভিতর টা এখনো ধকধক করছে। কি স্বপ্ন দেখল এটা ভাবতে লাগল। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে এতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে বিছানায় হেলান দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজকে সারা দিনেও
পূর্বের সাথে কথা হয়নি। ভোরে একবার কথা হয়েছিল কিন্তু ঘুমের ঘোরে কি বলেছে কিছুই মনে নেই। মানুষ টা যে কেমন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া তা কেউ জানে না, বোঝা দূরে থাক। তানিশা মনে মনে ঠিক করল। স্বপ্নের কথা টা যে করেই হোক আজ পূর্ব কে সে বলবেই বলবে। স্বপ্নের কথা জানাতেই অতি উচ্ছ্বাসের সাথে পূর্ব কে ফোন করল সে!
তানিশা আর পূর্বের মধ্যে কথোপোকথণ
তানিশা-একটা গান শুনবা?
>কি গান?
-শুনো না।
>আচ্ছা বললো।
-ওকে শুরু করছি
......নিঝুম রাত অথবা ব্যস্ত দিন,
তুমি ছাড়া পৃথিবী অর্থহীন।।
তুমি ছাড়া চারিদিক অথৈ অন্ধকার
তুমি প্রথম তুমি আমার......
নাহ গান টা গাইতে আর ইচ্ছে করছে না।
>কেনো কি হয়েছে? ভালোই তো হচ্ছিল।
-না ভালো হচ্ছিল না। আসলে মুড নষ্ট হয়ে গেছে।
>তোমার আবার মুড আছে না কি? জানা ছিল না।
-কেন? আমার কি মুড থাকতে পারে না?
> অনুভূতি আছে কি না সন্দেহ! আর কি অবস্থা বলো।
-এই তো চলছে। শোন আজকে সন্ধ্যায় না বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা স্বপ্ন দেখেছি।
পূর্ব একটু উত্তেজিত হয়ে বলল-ও তোমাকে তো বলা হয়নি।
তানিশা একটু অস্থির হয়ে বলল- কি হয়েছে?
>আজ মৌ-য়ের সাথে প্রায় ৩ ঘন্টার মতো কথা হলো।
কথা টা শুনে তানিশা চুপ হয়ে গেলো। একটু পর আস্তে করে বললো- আচ্ছা!
>ও তো পুরা আমার জন্য পাগল। কি বলেছে জানো?
তানিশা শান্ত গলায় বলতে থাকল- একটু পর আমার লাইন কেটে যাবে মনে হয়। ব্যালেন্স শেষ হয়ে এসেছে। ভালো থেকো, পরে কথা হবে,শুভ রাত্রি।
>ওহ ব্যালেন্স শেষ! কি করার তুমিও ভালো থেকো। আর মৌর কথা তো বলা হয় নি। আমাকে বলে কি না...
লাইন টা কেটে গেলো।
লাইন কেটে যাওয়ার পর তানিশার মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করতে লাগল। খুব ভালো করে জানে কেন এই খারাপ লাগা কিন্তু কিছু করার নেই। নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেস্টা! তানিশা ঘুমানো চেস্টা করছে, কিন্তু ঘুম? ঘুম তো আসছে না তার। মোবাইলের ইনবক্সে গিয়ে পূর্বে-র পাঠানো ২ টা ক্ষুদে বার্তা বার বার দেখছে। পূর্বে-র নম্বরে ট্রাই করছে। জানে কল যাবে না তবুও সে বার বার চেস্টা করছে। একটু পর নিজের সাথে কথা বলতে শুরু করল তানিশা-
জানিস টুশি কিছুই ভাল লাগছে না, ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চারপাশ। কিছু কষ্ট আছে যা লুকিয়ে আছে নীল-লাল-হলুদ-সাদা খামে। আজ চারপাশে কেউ নেই ঠিক তুই ছাড়া। অনেক বছর পর পেয়েছি এই সময়। আজ দুঃখী মনে হচ্ছে, আজ নিজের কষ্টের কাছে অন্যের কষ্ট টা তুচ্ছ মনে হচ্ছেরে টুশি। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না,ওদের কারো তা বোঝার ক্ষমতাও হলো না। জানিস টুশি পুরোনো দিন গুলো খুব ভালো ছিলো। আর আজকের দিন গুলো খুব নিষ্ঠুর! আজ কারো সময় নেই কাউকে বোঝার, চুপ করে কথা শোনার। আমাদের জীবন টাই এমন হয়ে গেছে। টুশি তুই কি আমাকে ভুল বুঝিস? আমি ও তো একটা মানুষ তুই বল, আমার মাঝেও তো আবেগ অনুভূতি থাকে। আমার ভিতরের এই কটা জিনিস কারো চোখে কোন দিন ধরা পড়বে না,যদি কোন দিন ধরা পড়ে তাহলে এত টুকু নিশ্চিত আমার প্রতি তার যদি কোন ভুল ধারনা আসে তাহলে তা দূর হয়ে যাবে।
তবে সমস্যা একটা যায়গায় যখনই দূর হবে তখন আর সময় থাকবে না! কিসের সময় তাও বলে দেই তোকে; আমাকে বলার, আমাকে ধরার অথবা ফিরে পাওয়ার। টুশি আমি আমার ভাগ্য কে মেনে নিয়েছি। এমন টা হবে যে,তা আমি প্রতিটি ক্ষন বিশ্বাস করতে শিখেছি। নিজস্ব ভুবনে কথা বলতে বলতে তানিশা ঘুমিয়ে পড়ে নতুন দিনের জন্য.......
প্রতি দিনে মতো সকালে ঘুম ভাঙ্গলে কিংবা ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে অথবা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে পূর্ব এর আর খোঁজ নেয় না তানিশা। পূর্ব ও খোঁজ করেনি। কেন করেনি তাও তানিশার জানতে ইচ্ছে করে না। মনে প্রাণে চেয়ে গেছে যেখানেই থাকুক যেভাবে থাকুক যাতে খুব ভালো থাকে পূর্ব। নিজের ব্যস্ততার মাঝে ডুব দেয় সে। এক মাস পর পূর্বের ফোন। তানিশা দেখেও ধরে না। ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন বেজে চলছে। অস্থির করে দেওয়ার মত অবস্থা। নিজের মন কে খুব শক্ত করে তানিশা ফোন টা ধরল। পূর্ব তার মতো করে রসিকতা করে গেল। নিজের এই কয় দিনের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে অজুহাত দিতে শুরু করল আর বার বার ফোন না ধরার কারণ জানতে চাইল। তানিশা এবার রেগে গিয়ে পূর্বের সাথে ঝগড়া করল এবং জানিয়ে দিল আর কখন যাতে তাকে বিরক্ত না করে, বলেই ফোন রেখে দেয়।
পূর্বের জীবনে অনেক মেয়ে আসে আর যায় তার ফাঁকে ফাঁকে তানিশা তার মনে নাড়া দিয়ে যায়। পূর্বের কখনই জানা হয়নি তার কি দোষ ছিল কেন তানিশা এমন করল। প্রচুর কৌতুহল জাগে, একটু ফোন করে তার কন্ঠ শুনতে ইচ্ছে করে এমন আহামরি মেয়ে তানিশা না হলেও তার মধ্যে অসাধারণ কিছু একটা আছে। জীবনের একটা মুক্তি সে তার কাছ থেকে পেয়েছে যার জন্য তাকে অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাঁটিয়ে দিতে হয়েছিল। সেই ক্ষতের মুক্তি পেলেও তানিশা কে যে অন্য বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে তা পূর্ব দিনের পর দিন টের পাচ্ছে। খুব বেশি করে.....
মিষ্টি রোদের হাসির মাঝে নিষ্ঠুরতা এসে হাজির। টানা বর্ষণ আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ। চারপাশ একসময় নিরব,ভেজা শ্যাওলার গন্ধ! প্রানবন্তো কে খুঁজতেই বোধ হয় কালো মেঘ সরিয়ে সাদা মেঘ কে আমন্ত্রণ জানায়। কাশবনে হারাতে চায় হেমন্ত। কিন্তু একটা সময় বেড়ে ওঠা বৃক্ষ যেনো ঘুমিয়ে পড়ে। ঝিমিয়ে ঝরে পড়া পাতা গুলো বাতাসে মড় মড় শব্দ করে উঠে। শীতের সকালের শিশির একটু হলেও ভিজিয়ে দেয় শুকনো পাতাকে!
অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে বৃক্ষ কোন নতুন আশা নিয়ে বসন্ত আসবে বলে......
আর তানিশা!
পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে, কি ভাবছে মনে মনে?
জানিস টুশি সময় টা এখন ভোর। চারপাশে কেউ নেই, আছে শুধু বাতাস আর পাতার শব্দ। পানিতে পা ভিজিয়ে রাখতে রাখতে আমার পা দু'টা খুব নরম হয়ে গেছে। আর দেখে কি মনে হচ্ছে জানিস পায়ের সব জীবানু আলগা হয়ে গেছে আমি একটু হাত দিয়ে ঘষে দিলেই এক দম নতুন হয়ে জেগে উঠবে চামড়া গুলো! জানিস আমি জানতাম ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় হোক উল্টো ভাবে আর সোজা ভাবে। টুশি এতো বছর পর আমার কি মনে হচ্ছে জানিস, স্বপ্ন বাস্তবে বিপরীত হয়ে দাঁড়ালেও সেই সন্ধ্যার স্বপ্ন টাই সত্যি হয়েছিল। বাজিয়ে দেখার শেষ কার্ড টা আমার হাতেই ছিল! পানিতে মুখ ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো তানিশা,ভেজা মাটির ঘ্রান নিল মন ভালো করা নতুন দিনের জন্য!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২২