কত কত হাসির ঘটনা ঘটে আমাদের দেশে। কেউ পা পিছলে পড়ে গেলে হাসি পায়। নতুন নতুন মানুষজন ছয় দফা দাবি দেয়। তা দেখে আবারও হাসি পায়। ফাঁসে ফাঁসি পড়ে পিপড়ে/ফড়িং/শরষে ফুল/দোয়েল- সাথে কয়েকফোঁটা সূর্যমুখীর কান্না। পরিকল্পনা’র ফাঁসে পড়ে শহরবাসী। উন্নয়নের ফাঁসে পড়ে দেয়ালফাঁটা শ্বাসে ট্রাফিকজ্যামে কাটে দিনের দীর্ঘভাগ। কেটেও বলে কাটি নি/ মেরেও বলে মারি নি/ ধরেও বলে ধরি নি/ রক্ত মেখেও বলে রঙ মেখেছি- আর দুধে ধোঁয়া অপাপবিদ্ধ পরিচয়ধারীগণের সকাল-সন্ধ্যা আরতি হয় রাস্তায়, সদরে, ভাগাড়ে আর নক্ষত্রে। সত্যের জল টলমলিয়ে ওঠে, লজ্জা পেয়ে মুখ লুকায়। কি নগন্য শংকট আমাদের! সিগারেটের ধোঁয়ার মত চাইলেই ওড়ানো যায়, হারানো যায়। যে পাপে খুনিরা খালাশ পায়, সে পাপে উত্তরায় গড়ে ওঠে স্কুলবালকদের গ্যাং। ওরাও ভবিষ্যৎ! ওরাও অন্ধকারের রূপভেদ। আকাশে ভেসে ওঠে লাল-নীল রঙ্গের স্বপ্ন, সাথে পাঁচ লক্ষ টাকা। প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িতদের ধরিয়ে দিলেই পাঁচ লক্ষ টাকা! কোথায় আসবে? পকেটে? ব্যাংক একাউন্টে? আমি যদি কোন প্রশ্নফাঁসকারিকে ধরিয়ে দেই, আমি কি পাঁচ লক্ষ টাকা উপহার পেয়ে বেঁচে থাকতে পারব? এই পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পাঁচ লক্ষাধিক বিষাক্ত তিরের লক্ষভেদ কেউ সামলাতে পারবে? যেখানে ক্ষমতাই শেষ কথা, যেখানে অস্ত্রই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত- সেখানে পুরস্কারঘোষণা হাস্যকর- রূপকথার গল্পের মত মোহময়।
একসময় এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান শত্রু ছিল নকল। একটা সময় আমরা সেটা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলাম। আবার তা ফিরে এসেছে। অনেক ভয়াল তীক্ষ্ণ নখর নিয়ে। পরিত্রাণের উপায় এখনও ধোঁয়াশায়। সরকারে দায়িত্বশীলগণ এতদিনে স্বীকার করছেন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ছাত্ররাজনৈতিক নেতাবৃন্দ অবশ্য সেটুকুও মানেন না। বলে থাকেন- দেশের কোথাও কোন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস হবার এসব কথা বলে তারা গুজব ছড়াচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ নিয়ে এর আগেও কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্তদের দারস্থ হয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন গুজব ছড়ানোর জন্য তিরস্কার আর হুমকি। এই সমাজেই তো আজ সেই পুরস্কারের ঘোষণাটি এসেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস কারা করে বা কিভাবে হয়- বিষয়গুলো কারও অজানা নয়। অথচ না চেনা বা না জানার মর্মান্তিক অভিনয় কত শত কালো মেঘের মত বিষাদ ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছেন। তারা ভাবছেন- শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে! এই ভাবনা-চিন্তা গুলো আবেগতাড়িত। অবাস্তব। অপরিকল্পিত। পরপর দশজন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেও পরিস্থিতি একই থাকবে। ফেইসবুক বন্ধ করলে টুইটারে ফাঁস হবে, টুইটার বন্ধ করলে হোয়াটস্ অ্যাপে ফাঁস হবে। মাথায় দু’ই মগ ঠান্ডা পানি ঢেলে নিলেই বোঝা যাবে যে- পুরস্কার ঘোষণা, মন্ত্রীর পদত্যাগ, কিংবা ফেইসবুক বন্ধ- এগুলো একটিও ফাঁসের ফাঁসি বন্ধের উপায় না। নিরাপত্তা পুণর্গঠনের কোন শেষ নেই। নিরাপত্তার জগতে কাঠামো’র পর কাঠামো গড়ে ওঠে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন- প্রশ্নপত্র ফাঁসের চেষ্টা করলে ’কঠিন’ শাস্তি। এই কঠিনের সংজ্ঞা কি? প্রশ্নপত্র ফাঁসকারিদের বিরুদ্ধে নতুন ভাবে আইন প্রয়োগের ব্যাপারে বিতর্কিত পত্রিকা ‘দৈনিক আমার দেশ’ থেকে জানা গেল-
“ …১৯৯২ সালের ৬৭ ধারায় প্রশ্নফাঁসের শাস্তি ও জরিমানা হিসেবে যা বলা ছিল তাই রাখা হয়েছে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করলে অথবা এই কাজে জড়িত থাকলে বা সহায়তা করলে তিনি সর্বোচ্চ চার বৎসরের সশ্রম কারাদ- অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবেন। ১৯৮০ সালের ‘দ্য পাবলিক এক্সামিনেশনস (অফেন্স) অ্যাক্ট’-এ প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ১০ বছরের শাস্তির বিধান ছিল। ১৯৯২ সালে তা সংশোধন করে সাজা চার বছর করা হয়। তবে ১৯৮০ সালের এ সংক্রান্ত আইনে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ১০ বছরের শাস্তির বিধান ছিল।”
যদিও বা চার বছরের এই সাজা হাস্যকর ব্যাপার, তারপরও সেটা একটা সাজা। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ কোথায়? আজ পর্যন্ত কোন অপরাধীটি পশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধে এই সাজা পেয়েছেন? ‘একশ আটটি নীলপদ্ম এনে দেব’- যা কবিতায় বলা তুচ্ছ।নীলপদ্ম খুঁজে পাওয়াটা ততটাই কঠিন, এনে দেয়া আরও অসম্ভব। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, পরিবারতান্ত্রিকতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের আস্ফালন, আমলাদের স্বর্গভূমি প্রিয় বাংলাদেশ এখন নাকি ‘সব সম্ভবের দেশ’। শিক্ষামন্ত্রী কি করবেন? কতদূর যাবেন? স্বজনপ্রীতি/ স্বদলপ্রীতি যদি চিরস্থায়ী হয়- তবে প্রশ্নফাঁসও চিরস্থায়ী হবে! প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে যদি খালাস পাওয়া যায়- তবে প্রশ্নফাঁস আরও অনেক যুগ বেঁচে থাকবে। জেগে থাকা ছলনাময়কে ঘুম থেকে তোলা যায় না। দেশের পতাকা তবুও উড়বে- যতদিন বাতাস থাকবে!