পৃথিবীর প্রত্যেকটি সচেতন নাগরিক যে মুহূর্তে অং সান সু চি কে ধিক্কার জানাচ্ছে, ঠিক সেই সময়টিতে আমি মিয়ানমারের রাজনৈতিক অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করেছি। এর ফলে উঠে এসেছে কিছু অনুভূতি আর কয়েকটি প্রশ্ন। বলা বাহুল্য, আমি আমার বিচারটিকে যথাসম্ভব নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেছি।
অং সান সু চি মোটামুটি ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন। বন্দীদশায় একাকী ঘরে বসে বসে তিনি পিয়ানো বাজাতেন। অর্থাৎ, তিনি সঙ্গীত ভালোবাসেন। পরিবারজীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সব ত্যাগ করেছেন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে। চাইলেই তিনি বন্দীদশা থেকে মুক্ত হতে পারতেন, দেশের বাইরে চলে যেতে পারতেন স্বামী-সন্তানদের দেখতে। কিন্তু এর ফলে তাঁর মিয়ানমারে পুণরায় ফেরত আসার কোন সম্ভাবনা ছিল না, অর্থাৎ তাঁকে ফেরত আসতে দেয়া হত না। গণতন্ত্রের প্রয়োজনে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন পরিবারজীবন, শিকার হয়েছেন জীবনঘাতি হামলার। অং সান সু চি যেন গণতন্ত্রের মানসকণ্যা। তাকে দেখেই যেন অত্যাচারিতরা সাহস পায়, সামরিক জান্তা’র বুকে জমে ভয়। ১৯৮৯ সালের এক প্রবন্ধে সু চি লিখেছিলেন- “It is undeniably easier to ignore the hardships of those who are too weak to demand their rights than to respond sensitively to their needs.”
এর থেকে আশ্চর্য বিষয় আর কি হতে পারে? সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের এই কিংবদন্তী নেতা কি করে একেবারে নিজের দেশেই সহ্য করছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা’র মৃত্যুচিৎকার? অধিকন্তু অস্বীকার করছেন রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিকতার প্রকাশ্য সত্যগুলোকে। বলছেন, এসবই নাকি মিডিয়া বাড়িয়ে বলছে! মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কোন সাংবাদিকের প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে কোন ক্যামেরা যায় না। সেখান থেকে খবর সংগ্রহের দৃশ্যত কোন উপায় নেই। তবে গুগলের স্যাটেলাইট ভিউ থেকে কয়েকটি গ্রামের বিধ্বস্ত অবস্থার প্রমাণ মিলেছে। নাক্ষ্যাইংছড়ি’র সীমান্ত এলাকায় দূর পাহাড়ের ওপারে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় অত্যাচারের ধরণ, প্রকৃতি। সেই সব অত্যাচারের বিবরণ শুনলে আমাদের ৭১’এর কথা মনে পড়ে। একটি সাজানো-গোছানো জনপদের উপর পাকিস্তানি সেনারা যেমন অতর্কিত আক্রমন করে রক্তে ভেজাতো বাংলার মাটি, ঠিক একই রকম সহিংসতা, অত্যাচার, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের খবর ভেসে আসছে রাখাইন থেকে। UNHCR এর ফেব্রুয়ারি মাসের রিপোর্টে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া একজন রোহিঙ্গা বালিকার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। ’বালিকা’ বলছি, কারন তার বয়স ১১ বছর। বালিকাটি বলেছিল-
“… The next time the military came, there were eight to 10 of them, they were asking where my father and sisters were. They were also saying that they were searching for people from Bangladesh. They removed all my clothes and all my mother’s clothes and kicked us with their boots. Then they left. I do not know why. But the next day they came again. This time there were seven of them. They dragged my mother outside the house and locked themselves in the room with me. I do not know if they all abused me, I lost consciousness at some point. My mother woke me up with water. I was bleeding a lot.”
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অসহায় মানুষরা হেঁটে হেঁটে ভারতীয় সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন, নদীতে ভেসেছেন অসংখ্য দিন-রাত। ঠিক একই বিভীষিকার ছায়া দেখতে পাই রোহিঙ্গাদের উপর। তারাও ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রাণের ভয়ে ছুটছে, দলে দলে ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। সাম্প্রতিক ঘটনায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী যখন জীবনরক্ষার আবেদন নিয়ে দুয়ারে ভিক্ষা চায়, তখন তাদেরকে পুরোপুরি আটকে রাখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা একচাকার রথের মত। সবাই জানে, সেখানে এখন গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে। কিন্তু খুব বেশি মানুষ জানে না যে, তাদের সর্বশেষ ২০০৮ এর সংবিধানে সেনাসদস্যদের জন্য পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে!এখানেই শেষ নয়, মিয়ানমারে জরুরী অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডর-ইন-চিফ কে। অর্থাৎ আমরা যতই চিৎকার করি না কেন যে মিয়ানমার সেনাশাসন থেকে মুক্ত হয়েছে, আসলে তারা আজও মুক্ত নয়। অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সেই সংখ্যাগুরুদের স্বঘোষিত ‘বিন লাদেন’ হচ্ছেন ভিরাথু। তিনি ও তার অনুসারীরা মনে করে, রোহিঙ্গা নিধন পূণ্যের কাজ! তারা এই নির্মূলকাজ কে আপ্রাণ সমর্থন দিচ্ছে। তারা তাদের রোহিঙ্গানিধন আন্দোলনটির নাম দিয়েছে ’969 আন্দোলন’ যার নতুন নাম ’মা বা থা’। সু চি কে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে দু’টি দিক। একদিকে তিনি সেনাবাহিনীকে ক্ষিপ্ত করতে চান না, তাদেরকে আদরে আপ্যায়নে ভরিয়ে রাখেন। অন্যদিকে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালন তিনি ভয় পান। এই দুই ভীতির চাপে পড়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্র বা বাকস্বাধীনতার বেহাল দশা। আমাদের দেশের ৫৭ ধারার মত তাদের দেশেও আছে 66D clause, যা দ্বারা অনলাইনে আপত্তিকর কথা লিখলেই যে কাউকে পাঠানো যায় জেলে। ২০১৭’র শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩৮ জন এ আইনের শিকার হয়েছে সেদেশে।
দেশ চালাতে গিয়ে আর উভয়পক্ষের সাথে দর কষাকষি করতে গিয়ে ভেসে গেছে সু চি’র বৈশ্বিক ইমেজ। পৃথিবীর কাছে তিনি পরিণত হয়েছেন খলনায়কে। তাঁর নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেবায় দাবি উঠছে সচেতন মহল থেকে। অথচ সু চি নির্বাক, নিশ্চুপ। দিনের পর দিন রোহিঙ্গাদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে। আর তিনি শক্ত হাতে ধরে আছেন ক্ষমতার শেকল, সামলে যাচ্ছেন নদীর দু-কূল, আর পেছনে পড়ে থাকছে অসংখ্য লাশ।
আমরা চাইলেই এটা বলে দিতে পারি না যে, একাত্তরে বাংলাদেশ ভারতে আশ্রয় পেয়েছিল। তাই বাংলাদেশেরও উচিত বিপদগ্রস্থ রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের বর্ডার খুলে দেয়া। দু’টো বিষয় একেবারেই একরকম নয়। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে সুখে-শান্তিতে জীবন ধারন করছে না। বরং তারা যোগ দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদে। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় অস্ত্র, আসে মাদকের চালান। এই দুর্গম এলাকায় দুস্থ রোহিঙ্গারা চক্রান্তের ফাঁদে পড়ে হয়ে যাচ্ছে চোরাচালানকারী। কেউ কেউ পরিণত হচ্ছে ভয়ানক জঙ্গিতে। তার জন্য জঙ্গিগোষ্ঠী কোটি কোটি টাকা ঢালছে। এমনও কথা শোনা যায় যে, তাদেরকে হত্যা-অত্যাচার-নির্যাতন করে বাংলাদেশে আনাই হচ্ছে জঙ্গী বানানোর জন্য। যদিও বিষয়টি আরও অনেক গবেষণার দাবি রাখে।
বাংলাদেশর মত ছোট্ট পরিসরের দেশটি কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারে না। অধিকন্তু এটা কোন সমাধানও নয়। বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের জন্য বর্ডার খুলে দেয়, তাহলে মিয়ানমার আরও প্রশ্রয় পাবে। তারা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ, যেন সমস্ত রোহিঙ্গারা একসাথে চলে আসে বাংলাদেশে।
সমাধানটা হতে হবে কূটনৈতিকভাবে। বাংলাদেশ যেন মিয়ানমারকে শক্ত ভাষায় কিছু বলতেই পারছে না। যেন রয়েছে কোন এক জুজ’র ভয়। এত নরম কথায় কাজ হবে না। এত নতজানুতায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গানিধন বন্ধ হবে না। এ অন্তহীন সমস্যার স্পষ্ট কোন সমাধান আজও ভেসে ওঠেনি। বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারেই অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধরা আগুনে পুড়ছে, বন্দুকের সামনে প্রাণ দিচ্ছে। তীব্র অসহনীয় এক দৃশ্য এটি। আজ প্রয়োজন মানবতার সবক’টি মুখ একসাথে কথা বলার। পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলো থেকে মিয়ানমারকে চাপ দেবার।
আর আদর্শিক বা যৌক্তিক লড়াইটা একটু আলাদা। মিয়ানমারকে এটা মানতে হবে যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। তারা সেখানেই থাকবে। তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাবার অধিকার রাখে। আর দশটা মানুষের মত তারাও বাঁচার অধিকার রাখে। অসহায় জনগোষ্ঠীর উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞের মুহূর্ত একদিন শেষ হবেই। ইতিহাসে কখনও এর বিকল্প ছিল না।
পূর্ববর্তী পাঠ: রোহিঙ্গা সমস্যায় পৃথিবীর দায়