শেষরাতের স্তব্ধ শান্তি:
ভোর সাড়ে পাঁচটার পর নিথর হয়ে যায় বাড়িটি। থামে গোলাগুলি, জমে আতঙ্ক। পলাশীর প্রান্তর থেকে ধানমন্ডি বত্রিশ- শুধু চেহারাগুলো বদলায়, চরিত্র ভেসে আসে কালের পিঠে- বারেবারে। কেন হত্যা? কিভাবে হত্যা? রহস্য জড়ানো এপাড়ের কোলে, ওপারের স্পর্শে। হত্যার পর কেন হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়নি? জাতীয় নেতারা তখন ঠিক কি ভূমিকায় ছিলেন? অথবা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী এ জাতির বুকে কতবড় আঁচড়? পাকিস্তানি প্রেতাত্মা শকুনের মত ওড়াওড়ি করে বাংলার আকাশ জুড়ে। ওরা স্বপ্নে পোষে বাংলাস্তান। তবুও, সব কি প্রশ্নের উর্ধ্বে? স্বাধীনতাউত্তর দেশের রাজপথে শৃঙ্খলাহীন ছিল কারা? কেন চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ? কিংবা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেবপুরুষের রাজত্বে কেন বাকশাল? কেন ভারতীয় ছত্রছায়ায় রক্ষীবাহিনী? কেন রক্ষীবাহিনী ও সেনাবাহিনীর বৈষম্য, অসন্তোষ? রহস্যগুলো দুর্ভিক্ষের মত- দীর্ঘবছরের উত্তরশূণ্যতার মৃতপ্রায়। স্তব্ধ ঢাকার রাত, গড়গড় শব্দে এগিয়ে চলা ফারুকের গোলাহীন কামান, ভীতসন্ত্রস্ত জনপদ, আর খন্দকার মুশতাকের কাঁধে সমর্থন ঝোলাতে ব্যস্ত দেশের সেনা, নৌ, বিমান। বাঙালির আত্মহননের তীব্রতা দৃষ্টিসীমার ওপারে, ঠিক সেই রাতটুকু থেকে। তেজদীপ্ত অপারসাহসী যোদ্ধার মৃতদেহ নিরবে, নির্জনে ভূমিদেশে শায়িত। ব্যর্থতা কতটুকু এই বাঙালির? অভিযোগ অনেক- মুজিবের শাসনামলে জনজীবন অতিষ্ঠ? এর দায় কতটুকু তাঁর? অভিযোগ বলে- মুজিব দোষীদের শাস্তি দিতেন না। এই অপরাধ কতটুকু মুজিবের?
স্বাধীনতাউত্তর বাংলার জনপদ ছিল রাক্ষসে ভরা, আজও তা তেমনি। সেই রাক্ষসকূল নিরন্তর গুছিয়েছে নিজের সম্পদ, নিজের বাড়ি, নিজের রসদ। জন্মলগ্ন থেকেই এই জনপদ ধান্দাবাজ আর ধর্ষকে ছাওয়া। মুজিব কত লক্ষ লোককে একবারে খুশি করবেন? কতকোটি মানুষকে একসাথে হাসাবেন? দোষ কেন একা তাঁর? দোষের ভাগি তো গোটা ধান্দাবাজকূল, গোটা ধর্ষককূল। মেজর ডালিম, ফারুক- কেন ধান্দাবাজদের বাড়িতে আঘাত করেননি? কেন ধর্ষককূলদের আগে মারেননি? কেন আগে মুজিবকে মারতে হল?
লড়াইটা হতে হবে আদর্শিক। জেল-জরিমানা-হত্যায় আদর্শ মরে না। আজও বাংলার বুকে অসংখ্য তরুণ মনে ধারণা পোষণ করে- বঙ্গবন্ধুকে হত্যা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল! এই আদর্শের লড়াই বাংলায় আরও অনেকদিন চলবে। বাংলার জনপদ কোনদিন এককাতারে দাঁড়াবে না, এক থালায় খাবে না। বাংলায় দেবদূত সেই একবারই এসেছিল। বাংলা আরও অনেকদিন ভিজবে, এই মৃত্যুতে।
দ্বিচারী সত্তা:
কতদিন টিকেছিলেন খন্দকার মুশতাক? কিংবা কতদিন রাজবেশে ছিলেন মীরজাফর? বাঙালি এক শিক্ষা আর কতবার নেবে? রক্তমাখা আগস্ট থেকে ষড়যন্ত্রের নভেম্বর- প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে বারবার। পঁচাত্তরের সেনাপ্রধান ‘এস ফোর্স’ এর নেতা কে এম শফিউল্লাহর নিরব নিষ্প্রভ পদচারণ কি প্রশ্ন জাগায় মনে? তাঁর মৃত্যুতে কেন সেনাবাহিনীতে অজস্র ’কনগ্রাচুলেশনস্’ এর ছড়াছড়ি? সেনাবাহিনীতে এতদিনের তীব্র অসন্তোষ হয় বঙ্গবন্ধু একটুকুও বুঝতে পারেননি, অথবা তিনি বেঁচে ছিলেন মৃত্যুর প্রয়োজনে। যে তীব্র দেয়াল তিনি রচনা করে দিয়েছিলেন, যা ছিল হিমালয়ের মত দুর্লঙ্ঘ্য, তাঁর মহাপ্রয়াণে তা ধ্বসে পড়ে, ঘটে ক্ষমতাদখল, জেলহত্যা। বঙ্গবন্ধুর এ বড়ই রহস্য? সেনাবাহিনীতে এতবড় অসন্তোষ চলছে, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, অথচ তিনি কিছুই জানতেন না, তা অনেকাংশেই অবিশ্বাসযোগ্য। তবে কেন কোন ব্যবস্থা নয়? কেন নিজের নিরাপত্তা নয়? কেন একটি রাষ্ট্রপতিভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা এত নাজুক? কেন যে কেউ সহজেই উঠে যেতে পারত দোতালায়? মহানায়কের এ দ্বিচারীসত্তা আজও প্রশ্নবাণে বিক্ষিপ্ত, উন্মাদিত।
আরও অনেক মৃত্যুর প্রয়োজনে:
সেসময়ের বৈদেশিক কুটকৌশল উপেক্ষাযোগ্য নয়। বাংলাদেশ চীনের স্বীকৃতি পায় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে। আমেরিকার অসহযোগীতায় চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। বাংলার স্বাধীনতায় বিশ্ব চিরকালই একচোখা। আজও তাই। ভারত-রাশিয়ার প্রতিপক্ষ মানেই বাংলাদেশেরও প্রতিপক্ষ। একটি নতুন দেশে, যে-দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত, যে-দেশে আইন-শৃঙ্খলা ভূলুণ্ঠিত, যে-দেশ চরম মানবিক বিপর্যের ধার ঘেঁষে বেঁচে এসেছে- সে দেশের পরোক্ষ শত্রুরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কি? বঙ্গবন্ধু এখানে ছুটে বেড়ান, ওখানে গিয়ে আলোচনায় বসেন, একটুখানি বৈদেশিক সাহায্য হাতাবার কি নিবিড় প্রচেষ্টা তাঁর! এরই ভেতরে প্রবাহিত ছিল হিংসার ঝরণাধারা। পঁচাত্তরের আকাশ-বাতাস ভারি হতে থাকে আরও অনেক ক’টি মৃত্যুর প্রয়োজনে। সে মৃত্যুসভ্যতার সূচনায় লেখা আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। সে সারিতে ভাসছেন জাতীয় নেতারা, ভাসছেন মেজর জিয়া নিজেও। বাংলায় এই মৃত্যুপুরীর স্বাদ পূর্ণরূপে পেয়েছিল বিতাড়িত রাজাকারেরা, বিকৃত পাকিস্তানিরা। আমাদের বিশ্বাসঘাতক সত্তা হিংস্র পশুদের এনে দিয়েছিল উল্লাসবার্তা। সে ইতিহাস আজও ভাসে, বারবার উঠে আসে- অজস্র মৃত্যুর প্রয়োজনে সেদিন বঙ্গবন্ধু হারিয়েছিলেন, বাঙালির চিরদাসত্ব আরও একবার চিনিয়ে দিতে তিনি ভূলুণ্ঠিত হয়েছিলেন। শ্রাবণের আকাশ কোনদিন মিথ্যে বলেনি। পাপসভ্যতার এ জনপদ আজও মুক্ত হয়নি। মৃত্যুর প্রয়োজন আজও থামেনি।