আমি মাঝে মাঝে সন্ধ্যার আকাশে চোখ দেই। এটুকু আমার কখনও খারাপ লাগে না। আমি মাঝে মাঝে অন্ধকারে হাঁটি, জীবনানন্দের দর্শন বোঝার চেষ্টা করি। বর্ষার আকাশ ঢাকা শহরে বিভীষিকা হলেও বিচিত্র কারনে আমার ভালো লাগে। নর্দমার জল মাড়িয়ে হাঁটতে হয়, দীর্ঘদিন এভাবে চললে পায়ে ঘা হয়, চর্মরোগ হয়। তবুও শান্তনা, আর কিছু না হোক, আকাশ থেকে তো বৃষ্টি পড়ছে, এ কি কম!
আমি আমার প্রিয়াকে ষোড়শ সংশোধনীর রায় শুনিয়েছিলাম। তারপর আমরা ঢাকা শহরের জলাবদ্ধ সড়কে হাতে হাত রেখে হেঁটেছিলাম। আমার বর্তমান অবস্থাটা আমেরিকার গুয়াম দ্বীপের মত। হামলার মুখে বসে আছি। পারমানবিক সহিংসতা ধেয়ে আছে উত্তর কোরিয়ার আকাশ থেকে। আর আমার শহরের উত্তরমন্ডল থেকে ধেয়ে আসছে বর্ষা, ভেজা বাতাস!
রবিঠাকুর প্রিয়ার ছায়া আকাশে ভাসাতেন। আমি দেখি অন্ধকারের মত কালো ধোঁয়া, কুন্ডলী পাকায়, কালো আকাশ আরও কালো করে। বর্ষার সকালে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে আড়াই বছরের কণ্যাশিশুর ধর্ষণের খবর পড়ি। অস্ট্রেলিয়ায় দুই হাজার জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে সাত শতাংশই যৌননিপীড়নের শিকার। এই বঙ্গভূমিতে ধর্ষণ বিষয়টা থলথলে কাদার মত। ওতে বিশ্রী গন্ধ থাকে। কেউ ওদিকে নজর দিতে চায় না। ওতে মাছি বসে, ওতে মশার শূককীট জন্মায়, ওতে সিটিকর্পোরেশন ঔষধ দেয় না, পরিষ্কার করে না। শুধু ও থেকে যখন সহস্রঘরে রোগ ছড়ায়, তখন ঔষধ দিতে হয়, পরিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা বোধ হয়। ঢাকা শহরের জলজমা সড়কে হাঁটতে হাঁটতে আমার পায়ে চর্মরোগ হয়েছে। ঔষধ দিচ্ছি। কাজ হচ্ছে। কাল আবার জলে হাঁটলে আমার পায়ের চর্মরোগটা ভেসে উঠবে। আবার ঔষধ দেব। আমরা তো এভাবেই চলি।
চীন-ভারত যুদ্ধ হবে কি না সে সম্পর্কে আমি একটা ভবিষ্যদ্বাণী করে দিতেই পারি। আজ যদি সারাদিন-সারারাত অঝরে বৃষ্টি হয়, তবে যুদ্ধটা হবে। আর তা না হলে হবে না। নব্বইউত্তর কোল্ড ওয়ার কতদিন বর্ষার মত শীতল থাকে তা অনুমান করা কষ্টসাধ্য। তাই এই বৃষ্টিথিওরি। পাশের টেবিলে রুশো-ভলতেয়ার নিয়ে আলোচনা চলছে। একজন দাবি করল- শালা, ওরা সব্বাই ধান্দাবাজ। পাশথেকে আরেকজন রেগে বলল- তো, তোমার কার্ল মার্কস-এঙ্গেলস, এরা কি ধান্দাবাজ নয়? এরা কি নিজেদের সুবিধামত নিয়ম-কানুন বানায়ে ক্ষমতার লোভ করে নি? ও আড্ডায় সমাজতন্ত্রবাদীদের বড় দল ছিল- তর্কাতর্কি ছেড়ে প্রায় হাতাহাতির জোগাড়। গণতন্ত্রের বিপরীত হয়ত সমাজতন্ত্র নয়, কিন্তু হাতাহাতিতন্ত্রের বিপরীত নিশ্চয়ই সমাজতন্ত্র। আমার চারপাশে- হাটেবাজারে, চায়ের দোকানে, রান্নাঘরে, পাবলিক টয়লেটে, বেশ্যাবাজারে এখন হাতাহাতিতন্ত্র এ গলি থেকে ও গলিতে বেশ্যার শরীরের মত গড়াগড়ি খায়। আচমকা পুলিশ তদন্ত করতে ভুলে যায়, ডাক্তার ময়নাতদন্তে ভুুল করে। সেই শহরে আচমকা ভেড়ার পাল হাঁটে। ভেড়া সরে যাবার অপেক্ষা করতে গিয়ে জলোরাস্তায় পেরিয়ে যায় রূপের সন্ধ্যেটা।
শুধু কয়েকটি মা হাহাকার করে আকাশ ফাঁটিয়ে কাঁদে। আল্লাহর দরবারে বিচার চায়। আজ খুব সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। রাশিয়া মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত নাও করতে পারে, তবে সকালের আবওহাওয়াটা যে আরও একটু ঘুমিয়ে নেয়ার জন্য চমৎকার- তা নিঃসন্দেহ। আমি ঘুমোলেই প্রিন্সেস ডায়নাকে স্বপ্নে দেখি! আর দেখি ভ্লাদিমির পুতিনকে। ঘুম থেকে উঠে দেখি ভেনিজুয়েলার নির্বাচনে সহিংসতা, মৃত্যু। আর দেখি ধর্ষণ, বছর বছর সংখ্যা বাড়ছে। বৃষ্টিফোঁটাও বাড়ছে। এক একটি বৃষ্টিফোঁটা এক টনের থেকেও বেশি হবে। বৃষ্টিফোঁটাগুলো ধবধবে দুধের মত সাদা, রাস্তায় পড়লেই কালো হয়ে যায়। যতক্ষণ ভাসমান থাকে, ঠিক ততক্ষণই সাদা থাকে। ২০১৮’র নির্বাচন বৃষ্টিফোঁটার মত। ঘনিয়ে আসলেই যেন কালো হয়ে যাবে। রাস্তায় মানুষ মরে থাকলে পচা গন্ধ হয়, নানান রোগ ছড়ায়। বায়ুবাহিত রোগগুলো মানবসভ্যতার ইতিহাসে জ্বলন্ত অভিশাপ। আমি সে অভিশাপ চোখে দেখতে চাই না।