বাংলার এই সময়টি একেবারে আলাদা। শীত যদি উষ্ণতা উদযাপনের হয়, বসন্ত তবে আনন্দ দুয়ার। ‘বসন্ত’ – শব্দটির তির কখন কোথায় গিয়ে ঠেকে তা বোঝা মুসকিল। যদি বলি- আমার তো বসন্ত। তবে তুমি কি বুঝবে? আমার মনে বসন্ত বইছে, নাকি আমার বসন্ত হয়েছে- মানে জলবসন্ত বা গুটি বসন্ত ? অর্থ আরও বাঁকতে পারে, নিতে পারে ভয়ানক আকার। যদি বলি আরব বসন্ত- তাহলে ঘটনা একেবারে উল্টে ছারখার। ‘আরব বসন্ত’ একটি আন্দোলন, একটি গণজাগরণ- স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ফুঁসে ওঠার কাহিনী। আমাদের ফুলে ফুলে ঢাকা প্রেমময় বসন্তবিলাসের সাথে তার কোন মিল নেই। বসন্ত আনন্দ পৃথিবীর সব স্থানে একসাথে আসে- ব্যাপারটা এমনও নয়। আমরা যখন প্রেম-আনন্দে বসন্তযাপন করছি, পৃথিবীর উল্টোপাশে, অর্থাৎ দক্ষিণ গোলার্ধে ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই আলাদা এবং সেই আলাদা ব্যাপারটি মোটেও সুখকর নয়। কথা আরও আছে, বসন্ত উদযাপনের মালিক শুধু আমরা একা নই। নতুন বছর আগমনের পূর্বমুহূর্ততে আনন্দে ভাসে অনেকেই। ইতিহাস হিসেবে শোনা যায় অনেক মুখরোচক দৈত্য-দানবের কাহিনী, আছে অত্যাচারী রাজাকে বধ করে শান্তি পুন:প্রতিষ্ঠার বার্তা। সেই পবিত্রতার জন্যই বসন্ত এত আনন্দের। খ্রিষ্টান সম্প্রদায় পালন করে বাসন্তিক উৎসব- ঈস্টার। যীশুখ্রিস্ট মৃত্যুর দু’দিন পরে তৃতীয় দিনের দিন যীশুখ্রিস্টের পুনর্জন্ম ঘটে ( Resurrection of Jesus)। সেই পুনর্জন্ম পবিত্রতার, সকল অশুভের বিরুদ্ধে শুভ’র পুনরুত্থান। ২২ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল- পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এ উপলক্ষে উৎসব হয়। তাই বসন্তকে বাঙালি একচেটিয়া নিজেদের সম্পত্তি বলে চালিয়ে দিতে পারে না। তবে অন্য সবার থেকে বাঙালি জাতি নিশ্চয়ই ভিন্ন, অন্তত বসন্তবরণ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। বংবেরঙ্গের পোষাক, আয়োজন, আনন্দগান, র্যালি- এগুলো বাঙালির নিজের। বসন্ত উৎসবে সবার ভাগ আছে, কিন্তু এই উদযাপনরীতিতে কারও ভাগ নেই। সংস্কৃতি একটি জাতির অমূল্য সম্পদ। চাইলেই কেউ এই সংস্কৃতি কেড়ে নিতে পারবে না।
আমাদের জন্য যেন এই বসন্ত, এই ফাল্গুন মাস- এগুলো ভিন্ন। একেবারেই আলাদা। অন্য কারও সাথে আমাদের এই বসন্তটুকু মিলবে না- একেবারেই না। এই ফাল্গুনে, এই বসন্তে আমরা রক্ত ঝরিয়েছি- নিজের ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি। ১৯৫২’র বসন্তটি, ৮ ফাল্গুনটি, আমাদের জন্য এত সহজ হয় আসেনি। ওই বসন্তটি কেটেছে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে, জেল খেটে খেটে, ভাষার জন্য মরে মরে, শহীদ মিনার বানিয়ে বানিয়ে। বসন্ত এলেই আমরা প্রথমেই প্রকৃতি বরণ করি। বরণ করি বইমেলাকে। তারপর বরণ করি ভালোবাসা দিবসকে। আমাদের কাজ এতে থামে না। আমরা বরণ করে নেবার প্রস্তুতি নেই ২১ ফেব্রয়ারিকে। ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেই শহীদমিনার। গর্ব করি নিজেদের প্রতিবাদজড়ানো অতীতের জন্য। বসন্ত তাই আমাদের জন্য শুধু সুন্দর-আনন্দের নয়। এটা আমাদের গর্বের সময়, নিজের ভাষার জন্য গর্ব করার সময়।
আগে বলেছি- সংস্কৃতিকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তবে অপচেষ্টাও কম হয় না। অন্তত আমাদের বাংলায়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে এদেশেরই কিছু কবি-সাহিত্যিক নিকৃষ্ট এক কাজে ঝাপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য লাভের মোহে তারা বাঙলা ভাষাতে বিকৃতভাবে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ ঘটাতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- বিদ্রোহী কবির ‘নতুনের গান’ কবিতার দু’টি চরণ এমন-
” নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান।”
এখানে ’মহাশ্মশান’ শব্দটি তাদের পছন্দ হয়নি। তারা কবিতাটি এভাবে বিকৃত করল-
'নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব গোরস্থান।'
মদনমোহন তর্কালঙ্কারের নাম সবাই না জানলেও তাঁর কবিতাটি সবাই জানে। এই কবিতাটির সাথে আমাদের মিষ্টিমধুর ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কবিতাটি হল-
'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।'
চরণগুলো ভালো লাগেনি সেইসব নিকৃষ্ট বোদ্ধাদের। তারা এগুলোকে পাল্টালো, এভাবে-
'ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি
সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি।'
সেই কালোসময় পেরিয়েছে। রাস্তায় রক্ত ঢেলে সে সময় বাঙালি পার করেছে। কিন্তু পুরোনো শকুন কি মরেছে একেবারে? ২০১৪ সালে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে কিছু সংশোধনী আনার কথা বলা হয়। যেমন- মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ’তৈলচিত্রের ভূত’ গল্পটির নাম পাল্টিয়ে ’তৈলচিত্রের আছড়’ করার কথা বলা হয়! সেই গতশতাব্দীর পঞ্চাশের দশক আর এই শতাব্দীর ২০১৪- মিল কি কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে? ২০১৭ সালে সরকারের অভাবনীয় সাফল্য যদি ১ জানুয়ারী চার কোটি’র অধিক ছেলেমেয়ের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হয়, তবে অভানীয় ব্যর্থতা হল পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতার ছড়াছড়ি আর লজ্জাজনক ভুল-ভ্রান্তি। যে নিকৃষ্টতায় বাংলার উপর আঘাত এসেছিল ৫২’র আগে, সেই একই নোংরামিতে ২০১৭’র পাঠ্যপুস্তকে বাদ যায় হিন্দু-খ্রিস্টান চরিত্রগুলো, বাদ যায় ‘বই’ কবিতাটি, বাদ যায় রামায়নের গল্পটুকু। তৃতীয় শ্রেণীর বইয়ে বাচ্চা মেয়ের শাপলা তোলার ছবিটিও নোংরামির শিকার। বাচ্চা মেয়ের হাত-পা’য়ের খোলা অংশ কবে কার ক্ষতি করল- সে উত্তর কি কেউ দেবে? আমরা কবে থেকে এত উগ্রতা আর অন্ধত্বকে সহ্য করা শিখলাম- তার উত্তর কি কেউ দেবে? নিউইয়র্ক টাইমস্ এর প্রতিবেদন অনুসারে- এইবার বিতরণ করা বইয়ে মোট ১৭ টি গল্প ও কবিতা উধাও! কেন? কে উত্তর দেবে? বাংলাদেশ সরকার জঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযানে নেমেছে, পাড়ায়-মহল্লায় সচেতনতা ছড়াচ্ছে- কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে যে বিষবাষ্প গেঁথে দিচ্ছে, তা হয়ে যাচ্ছে সর্ষে ক্ষেতে ভূতের মত। বসন্ত যাপনের এই প্রিয়লগ্নে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আর না আনি। কথা একটাই, শকুন রা সময়ে সময়ে বেঁচে থাকে। এরা কখনও মরে না। এরপরে এদের দাবী হবে- পাঠ্যপুস্তকগুলো বাংলায় না ছেপে উর্দু বা আরবিতে ছাপানো! শিক্ষাবোর্ড সেটাও মানবে কি না তা ভবিষ্যৎ বলবে। সেই সময়ে পৌঁছবার আগেই, আশা রাখি, বাংলাদেশ সরকার পরের বছরেই পাঠ্যবইগুলোর অসংলগ্ন পরিবর্তনগুলো উঠিয়ে দেবে। আশা রাখি, অন্তত তৃতীয় শ্রেণীর বাচ্চারা নারী-পুরুষ বিভেদ শিখবে না, আমরা তাদেরকে শেখাবো না।
একজন কবি ছিলেন- নাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি বুঝেছিলেন- বসন্ত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। প্রকৃতির নিয়মে বসন্ত আসবেই, আমাদের রাঙ্গাবেই। তাই তিনি লিখলেন-
"…… শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।
ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত। "
বসন্ত ছুঁয়ে যায়নি, এমন কবি-সাহিত্যিক বাংলায় মেলা দুষ্কর। বসন্ত আর বাংলাভাষা একই মালায় গাঁথার কাজ শুরু হয়েছে সেই ৫২ থেকেই। বসন্ত এলেই যেমন জমে ফুলের পাহাড়, যেমন জাগে প্রেমের গুঞ্জরণ, তেমনি আসে বাংলাভাষার বার্তা, মনে আসে রক্তাক্ত স্মৃতি, গর্বের ইতিহাস। আমাদের বসন্ত তাই আরও গর্বের , অহংকারের, অলংকারের, অন্যদের থেকে বেশি আনন্দের, উৎসবের। আমরা একে কলঙ্কিত করব না, কোন মাত্রাতেই না- এটুকু শপথ নিলে ক্ষতি নেই।
………………………………………………………………………………………………...................
বসন্ত, তোমার জন্য
তুমি রক্তসাজের রূপ
তুমি ঈষাণপুরের কণ্যে
তুমি আনন্দে ভিজে চুপচুপ
তুমি উদাস্ আমার জন্যে।
বসন্ত, তুমি গৌরিসাজের দেবী,
বসন্ত, তুমি মৌনবিধুর শুকনো ফ্রেমে
আলতাপড়া ছবি,
তুমি গতসন্ধ্যের প্রেম, তুমি নীলচে রঙ্গের গোলাপ
তুমি শীতপেরোনো মাঠের বনে উদাসপুরের প্রলাপ।
তুমি আন্দোলন, তুমি চিৎকার, তুমি প্রতিবাদ
তুমি রক্ত, তুমি মায়ের ভাষা, অকস্মাৎ-
তুমি মিছিল, তুমি শহীদমিনারে পদযাত্রী,
যারা খালি পায়ে, জ্বালে প্রদীপীশিখা, অহোরাত্রি।
বসন্ত, তুমি কোকিলের ডাক, ফুলেদের স্বপ্ন
বসন্ত, তুমি বুকের সাহস, প্রেমিকার যত্ন
বসন্ত, তুমি বিকেল হাওয়ায় প্রেম
বসন্ত, তুমি রাজপথে হারিয়ে যাওয়া
ভাঙ্গাচোরা এক ফ্রেম।
সে ফ্রেমে জন্মে আমার ভাইয়ের চেহারা
ওরা বারবার জাগে, আনন্দে মরে
আমি ওদের ভাষাতেই লিখি-
বারবার পড়ে গিয়ে,
প্রেম নিয়ে বুক ভরে…।।