একাত্তরে শরণার্থী শিবিরের ছবি দেখি পত্র-পত্রিকায়। খুব আপনজনের মুখে শুনেছি শরণার্থীদের জীবন,চলাচল,পরিবেশ।শরণার্থী মানেই সহায়হারা সাদা-কালো ছবির দরিদ্র যাত্রী। বেঁচে থাকার আদিম বাসনায় শরণার্থী পথে হাঁটে। পথে পাহাড়-সমুদ্র সবকিছুকে একাকার করে শরণার্থী নিরাপদ আশ্রয়ে ছোঁটে। এতে জীবন গেলে ক্ষতি নেই। নিজভূমে যেখানে মৃত্যু নিশ্চিত, সেখানে বাঁচার চেষ্টায় মৃত্যু গর্বের সমতূল্য।
মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর সাম্প্রতিক আক্রমন শুরুর বছরটা ২০১২। রাখাইন সম্প্রদায়ের সাথে মিলে সরকারি বাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার চালায়- যা ইচ্ছে তাই করে। এই ইচ্ছেগুলোর মধ্যে ছিল অগ্নিসংযোগ, হত্যা, লুণ্ঠনসহ আনুষঙ্গিক পাপাচার। তারপর এই পাপাচার হয়েছে নিয়মিত। কেউ এগিয়ে আসেনি রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে। ত্রাতা ছিল একটি নদী আর একটি দেশ। নদীটির নাম নাফ নদী, আর দেশটির নাম বাংলাদেশ। নদী পেরোলেই বাংলাদেশ, সেখানে কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না, অন্তত চাইলেই কেউ হত্যা করতে পারবে না। একাত্তরে বাঙ্গালী শরণার্থীদেরও এমন কামনা ছিল। বর্ডার পেরোলেই ভারত-মুক্তির ঠিকানা!
ভারত বাঙ্গালীদের জায়গা দিয়েছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে যাচ্ছেতাই ভাবে। ফলে এই অবৈধ প্রবেশকারীদের কোন উৎস আমাদের জানা নেই। চাইলেই এই রোহিঙ্গারা অপরাধজগতে নাম লেখাতে পারছে, আর নিজভূমি ফিরিয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে তাদেরকে জঙ্গী বানাচ্ছে একদল জঙ্গীগোষ্ঠী। রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলার জন্যও রোহিঙ্গারা দায়ী বলে ভাবা হয়। ফলে রোহিঙ্গারা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া। চাইলেই মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ নিতে পারছে না বা যেকোন আইনি বৈধতায় এটা সম্ভবও নয়।
কিন্তু কেন এই সংঘাত? জানা যায়, এই রোহিঙ্গারা একটা সময় মায়ানমারে থাকতে চায়নি। তারা হতে চেয়েছিল পাকিস্তানের অংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। সেসময় রোহিঙ্গারা মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করে। স্বাধীনতার দাবীতে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে তারা সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। ভরসা ছিল সেই পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়া।কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি হর্তা-কর্তারা তাদের দাবীটাতে উৎসাহ ঢালেনি। রোহিঙ্গারা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর রোহিঙ্গাদের এই স্বপ্নটা একেবারে শেষ হয়ে যায়। ফলে একদিক থেকে তারা মায়ানমারের শত্রু, অন্যদিকে বিকল্প কোথাও যাবার রাস্তাও তাদের বন্ধ। অথচ তাদের জন্ম-বৃদ্ধি মায়ানমারে। সংকটের শুরুটা এখান থেকেই। মায়ানমার সরকার তাদের নিজেদের নাগরিক বলে দাবী করেনা, বরং বলে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক।রোহিঙ্গাদের তাড়াতে চালায় অত্যাচার-দমন-হত্যা। তাদের জন্য মায়ানমার সরকার ‘গ্যাটো’ ব্যবস্থা করেছে- যার দ্বারা রোহিঙ্গাদেরকে একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভেতরে বেঁধে রাখা হয়। এই এলাকার বাহিরে তারা বেরোতে পারেনা। তাদের বিয়ে করার জন্য প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। দু’টির বেশি সন্তান নিলেই রয়েছে শাস্তি!
যেন রূপকথার বন্দীশালার কথা বলছি! সিরিয়া কিংবা রোহিঙ্গা- ভূমধ্যসাগর কিংবা আন্দামান সাগর- প্রাণ নিচ্ছে যুদ্ধ ও শাসক। মিয়ানমার যা করছে সেটা সুস্পষ্ট মানবতার সব সীমানার লঙ্ঘন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত চাপ বাড়াতে পারে। কুটনৈতিকভাবে মায়ানমারকে একঘরে করা যেতে পারে। অপরাধ করতে যদি বাঁধা না থাকে তবে অপরাধমাত্রা বাড়তেই থাকে। মায়ানমারকে যদি বাঁধা না দেয়া যায়- তবে এই আধুনিক যুগেও তারা লক্ষ মানুষকে সবার চোখের সামনে হত্যা করতে পারে। তাই, তাদেরকে ভয় দেখাতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলগুলোর এগিয়ে আসতে হবে। এটা শুনতে যেমনই লাগুক না কেন- অবৈধভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়াটা একেবারেই অনুচিত। এটা কোন সমাধানও নয়। শরণার্থীদের আশ্রয় দানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক দায় আছে। তার মানে এই নয় যে রোহিঙ্গাদের দেশে আশ্রয় দিতে হবে বা তাদের সব দায়িত্ব নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের আবাস মায়ানমারে। তাদেরকে সেখানে নির্ভয়ে বসবাসের এবং জীবন ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। এই দায়টা শুধু বাংলাদেশের নয়, তাবৎ পৃথিবীবাসীর।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছে না। একটি পূর্ণ জনগোষ্ঠী গণহত্যার মুখোমুখি হয়েছে এই সভ্য সমাজে। অথচ কেউ কেউ সেটিকে ধর্মের উপর আক্রমন বলে চালাচ্ছে, আবার কেউ কেউ চুপচাপ থেকে দায় এড়াতে চাইছে। এটা ধর্মের উপর আক্রমন নয়, এটা একটা জাতিগোষ্ঠীর উপর আক্রমন। রোহিঙ্গাদের হাহাকার আর যন্ত্রণাকে ক্ষুদ্র গন্ডিতে বাঁধার চেষ্টা তাদের জন্য উল্টো ক্ষতিকর। বরং সমাধানের রাস্তাটি হচ্ছে মায়ানমারের উপর চাপ তৈরী করা এবং রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নিজ আবাসভূমি ফিরিয়ে দেয়া। অসহায় রোহিঙ্গাদের চোখের দিকে তাকান। তারা শুধু এটুকুই চাইছে। বেশি কিছু নয়।