চোখ মেললেই চোখে ভাসে দুর্বল শাসন-প্রশাসন আর আইন প্রণয়নের ঘাটতি। গলির প্রতিটি মোড়ে মোড়ে স্বজনপ্রীতি। সরকারী দপ্তরের প্রতিটি কানায় কানায় ঘুষ আর দালালি। এরই চক্করে কখনও বড় বিল্ডিং ধ্বসে, কখনও সড়কপথে বলিদান হয় তরুণ-তাজা যুবক। এই সরলরেখায় আগুন জ্বলে কারখানায়, পোড়ে শ্রমিক, মুক্তি পায় হন্তা মালিক, ঘুষের মাহাত্ম্য একূল-ওকূল দুকূল জুড়ে ভাসে। ঘুষ দিলেই মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স, দলীয় জোর থাকলেই মেলে অপরাধমুক্তি। তা না হলে মাইক্রোবাস কি করে অ্যাম্বুলেন্স হবার স্বপ্ন দেখে? আর এ স্বপ্ন কারাই বা দেখায়?
এক নেতার গুলিতে গর্ভের সন্তান আক্রান্ত হয়েছিল, ২০১৫ তে মাগুরায়। এবার গর্ভের সন্তান নিহত, জীবনপ্রদায়িনী হাসপাতারের সামনে। এদের শিকড় ভিন্ন নয়। যে শক্তিবলে অবৈধ দুর্বল বিল্ডিং কারখানায় রূপ নেয়, সেই শক্তিতেই এ-ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়, সেই শক্তিতেই চলে ঘুষের রাজত্ব, চলে স্বজনপ্রীতির রাসউৎসব। প্রতিবার ঈদে রাস্তায় মরে প্রিয়জন। মেঘনায় লঞ্চ ডোবে নিয়ম করে। কবি শেলী প্রাণ হারিয়েছিলেন সলিলসমাধিতে। তবে জলে ডুবলেই কবি তৈরী হয় না, আকাশে কবিতাও ভাসে না। ভাসে দুঃখ, যন্ত্রণা, সম্ভাবনার মৃত্যু। বাংলাদেশের মৃত্যুপঞ্জিকার সবথেকে ব্যস্ত সময় ঈদের আগের ও পরের দিনক’টি। কত প্রাণ আমাদের, অনেক হারালেও আমরা প্রাণহীন নই!
যে অন্যায়ের হাতে শ্রমিক পোড়ে, যে ঘুষের টাকায় গর্ভশিশু নিহত হয়- তার যন্ত্রণা আজীবনের। হাজার মঙ্গলপ্রদীপেও তার পরিত্রাণ নেই।বিশ্বব্যাংক বা চীন কত টাকা দিল- মানুষ তাতে খুশি হয় না। মানুষ ভালো থাকে সরকারি সেবাখাতে অনিয়ম না থাকলে, একটা বৈধ কাগজ বের করতে গিয়ে হাজার টাকা ঘুষ না দিতে হলে, বৈধ সুবিধা পাওয়ার জন্য পাঁচটা পা-চাটা অফিসারের পা না ধরতে হলে। ভিআইপি মুভমেন্টের কারনে হাজারটা মানুষ যখন ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় বসে ঘাম ঝড়ায়- মানবকল্যানের সকল আশ্বাসবাণী ব্যর্থ হয় তখনই।নেতা ও জনগনের ভোগভিন্নতার কারন নিশ্চয়ই দায়হীনতা। মধ্যম আয়ের দেশ হবার অর্থ এই নয় যে মানুষের ঘুষ দেবার ক্ষমতা বাড়বে। শুভঙ্করের ফাঁকিটা এখানেই, উচ্চআয়ের দেশ হলেও শান্তি মিলবে না- যদি সরকারি খাতের অনিয়ম না ঠিক হয়। কারন, অনিয়ম যতটা না অর্থাভাবের, তারথেকে অনেক বেশি স্বভাবের। আইন স্বর্গীয় আশির্বাদের মত বাতাসে ভাসলে কলেরার উপশম হয়না। তেমনি, হাজার অ্যাম্বুলেন্সে রাস্তা আটকিয়ে রাখলে মানুষের ভোগ। আবার অ্যাম্বুলেন্স না থাকলে হাহাকার।
অন্যায় আর সরকারি খাতের অবৈধ মিলনে জনগনের অশান্তি। আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর সাথে সাথে অন্যায় কমাতে হবে- এ সত্য উপলগ্ধির বাইরে থাকলে অপমৃত্যুই ভরসা, শুধু আমার নয়- আপনারও- যিনি ঘুষ খান, তারও।