ইংরেজিতে 'পেন' নেম (pseudonym) বা বাংলাতে ছদ্মনাম বলে একটা কথা লেখালেখির জগতে প্রচলিত আছে। কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের প্রকৃত নামের পরিবর্তে যে ছদ্মনামে লেখালেখি করেন সেটাই 'পেন নেম'। কারণে বা অকারণে এই ছদ্মনাম গ্রহণ করার রীতি অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে। অনেক কবি-লেখক ছদ্মনামে এত বিখ্যাত হয়েছেন যে আসল নামে তাঁদেরকে কেউ চিনেও না। বাংলাভাষী অনেক লেখক জীবনের কোন সময়ে, আবার অনেকে সারা জীবন লেখালেখির ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোন সময় নীললোহিত নামে লিখলেও এ নামে তিনি প্রতিষ্ঠিত হননি। অন্যদিকে বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় কিন্তু ছদ্মনাম বনফুল নামেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বা পরিচিত হয়েছেন। ঠিক তেমনি যাযাবরকে বিনয় মুখোপাধ্যায় বললে অনেকেই চিনবে না। তাছাড়া অনেক লেখক তাঁদের লেখার বিশেষ গুণাবলীর জন্য বিশেষ বিশেষ উপাধিও পেয়েছেন। যেমন- জসীম উদ্দিন - পল্লীকবি।
সাহিত্য ক্ষেত্রে ছদ্মনাম গ্রহণ প্রায় অপরিহার্য। ইন্টারনেট জগতে বাংলা ব্লগগুলোর বেশকিছু ব্লগে ছদ্মনামের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের পাশাপাশি স্বল্প খ্যাত বা অখ্যাত লেখক লেখিকাগণও ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন। ছদ্মনাম গ্রহণের মধ্যে নানা চিন্তা ভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বহু সাহিত্যিক দশ বা তারও বেশি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তিন, চার বা পাঁচের বেশি ছদ্মনামধারী সাহিত্যিকের সংখ্যাও কম নয়। ছদ্মনামগুলির মধ্যে বেশ মজার মজার নামও পাওয়া যায়। সাহিত্যিকরা বহু যুগ ধরেই ছদ্মনাম ব্যবহার করে আসছেন। কেউ কেউ আবার এটাকে ছদ্মনাম না বলে নামান্তরও বলে থাকেন।
মীর মশাররফ হোসেন লিখতেন গাজী মিয়া নামে। প্যারীচাঁদ মিত্র লিখতেন টেকচাঁদ ঠাকুর নামে। আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো রীতিমতো অনিলা দেবী নামে লিখেছেন। অনেক সময় লেখক যে নিজে নাম বদলান তা কিন্তু নয়। এতে অনেক প্রকাশকের হাত থাকে। অনেকে আবার পরিচয় গোপন রাখতে ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন। আবার এই নামে খ্যাতিমান আরেক ব্যক্তি থাকার কারণেও নাম পরিবর্তন করা হয়।
স্মৃতিভাণ্ডার হাতড়ে কিছু ছদ্মনাম ব্যবহারকারীদের নাম উল্লেখ করতে মন চাইছে। যেমন --
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভানুসিংহ)
প্যারিচাদ মিত্র (টেকচাদ ঠাকুর)
কাজেম আলী কোরেইশী (কায়কোবাদ)
শওকত ওসমান (শেখ আজিজুর রহমান)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীল লোহিত)
সমরেশ বসু (কালকূট)
প্রমথ চৌধুরী (বীরবল)
শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (অনিলাদেবী)
কালীপ্রসন্ন সিংহ (হুতুম পেচা)
বলাই মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
বিমল ঘোষ (মৌমাছি)
ড মনিরুজ্জামান (হায়াত মাহমুদ)
রাজশেখর বসু (পরশুরাম)
অনন্ত বড়ু (বড়ু চন্ডীদাস)
নীহারঞ্জন গুপ্ত (বানভট্ট)।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়টি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন : ভানুসিংহ ঠাকুর; অকপটচন্দ্র ভাস্কর; আন্নাকালী পাকড়াশী; দিকশূন্য ভট্টাচার্য; নবীন কিশোর শর্মণ; ষষ্ঠীচরণ দেবশর্মা; বানীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ; শ্রীমতী কনিষ্ঠা; শ্রীমতী মধ্যমা।
সিনেমা জগতেও ছদ্মনামের আধিক্য দেখা যায়। দীপক চক্রবর্তীই পরবর্তীত হয়ে চলচ্চিত্রাভিনেতা চিরঞ্জীত নামেই চিনি। আর-এক দীপককে চিনি অভিনেতা দেব হিসেবে, ইনি দীপক অধিকারী। গৌরাঙ্গ চক্রবর্তীই সুপারস্টার মিথুন (মিঠুন) চক্রবর্তী। চুমকি রায়কে আমরা চিনি দেবশ্রী রায় নামে। সুচিত্রা সেন ছিল রমা সেন নামে। রীনা দাশগুপ্তই অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। অরুণ চট্টোপাধ্যায়কে আমরা মহানায়ক উত্তমকুমার নামেই জানি। বলিউড অভিনেতা অক্ষয়কুমারের প্রকৃত নাম রাজীব ভাটিয়া। সংগীতশিল্পী কুমার সানু এবং শানের আসল নাম যথাক্রমে কেদার ভট্টাচার্য এবং শান্তনু মুখার্জি।
লেখকের সার্থকতা সেখানেই যখন তার সাহিত্য কোন পাঠকের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়।
**************************************************
গায়কের সার্থকতা কথার ফাঁকে, লেখকের সার্থকতা কথার ঝাঁকে। - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.
একজন পাঠক যখন তৃপ্ত হয় সেখানেই লেখকের সার্থকতা। সোজা ভাষায় বলে, পাঠকের মনের মাঝে লেখাকে স্থাপন করায় ভাললাগার মাঝেই একজন লেখকের সার্থকতা ।
একটা কিছু লিখে অন্যকে আনন্দ দিতে পারলে আমারো ভাল লাগে।
ভাল থাকবেন।