৬ বছর বয়সী একজন শিশুর মনোজগতে কী কী জিনিস প্রাধান্য পায়? চকোলেট, আইসক্রিম, লেগো সেট, গাড়ি, নতুন পোষাক, বেলুন, রঙের বই ইত্যাদি; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলোই হবে উত্তর। এই সময়টা আনন্দের, নির্ভাবনার, খেলার, মজার। ক্লাশে প্রতিদিন কী মজা হচ্ছে, কী শিখছে, কে সবচেয়ে দুষ্টু, কোন টিচার তাকে সবচেয়ে বেশি আদর করে, বাবা-মাকে এসব বলে অস্থির করে রাখে তারা দিনমান!
এটি একটি উন্নত অথবা মধ্যম আয়ের দেশের সাধারণ চিত্র। কিন্তু সবাই এমন সৌভাগ্যবান নয়। রুক্ষ্ণ এবং ধূলিময় আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও এমন এলাকা আছে, যেখানে এক বালতি পানির জন্যে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। স্কুল, খেলনা, রঙিন ছবির বই সেসব এলাকার শিশুদের কাছে স্রেফ বিলাসিতা, অথবা আকাশ কুসুম স্বপ্ন। এই বিভাজনের পৃথিবীতে কজন খোঁজ রাখে তাদের? তারপরেও কিছু মানুষ সবসময়ই থাকে, যারা জীবন নিবেদন করে পরের মঙ্গলে। বিভিন্ন সমাজসেবী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে তাদের জন্যে। বছরে বছরে দুর্গতদের জন্যে ত্রাণ তহবিল গঠিত হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। এসব বিশাল ব্যাপার স্যাপার। ছয় বছর বয়েসী একটি শিশু এর কতটাই বা বুঝবে? আর বুঝলেই বা কীভাবে সাহায্য করবে?
রায়ান রেলিয়াক বুঝেছিলো, এবং সাহায্যও করেছিলো। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী এই বালক প্রচুর মেয়োনিজ দেয়া হ্যামবার্গারের স্বাদ নেয়া অথবা রোলার কোস্টারে চড়ে জীবনের গতি বাড়িয়ে ছুটে চলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পেয়েছিলো। সে চেয়েছিলো আর্তের সেবা করতে, তৃষ্ণাব্যাকুল মানুষ গুলোকে জীবনের সতেজতায় উজ্জীবিত করে অফুরান শক্তি যোগাতে। এই মহান ভাবনায় উদ্ভাসিত মানুষটির মাঝে এমন বোধের জন্ম হয়েছিলো মাত্র ৬ বছর বয়সে। আর এর নেপথ্য কুশীলব তার স্কুলের টিচার মিসেস ন্যান্সি প্রেস্ট। গ্রেড ওয়ানের ক্লাশে একদিন তিনি বাচ্চাদের জানিয়েছিলেন “আফ্রিকায় এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে বিশূদ্ধ পানির জন্যে পাঁচ মাইল হাঁটতে হয়। তৃষ্ণার্ত এই মানুষ গুলো এই ভয়াবহ পরিশ্রম এবং অপ্রতুলতা সইতে না পেরে অসুস্থ হয়। মারা যায় অহরহ”।
মিসেস ন্যান্সি প্রেস্টের এই কথাগুলো রায়ানকে চিরদিনের জন্যে বদলে দেয়। তখন তার বয়স ছয়, সালটা ১৯৯৭।
তৃষ্ণার্ত মানুষের কষ্টের কথা শুনে অবশ্য যে কারোই মন খারাপ হতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের। তবে কজনই বা মনে রাখবে সে কথা? একটু আদর করে একটা মজার খেলনা অথবা ক্যাডবেরি দিলেই তো ভুলিয়ে রাখা যায় তাদের! কিন্তু রায়ান ছিলো অন্যরকম।
সেদিন থেকেই সে আফ্রিকার হতভাগ্য মানুষের জন্যে কিছু করার দৃঢ় সংকল্প করে। বাবা-মার কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে টাকার জন্যে। ঘটনা কী? না, সে আফ্রিকার সেসব এলাকায় কূপ খুড়ে পানির যোগান দেবে। প্রথমে শিশুতোষ খেয়াল বলে উড়িয়ে দিলেও দ্রুতই তারা সন্তানের এই অসাধারণ মানবিক উদ্যোগটিকে সিরিয়াসলি নেয়, এবং অল্প অল্প করে কিছু টাকা দিতে থাকে। দেখতে দেখতে ৭০ ডলার জমে গেলো। খুব কম নয় অংকটা। রায়ান তো মহা খুশি তখন! অভিভাবকদের সহায়তায় যোগাযোগ করলো ওয়াটার ক্যান নামক একটি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার সাথে, যারা উপদ্রুত এলাকায় কূপ খনন করে। সমবেদনার সাথে তারা জানালো যে, একটি কূপ খনন করতে ২০০০ ডলার লাগে। রায়ান এতে মোটেও হতোদ্যম হলো না। তহবিল সংগ্রহ করতে সে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বন্ধু-শিক্ষক, খালা-মামা, কাজিন, মোটামুটি ঘনিষ্ঠ থেকে শুরু করে কাছের দূরের, সবার কাছ থেকেই চাঁদা নেয়া শুরু করলো। এইটুকু ছেলের ভেতর কী অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি এবং দৃঢ়তা! বেশিরভাগ মানুষই ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয় নি। ভেবেছেন ছোট্ট বাবুটার আহলাদী ভাবনা! রায়ান ছোট্ট ছিলো, কিন্তু তার ভেতরে ছিলো এক মহান সন্তর বসবাস। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বছর খানেকের মধ্যেই সে দুই হাজার ডলার যোগাড় করে ফেললো।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতের সকালে উগান্ডার এ্যাঙ্গোলো প্রাইমারি স্কুলে রচিত হলো মানবিক বন্ধনের এক অপূর্ব মহাকাব্য। রায়ান এবং তার সাথে জড়িত অসংখ্য মানুষের ভালোবাসার সাথে সঙ্গত করে Canadian Physicians for Aid and Relief (CPAR) উদ্বোধন করলো বিশূদ্ধ পানির জন্যে একটি কূপ। সেই থেকে শুরু। বাবা-মার কাছ থেকে খুচরো কিছু পয়সা নিয়ে যে মহৎ স্বপ্নের সূচনা হয়েছিলো, এখন তা ভালোবাসার গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে আফ্রিকার গহীন ধূসর জমিনে। রায়ানের সাথে এখন আছে সাথে আছে হলিক্রস, ইউনিসেফ, রোটারি এবং হু এর মত সংস্থা। আফ্রিকায় বিশূদ্ধ পানির যোগান দিতে তারা প্রায় ৮ লক্ষ ডলারের মত ব্যয় করেছে!
রায়ান এখন আর ছোট্টটি নেই। পাক্কা ছয় ফিট ছয় ইঞ্চি লম্বা এক টগবগে তরুণ! ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ছে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ কিংস কলেজে। কি-নোট স্পিকার হিসেবেও বেশ সুনাম পেয়েছে। হিল্লি-দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশ্বব্যাপী পানির সমস্যা বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করতে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়েছেন, সংহতি প্রকাশ করেছেন। তবে রায়ান কখনও বিখ্যাত ব্যক্তি হতে চায় নি। সে নিজের কাজটা করে গেছে সবসময়। রায়ানের মা সুজান খুব গর্ব করে বলেন, “ওর কাছে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। গ্যাসস্টেশনের কর্মী কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সবাইকেই সে শ্রদ্ধার সাথে দেখে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী তেলকুবের পাঁচ হাজার ডলার পাঠালে রায়ান যতটা খুশি হয় ফ্লোরিডা থেকে পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে ওকে পাঁচ সেন্ট পাঠালে তার চেয়েও বেশি খুশি হয়! টাকা পয়সার চেয়ে ঐকান্তিক ইচ্ছেটাই তার কাছে বড়”।
সময় বয়ে চলে, রায়ানের স্বপ্ন গুলো বিস্তৃত হয়। শুধু মাত্র কূপ খনন করেই সে থেমে থাকে নি। কাজ করেছে স্যানিটারি ল্যাট্রিন নিয়েও। মানবিকতা এবং ভালোবাসা ঘুচিয়ে দেয় শত বিভেদ আর বৈষম্য। আর তাই আফ্রিকা থেকে রায়ান পেয়েছে অসংখ্য বন্ধু এবং প্রিয়জন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হলো জিমি। ৯ বছর বয়স থেকেই উগান্ডার এই বালকটির সাথে রায়ানের গলায় গলায় ভাব। তারা ছিলো পেন ফ্রেন্ড। আর এখন দুজনে এক সাথে কাজ করে চলেছে জীবনের জন্যে, মানুষের জন্যে।
১৯৯৯ সালের সেই দিনটি এনে দিয়েছে আরো অনেক সুদিনের সন্ধান। নয়শটি কূপ এবং সাতশটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন, স্কোরকার্ডটা নেহায়েৎ মন্দ না! কী বলেন?
২০১০ সালে বালক রায়ান একটি সাক্ষাৎকার দেয় http://myhero.com এ। সাক্ষাৎকারীর নাম স্ল্যাটার। বয়স মাত্র এগারো! এখানে তা গ্রন্থিত হলো।
স্ল্যাটার-মাত্র ছয় বছর বয়সে আফ্রিকার মানুষদের সাহায্য করার কথা কীভাবে ভাবলে তুমি?
রায়ান- প্রথম যখন শুনি আফ্রিকায় বিশূদ্ধ পানির অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে, আমি বিশ্বাস করতে পারি নি। আমি ট্যাপ ছাড়লেই পানি পেয়ে যাই, আর ওরা মাইলের পর মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করে আনে, বিষয়টা আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। আমার পেন ফ্রেন্ড জিমি বলেছিলো, সে পানির জন্যে রাত বারোটায় উঠে পাঁচ মাইল হেঁটে যায়, এবং আবার ফিরে আসে। সারাদিনে মোট তিন বার তাকে এই কাজ করতে হয়। আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারি নি বিষয়টি।
স্ল্যাটার- আফ্রিকার মানুষদের কাছ থেকে তুমি কী শিখেছো?
রায়ান- আমি শিখেছি মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। আমি উগান্ডার স্কুলে স্কুলে গিয়েছি, নতুন সব বন্ধুদের সাথে খেলেছি, কোনভাবেই ওরা আমাদের থেকে আলাদা নয়। ওদের দুর্ভাগ্য যে ওরা আফ্রিকার খুব কঠিন একটা জায়গায় জন্মেছে। পার্থক্য কেবল এটাই। আর কিছু না। পৃথিবীটা একটি বিরাট জিগ’স পাজলের মত। শুধু জানতে হবে আমার নিজের অংশটি কোথায় স্থান পাবে। আমি আমার পাজলের অংশটি খুঁজে পেয়েছি। তা হলো- বিশূদ্ধ পানি নিশ্চিতকরণে কাজ করা। অন্যরাও যদি নিজ নিজ পাজলের অংশটা খুঁজে পায়, তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠবে সুন্দর।
স্ল্যাটার- যদি তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ দেয়া হয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে, তুমি কী বলবে?
রায়ান- আমি জিজ্ঞেস করবো, “আপনার কতটুকু আছে? যতটুকু আছে, তার সবটুকুই কী খুব প্রয়োজন? অন্যের জন্যে খুব সামান্য একটা অংশ কি বরাদ্দ দেয়া যায়? সামান্য অনেক কিছুর সমন্বয়েই তো মহৎ কিছু হয়”। আমি বলবো স্বপ্নটাকে যতন করতে, বিশ্বাস করতে। তাহলেই সবকিছু সম্ভব। আমরা ভাবি আমাদের দেয়ার মত কিছুই নেই। এটা একদম ভুল ধারণা। উগান্ডার এ্যাঞ্জোলো প্রাইমারি স্কুলের ছেলে-মেয়েদের আমি দেখেছি। কী আছে তাদের? কী নেই আমাদের? কোন কিছু দিতে বলা মানে কিন্তু শুধুই টাকা-পয়সা, ঘর-বাড়ি নয়। সেই বাচ্চা গুলো যাদের "কিছুই নেই", তারা আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে। বছরের পাঁচটা দিন এইচআইভি সচেতনতার জন্যে কাজ করছে। ওরা যদি এতটুকু দিতে পারে, আপনি কেন পারবেন না? আমি বিশ্বের বড় বড় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। বলবো, মানুষের জন্যে কাজ করুন। আপনাদের অনেক ক্ষমতা। দেশ-কাল-স্থান বিচার না করে সারা পৃথিবীকে নিজের ছোট্ট একটি গ্রাম ভেবে নিন না!
স্ল্যাটার- অনেকেই তোমাকে হিরো মানে। তোমার হিরো কে এবং কেন?
রায়ান- সমস্ত শিশু, যারা অভিভাবকদের চোখা রাঙানি এবং অবহেলা উপেক্ষা করেও কাজ করে চলেছে মানবতার জন্যে।
স্ল্যাটার- অনেক কাজ তো করে ফেলেছো অল্প বয়সেই। ভবিষ্যতে আর কী কী করবে বলে ভাবছো?
রায়ান- আমি ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, এবং বিশ্বব্যাপী পানি সমস্যা সমাধানে নিরন্তর কাজ করে যেতে চাই।
স্ল্যাটার- শিশুরা কীভাবে তোমার সাথে কাজ করতে পারে?
রায়ান- আমি যেভাবে শুরু করেছি, সেভাবেই ফান্ড জমানো শুরু করে আমাদের সাহায্য করতে পারে। খরচের ব্যাপারটা ঠিক অতটা সরল না। কূপ খনন করলেই হলো না। এগুলোর রক্ষনাবেক্ষন, স্যানিটেশন শিক্ষা এসবের জন্যে অনেক টাকা খরচ হয়। শুধু বাবা-মার কাছ থেকে টাকা না চেয়ে তারা নিজেরাও টুকটাক কাজ করে টাকা জমাতে পারে। এই যেমন, কার ওয়াশিং, গ্যারেজ সেল ইত্যাদি। প্রতিটি শিশু সপ্তাহে এক ডলার জমালে দশ সপ্তাহে একশ জন শিশু এক হাজার ডলার জমাতে পারে। টাকার অংকটা মোটেও ফেলে দেয়ার মত না! আমরা, কানাডিয়ানরা প্রতি দিন ৩৪৩ লিটার পানি খরচ করি। আমেরিকানরা করে ৫৫৫ লিটার। আর উগান্ডার ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কত জানেন? মাত্র ১০ লিটার! এই থিম নিয়ে আমরা পানির বোতল বানাই, টি শার্ট তৈরি করি। এগুলোর ডিজাইনেও শিশুরা কাজ করতে পারে।
স্ল্যাটার- অবসর সময়ে তুমি কী কর?
রায়ান- আমার ভেতর দুটো স্বত্তা। অর্ধেকটা বরাদ্দ রেখেছি আফ্রিকার তৃষ্ণার্ত মানুষের জন্যে, আর বাকিটা একান্তই আমার জন্যে। আমি আমাদের স্কুলের বাস্কেটবল টিমে আছি। আইস হকি খেলতেও খুব ভালোবাসি। কম্পিউটার গেমসের নেশা আছে। ভালো লাগে পড়তে আর দাবা খেলতে। সিম্পসন’স আমার প্রিয় টিভি সিরিজ, আর আমি খুব ভালোবাসি হাসতে।
রায়ান হাসলে হেসে ওঠে অসংখ্য দরিদ্র এবং তৃষ্ণার্ত মানুষ। রায়ানের হাসি অমলিন থাকুক চিরদিন পৃথিবীর জন্যে, মানুষের জন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৮