২৮শে অক্টোবর ২০১৬। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচ চলছে। ২০১০ সালে সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর এটি বাংলাদেশের ত্রিশতম টেস্ট। প্রথমে ব্যাটিং করে ইংল্যান্ড দেড় দিনের মাথায় পাঁচ উইকেট হারিয়ে সাড়ে পাঁচশ’র মত রান করে বিরক্ত হয়ে ডিক্লেয়ার দিয়ে দিয়েছে। এ্যালিস্টার কুক এবং জো রুট দেড়-শতাধিক রান করার পর স্বেচ্ছায় ব্যাটিং ছেড়ে দিলেন অন্যদের প্র্যাকটিসের জন্যে। ব্যাটিং স্বর্গ পিচে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নেমে বিপদে পড়ে গেলো। ১০০ রান না হতেই পাঁচটি উইকেট নেই...
এতক্ষণ আমার লেখাটি পড়ে নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়েছেন! ভাবছেন আমার মাথা বিগড়েছে অথবা নেশা করে আবোল তাবোল বকছি। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে সেই ২০০০ সালে। ইতিমধ্যেই খেলে ফেলেছে ৯৫টি টেস্ট। ইংল্যান্ডকে সেদিনই তো কী ভীষণ নাকাল করলো! তবে কেন এসব লিখছি? আশাবাদী মানসিকতার কেউ হয়তো ভাবতে পারেন কোন একটা জমজমাট স্পোর্টস-ফিকশন লেখার পায়তারা কষছি।
না, এসবের কিছুই হয় নি। তবে হতে পারতো। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস আরো বিলম্বিত হতো, বিশ্ব জুড়ে তারকার মর্যাদা পাওয়া আমাদের টাইগারেরা নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ না পেয়ে হতাশায় ভুগতেন। যত্ন আর পরিচর্যার অভাবে ফিটনেস ঠিক থাকতো না। ইনজুরি হলে কেউ তেমন গা করতো না, অস্ট্রেলিয়া-ইন্ডিয়ার বদলে ঠাঁই হতো মগবাজারের কোন এক ঘুপচি ক্লিনিকে (মাশরাফির এমন অভিজ্ঞতা আছে, এবং এই লেখার সাথে সেটা ভীষণ প্রাসঙ্গিক)। বলতে পারেন কত কিছুই তো হতে পারতো, সেসব নিয়ে দুঃখবিলাস না করে মুস্তাফিজ আর মিরাজ মিলে ইন্ডিয়া বা নিউজিল্যান্ডকে “ধরে দেবানে” নাকি সে কথা কেন চিন্তা করছি না? হ্যাঁ, সামনের উত্তেজনাময় ক্রিকেটিয় দিনগুলির কথা ভেবে আমি অবশ্যই রোমাঞ্চিত, কিন্তু আজকের দিনটা বিশেষ। আজ এমন একজনের জন্মদিন, যার একটি ইনিংসের ওপর পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেট কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না।
তিনি আকরাম খান। দশাসই শরীরের মারমুখী ব্যাটসম্যান আকরাম খান। ব্যাটসম্যান হিসেবে দারূণ ইন্টারেস্টিং ছিলেন, তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পরিসংখ্যান অবশ্য সে কথা বলবে না। ৪৪টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ৫টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। গড় ২৩ এর একটু বেশি। টেস্টে কোন হাফ সেঞ্চুরি নেই। গড় ১৬। কিন্তু বোকা পরিসংখ্যান কীভাবে বোঝাবে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির সেকেন্ড রাউন্ডের শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার অপরাজিত ৬৮ রানের মাহাত্ম্য? ওকে, লেটস গো টু দ্যা পয়েন্ট!
তার আগে আরেকটু ভূমিকা সেরে না নিলেই নয়! বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ভালো খেলেও বাংলাদেশ সুযোগ পাচ্ছিলো না তখনকার উঠতি শক্তি জিম্বাবুয়ের কাছে। ৯০ এর বাছাই পর্বে জিম্বাবুয়ের ৩৭ রানে চার উইকেট ফেলেও হারতে হয়েছিলো। ২৩১ রান চেজ করতে গিয়ে ১৪৭ রানে অলআউট হয়ে মেনে নিতে হয়েছিলো বিশাল পরাজয়। ৯৪ সালের আক্ষেপটা আরো বড়। কেনিয়ার ২৯৫ রানের জবাবে খুব কাছে গিয়েও হার মেনে নিতে হলো ১৩ রানে।
১৯৯৭ সালে সবাই বেশ নড়ে চড়ে বসলো। জিম্বাবুয়ে নামক ঝামেলাটা ততদিনে বিদায় নিয়েছে বাছাই পর্ব থেকে, টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে। বাংলাদেশের দলটাও বেশ ভালো। ঘরোয়া লীগে চমৎকার পারফরম্যান্স সবার। বুলবুল, নান্নু, শান্ত, রফিক, মনি, দুর্জয়, আতহার, আকরাম খান...রোমাঞ্চ জাগানিয়া সব নাম। সবাই খুব আশাবাদী, এবার হবেই! বেশ এগুচ্ছিলো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা। কেউ তেমন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে নি। সেকেন্ড রাউন্ডের শেষ ম্যাচে প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ড। ডু অর ডাই ম্যাচ। হারলেই বাদ। তখনকার দিনে নেদারল্যান্ড যথেষ্ট শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলো বাংলাদেশের জন্যে। তবে তাদেরকে বোলিং দিয়ে ভালোই নাকাল করা হলো। ১৭১ রানে অলআউট। বিশ্বাসটা দৃঢ় হলো। এবার আমরা পারবোই।
কিন্তু ব্যাটিংয়ে নেমে সে কী দশা! লেফেব্রের সুইংয়ের সামনে টিকতে না পেরে আউট হলেন দুর্জয়, সানোয়ার, বুলবুল। রান তখন মাত্র ১৩! সেসময় ব্যাটিংয়ে নামলেন আকরাম খান। এবং কিছুক্ষণ পরেই আউট হয়ে গেলেন আতহার। রান তখন চার উইকেটে ১৫! ১৭১ তখন বহু দুরের পথ। আবারও স্বপ্ন ভঙ্গের নিশ্চিত আশঙ্কায় রেডিওতে খেলা শুনতে থাকা টাইগার ভক্তরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এই ভয়াবহ বিপর্যয়। এত সাধের টিমের এই হাল! এই ম্যাচ হারলে সোজা বাদ! আবার কত বছরের অপেক্ষা করতে হয় কে জানে! আকরাম খান আর মিনহাজুল আবেদীন নান্নু চেষ্টা করলেন একটি জুটি গড়ার। ভয়ানক প্রতিকূল পরিবেশে দাঁতে দাঁত চেপে ১৮.৫ ওভারে ৫৬ রান করলেন। তখন নামলো বৃষ্টি। রিভাইজড স্কোর হলো ৩৩ ওভারে ১৪১। ৮৫ বলে ৮৫ রান চাই। হাতে ৬টি উইকেট। নান্নু বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারলেন না আকরাম খানকে। খানিক বাদে আউট হয়ে গেলেন এনামুক হক মনিও। ৫৫ রান দরকার। ৮৬ রানে ৬ উইকেট পড়ে গেছে। আকরাম খান ছাড়া স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান কেউ নেই আর। আস্কিং রান রেট ছয়ের ওপরে। আর কীভাবে হবে! এখানে বলে রাখা ভালো, মালয়েশিয়ার পিচ ছিলো খুব স্লো আর বোলিং বান্ধব। আর্জেন্টিনা এবং ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ১৩৮ এবং ৯৮ রান চেজ করতে গিয়েই বাংলাদেশ হারিয়েছিলো ৫টি করে উইকেট। মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের সর্বোচ্চ রান করেছিলো। সেটা কত জানেন? ২১১ নয় উইকেটে! সে তুলনায় হল্যান্ড রীতিমত ভয়াবহ দল! নিশ্চিত পরাজয়ের চোখা রাঙানিতে সবাই নত হয়ে গিয়েছিলো, একজন বাদে। তার নাম আকরাম খান। পেসার সাইফুল ইসলামকে সাথে নিয়ে শুরু করলেন পাল্টা আঘাত। আমরা অতি উত্তেজনা আর অবিশ্বাসের সাথে অসম্ভব জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করেছি। সাইফুল ইসলাম অমূল্য ১৮টা রান করে যখন আউট হলেন, জয় তখন হাতের নাগালে। আর মাত্র ৫ রান দরকার তখন। খালেদ মাসুদ পাইলটকে নিয়ে নিরাপদেই সেই পথ পাড়ি দিলেন আকরাম খান।
অপরাজিত থাকলেন ৯২ বলে ৬৮ রান করে। এই ৬৮ রানের মধ্যে বাউন্ডারি ছিলো কটি জানেন? মাত্র ৩টি। এই ম্যাচের কোন ভিডিও নেই। থাকলে অবশ্যই আকরাম খানের এই বিরোচিত ইনিংসটি বাংলাদেশের সকল ব্যাটসম্যানের নিয়ম করে দেখা বাধ্যতামূলক করা হতো! ৪ উইকেটে ১৫ রান থেকে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে এমন অবিশ্বাস্য জয় এনে দিলেন আকরাম খান তার চওড়া কাঁধে পুরো দেশের স্বপ্নের ভার বহন করে! বীরত্ব আর নার্ভের চরমতম এই পরীক্ষায় বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানটি খেলতে নামলেও লেফেব্রে অথবা অসীম খানের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারতেন কি না তা বলা দুষ্কর।
আকরাম খান পেরেছিলেন। বলতে গেলে একাই জিতিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে, নিয়ে গিয়েছিলেন পরম আরাধ্য অর্জনের খুব কাছাকাছি।
এর পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে সহজেই হারিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপের টিকিট পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ফাইনালে কেনিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র উত্তেজনা পূর্ণ সেই ম্যাচটি তো বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথার অংশই হয়ে গেছে। এই ম্যাচটির হাইলাইটস পাওয়া যায়। দেখে নিয়েন।
আকরাম খান যদি নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচটি না জেতাতেন, তাহলে আমাদের ৯৯’র বিশ্বকাপে খেলা হতো না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জেতা হতো না। টেস্ট স্ট্যাটাস কবে মিলতো তার কোন ঠিক থাকতো না। ঠিক কত বছর পিছিয়ে যেত আমাদের ক্রিকেট তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। তবে নূন্যতম ৪ বছর তো বটেই! কে জানে হয়তো বা পরের বাছাই পর্বেও পুরো টুর্নামেন্ট ভালো খেলে এক ম্যাচে কিছু ভুলের জন্যে হারিয়ে যেতো। ইতিহাস তৈরি করতে একটি ইনিংসই যথেষ্ট। আর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতেও একটি ক্যাচ মিসই যথেষ্ট। আমাদের সৌভাগ্য আকরাম খান সেদিন কোন ভুল না করে এক অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেছিলেন। যার ফলশ্রূতিতে এখন আমরা বিশ্ব ক্রিকেটে একটি ডাকসাইটে দল। আমাদের খেলোয়াড়েরা সর্বোচ্চ সুবিধা পান। হ্যাট্রিক করেন। দ্বি-শতক হাঁকান। বিদেশী লীগে খেলেন। তারা সুখী, দর্শকরা গর্বিত।
এই সুদিন এনে দেয়ার জন্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখা আকরাম খান, আপনাকে হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই। শুভ জন্মদিন বীর। বেঁচে থাকুন, ক্রিকেটেই থাকুন।
ওহ, একটা কথা তো বলতে ভুলেই গিয়েছি! ওই ম্যাচে ২১ রানে দুটি উইকেটও পেয়েছিলেন আপনি। সেদিন আপনার ওপর কী ভর করেছিলো, একটু বলবেন?
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৪৫