সাম্প্রতিক সময়ের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র “বেলা শেষে” দেখে দু কলম লিখতে মন চাইলো। আমি এতদিনেও কেন সিনেমাটা দেখি নি তা নিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধব, ভাই বেরাদরেরা রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করতো। তাদের বক্তব্য ছবিটি শুধু যে বিনোদন দিয়েছে তাই না, এটায় শিক্ষামূলক অনেক কিছুও না কি আছে, যা বাস্তব জীবনে কাজে লাগালে সংসার এবং দাম্পত্য জীবন হবে আরো সুন্দর, এবং ফলপ্রসু। কোন সিনেমা আমার তখনই ভালো লাগে, যদি তাতে বিনোদন থাকে অথবা যদি ভাবনার খোরাক যোগায়। শিক্ষা অর্জন করার নিমিত্তে সিনেমা দেখি না। তবে এই সিনেমাটি থেকে যে উপলব্ধির জন্ম হয়, তা বাস্তবে কাজে লাগাতে পারলে অবশ্যই উপকার হবে । জীবনঘনিষ্ঠ সংলাপ এবং অভিনয় বেশ কবার আবেগাপ্লুত করেছে। এসব নিয়ে আপনারা অনেক কিছুই বলেছেন, লিখেছেন। তাই আমি আর কিছু যোগ করতে চাই না। আমি ভাবছি, সিনেমাটায় সম্পর্কের সুষম উন্নয়ন, এবং ভারসাম্যের নাম তুলে যেভাবে পুরুষতান্ত্রিকতাকে গ্ল্যামারাইজ করা হলো, সেই সম্পর্কে কেউ কিছু বলছেন না কেন? আবেগের সুগার কোটিংয়ে পতিব্রতা চরণদাসী নারীরূপের যে তেতো বড়ি গেলানো হয়েছে, আধুনিক নারীগণ তা গিলে নিলেন কীভাবে আমার মাথায় আসছে না। সিনেমাটি যে খুব খারাপ, তা বলছি না। কিন্তু এক বালতি দুধে এক চামচ মূত্র মেশালে যেমন তা খাবার অযোগ্য হয়ে ওঠে, তেমনই এই সিনেমাটিতেও এমন কিছু দৃশ্য, সংলাপ এবং ‘শিক্ষা’ আছে, যা ভালো অনুভূতি গুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করে ফেলেছে। এগুলো নিয়েই আমার এ লেখা। আমি চাইলেই আমার ডিজগাস্টকে নিজের মধ্যে রাখতে পারতাম, কিন্তু কেন এটা নিয়ে ব্লগ লিখছি? কারণ, সর্ব মহলে এর ভীষণ জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা। সিনেমা থেকে ‘শিক্ষা’র নামে যেভাবে পুরুষতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব দক্ষতার সাথে চাপিয়ে দেয়া হলো অতি আধুনিকা নারীর কাছেও তা কীভাবে গ্রহনযোগ্য হলো, এর কারণটা জানতে ভীষণ আগ্রহী আমি।
সিনেমার শুরুটা বেশ চমকপ্রদ । মিস্টার মজুমদার (সৌমিত্র চ্যাটার্জী) বিবাহের ৪৯ বছর পার করে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি আর তার স্ত্রীর সাথে (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) আর সংসার করবেন না। ডিভোর্স চাই তার। কেন ডিভোর্স চান? জ্ঞানী বন্ধুরা, আমি অনেক ভেবেও এর কোন যৌক্তিকতা পাই নি। তিনি ভালোবাসা নামক অভ্যাস এবং দায়িত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চান। পর্তুগাল কিংবা ফ্রান্সে গিয়ে তার ইউরোপিয়ান বন্ধুর সাথে ফূর্তি করতে চান। তিনি তা চাইলে করবেন, এতে এত নাটুকেপনার কী হলো? পুত্র-কন্যা-জামাই সবাইকে ডেকে ডিভোর্সের ঘোষণা দেয়া, শুধু ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত নন তিনি, কোর্টের পেপারওয়ার্ক পর্যন্ত করে রেখেছেন। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি, ডিভোর্সের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, তার স্ত্রীকে একা থাকতে শেখানো, সাবলম্বী করে তোলা। বাহ, কী মহান হৃদয় তার! ডিভোর্স নিয়ে তিনি ফূর্তি করে বেড়াবেন, আর তার স্ত্রী সংসারের সং সাজা বাদেও অফিস-আদালত-ব্যাংক ঘুরে ঘুরে নিজের জীবন নিঃশেষ করবেন, শেষ বয়সেও একটু শান্তি, স্বস্তি এবং আরাম পাবেন না, কী চমৎকার এবং বিবেচক সিংহহৃদয় পুরুষ তিন্ কী চমৎকার তার চিন্তাধারা! যেহেতু ছবিটাকে শিক্ষামূলক দাবী করছেন, সেহেতু আপনাদের উচিত বউকে দ্বিগুন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে ভীমরতি ধরলে একা একা আমেরিকা কানাডা চষে বেড়ানো। যদিও তিনি পরবর্তীতে তার সুমহান উপলব্ধি থেকে সরে এসে স্ত্রীর আঁচলের তলেই এসেছেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে সৌমিত্রের চরিত্রটি যে আমার দেখা অন্যতম বিরক্তিকর সিনেমা ক্যারেকটার তা নিঃসংকোচেই বলতে পারি।
আমার প্রধান দুটি আপত্তির কারণ বলার আগে আরো দুটি খাপছাড়া বিষয় উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। সৌমিত্রের এক কন্যা পরকীয়া করে। সে তার বাসার সামনেই গাড়ি নিয়ে ফিরে কিছুক্ষণ তার প্রেমিকের সাথে সময় কাটান, চুম্বন করেন। সেটা আবার তার স্বামী পর্দার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখেন। কিছুটা খাপছাড়া নয়?
আচ্ছা, তা না হয় মানা গেলো। এমন দু-একটি অসামাঞ্জস্য পূর্ণ দৃশ্য থাকতেই পারে সিনেমায়। কিন্তু সবাই মিলে স্টার জলসার সিরিয়াল দেখার মত আগ্রহে ক্যামেরা এবং সাউন্ডবক্স ফিট করে বাবা-মার বেডরুমের দৃশ্য দেখছে, কথোপকথন শুনছে গভীর আগ্রহে, এই অভূতপূর্ব বুদ্ধিটা পরিচালককে কে দিয়েছে এবং দর্শকরাই বা কীভাবে গিলেছে তা আমার বোধগম্য নয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো এসব দেখে শুনে বাবা-মার সমস্যার মূল ব্যাপারটা বোঝা। এবং যথারীতি তারা যতক্ষণ সেই সিন দেখছে, তার মধ্যেই বৃদ্ধ যুগল তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা গুলো বলে তাদের মনোবাঞ্জা পূরণ করেছেন। যেহেতু এটা একটি ‘শিক্ষামূলক’ ছবি, এবং এই সিনেমা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান চর্চা করে সংসারে শান্তি আনা সম্ভব, তাই সবিনয়ে আমার নিবেদন, ভাই-বোন-শালা-দুলাভাই-ভায়রা সবাই মিলে বাবা-মার বেডরুমের ভিডিও দেখুন। সুতীক্ষ্ণ নজর রাখুন। পারবেন? আপনেরাই বলেন যে এর মত বাস্তবসম্মত এবং জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা হয় না, আবার এইসব উদ্ভট ন্যুইসেন্সকেও সিনেমাটিক ডিমান্ড বলে সহি করতে চান, এমন দ্বিমুখিতা না করলে হয় না?
এবার আমি বলবো আমার সবচেয়ে জোরালো কিছু আপত্তির কথা, যেগুলো সিনেমাটির সমস্ত পজিটিভ মেসেজকে ধূলোমলিন করে দেয়।
শান্তিনিকেতনের বাড়িতে যখন তাদের বোধনপর্ব চলছিলো, তখন স্বাতীলেখা তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, “তুমি যখন মাছ খেয়ে উচ্ছিষ্ট গুলো রেখে দিতে, আমি সেগুলো খেতাম। আমার ভালো লাগতো।“
মধু! মধু! আমি মানছি দু বাংলাতেই এমন কিছু স্টুপিড, আত্মসম্মানহীন নারী আছে, যারা স্বামী সেবাকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্য মনে করেন। সুতরাং, আপনারা বলতে পারেন, এমন তো হয় ই! হয় বলেই দেখিয়েছে। আমার আপত্তি উপস্থাপন নয়। উপস্থাপনের ভঙ্গিতে। অভ্যাস থেকে ভালোবাসা বা ভালোবাসা থেকে অভ্যাস কীভাবে রুচি বিপর্যয় সৃষ্টি করে, সেটা দেখানো হয়েছে এমন ভাবে, যাতে দর্শক আবেগাপ্লুত হয়। আহা কী ভালোবাসা, বলে মরি মরি করে! ভাবতে অবাক লাগে যে এই সিনেমার দুই পরিচালকের মধ্যে একজন আবার মহিলা!
এটাই শেষ নয়। তিনি আরো বলেন,
“তুমি টয়লেটে গেলে আজকাল ভীষণ গন্ধ হয়। বড় বৌ মা ওগুলো পরিষ্কার করতে ঘেন্না করে। আমার কিন্তু ঐ গন্ধটাও ভালো লাগে।“
আই মিন, সিরিয়াসলি! এই একটা সংলাপেই তো পুরো সিনেমার প্রতি ভালো লাগাটা উবে যাবার কথা। আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারি নি এমন ডায়লগও থাকতে পারে! পতিব্রতা নারীর ভালোবাসা রান্নাঘর, এঁটোপ্লেট, বেটোকাঁটা থেকে শেষতক মল-মূত্রতে গিয়ে ঠেকেছে। ভালোবাসা আর অভ্যেসের দ্বন্দ্বকে তীব্রায়িত করতে গিয়ে নারীকে কোথায় নামিয়ে নিয়ে গেছে ভেবে অবাক হচ্ছি। এত এত ফেমিনিস্ট দেখি আশে পাশে তারা কেউ কিছু বললেন না কেন এ ব্যাপারে? নাকি আমি ওভার রিয়্যাক্ট করছি?
ছোটবেলায় জানতাম স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত। তিন তালাক দিলে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এসবই ছিলো কাঠমোল্লাদের ফতোয়া। বাংলাদেশে এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও এসব কথা কেউ মানে না। কিন্তু কোলকাতার বনেদী পরিবারগুলো আজও যে এই ধারা মেনে চলেছে, তা জেনে খুবই অবাক হলাম। আর প্রশ্নটা জাগলো, চলেছে বলেই সিনেমায় দেখিয়েছে, নাকি সিনেমায় দেখায় বলেই চলে? যে আচরণের প্রতিবাদ হিসেবে পরিচালক করতে পারতেন তীব্র ব্যঙ্গ, চরিত্র গুলি দিয়ে করাতে পারতেন প্রতিবাদ, সেখানে তিনি বরং এগুলো গ্লোরিফাই করতে চেয়েছেন।
মাঝখানে কিছু র্যান্ডম দৃশ্য ছিলো, কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা, স্মৃতি। সেখানে একটি দৃশ্য ছিলো এমন, স্বাতীলেখা তার স্বামীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন। দুঃখের বিষয়, এই দৃশ্যটি পরিচালকেরা আরো একবার রিপিট করেছেন। কেন রিপিট করলেন? কারণ এটা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এই দৃশ্যের আড়ালের যে প্রবঞ্চনা, সে বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন। আর দর্শকদেরও আবেগাক্রান্ত করে ভাবতে বাধ্য করেছেন, দেখ দেখ, বৃদ্ধা এই বয়সেও তার স্বামীকে কত ভক্তি শ্রদ্ধা করে, শেখো শেখো! হ্যাঁ, পাঠিকা, এই ছবি থেকে শিক্ষণীয় বিষয়ের তালিকায় এটাও রেখেছেন আশা করি!
সবশেষে, সেপারেশনের সময় নিজের জামা-জুতো খুঁজে নেয়া, এবং চা বানানোর ঝক্কিটা ঝামেলাপূর্ণ মনে হওয়াতে মহারাজা তার রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন চার মাস পর। এসেই তার সে কী ভাব! “আমি যে এসেছি, তাতে তুমি খুশি হও নি?”। তার চাকরানী ওরফে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন। লক্ষ্য করুন, “তোমার কাছে আসতে পেরে আমি খুশি হয়েছি” নয় কিন্তু! “আমি এসেছি দয়া করে, এখন আমার সিংহ আসন পরিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত হও”। এই হলো সৌমিত্র, তথা পরিচালকদ্বয়ের মনোবৃত্তি। এর মাঝে চাকরানী স্বাতীলেখা অফিস-আদালত-ব্যাংকে যাতায়াত করে স্বাবলম্বী হতে পেরেছেন। কিন্তু হাজার হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিকতার যে প্রভাব তিনি বয়ে চলেছেন, তা থেকে মুক্তি পাবেন কী করে? পরিচালকরাই বা কেন মুক্তি দিবেন, যেখানে আমাদের মা-খালা-বোন’রা এত টুকু ভালোবাসার জন্যে উদয়াস্ত খাটেন, সবার সামনে সগর্বে ডিভোর্সের অপমান সয়ে নিয়ে শুধু হিজ হাইনেজের খুশিতে নিয়োজিত হতে ব্যস্ত থাকেন? দর্শকরা তো এটাই খাবে! তো গিলিয়ে দাও না জোর করে! কুইনাইনের মত। খেতে তেতো, কিন্তু গিলে ফেললে অশেষ উপকার এবং আনন্দ! পরাধীনতার স্বাধীনতা পাবার আনন্দ!
চাকরানীর চোখ ছলছল হয়ে উঠলো স্বামীর ‘কষ্টের’ বিবরণী শুনে। তিনি ফিরে গেলেন সাবলম্বী নারীর সম্মানজনক অবস্থান থেকে চরণদাসীর ভূমিকায়। দিলেন সেই বিখ্যাত ডায়ালগ,
“ঠাকুর যেন তোমাকে আমার আগে নিয়ে নেন। কারণ, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো। কিন্তু তুমি আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না”।
বাহ! বাহ! বাহ! কী টাচি একটা ডায়ালগ! এত কিছুর পরেও সাবলম্বী নারী সেই চাকরানীর পথেই ফিরে গেলেন। স্বামী দেবতাকে তুষ্ট করার মাঝেই তার জীবনের সার্থকতা প্রমাণ করলেন। থাকো তুমি বেঁচে স্বামী, জামা, জুতো, জাঙ্গিয়া খুঁজে দেবো আমি। এবং পাবো অর্গাজমের আনন্দ। সাবাশ পরিচালক! সাবাশ স্ক্রিপ্ট রাইটার! সাবাশ অভিনেত্রী! সাবাশ!
নারীগণ, আপনারা কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যান। চোখ মুছে আলু ভাজি করতে যান। দুপুরের ভাতঘুমের সময়ে পতি দেবতা এক গ্লাস লেবুর শরবৎ খেতে চাইলে পড়িমড়ি করে চোখ কচলে দৌড়ান। ঘর-রান্নাঘর-বারান্দা। আপনি সাগর দেখবেন না, পাহাড় দেখবেন না, এই বিশাল পৃথিবীর কিছুই দেখবেন না। শুধু স্বামীর সেবা করার লাইসেন্সটা দেয়া হবে, সেটাই আপনার সংসারে টিকে থাকার ভিসা। এবং বছরে বছরে সেটা রিনিউ করে মজে থাকবেন এক আবদ্ধ ইউটোপিয়ায়।
এমনটাই আমরা দেখতে চাই।
এমনটা দেখেই আমরা খুশি।
এমনটাই তারা দেখাতে চান।
ছবি হিট, এবার বাড়ি ফিরে যান।
খুদাপেজ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৪