(১)
উৎকণ্ঠিত মুখে ফোনের বাটন গুলো চাপছে জয়া। আসিফের সাথে তার কথা বলা দরকার। ফোন ধরছে না কেন? সর্বনাশ হয়ে যাবে তো!
-এতক্ষণে ফোন ধরলে? তোমার সাথে খুব জরুরী কথা আছে। খুব জরুরী।
-কী এমন জরুরী কথা যে সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠালে?
হাই তুলছে সে। কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।
-সাত সকাল নয়। এখন এগারটা বাজে।
-ছুটির দিনে ওটাই সাত সকাল।
-আচ্ছা! শোনো তুমি আজ ঘর থেকে বেরুবে না। একদম না।
-কেন? কী হয়েছে?
-কিছু হয় নি, কিন্তু কিছু হতে পারে। ইয়োর লাইফ ইজ এ্যাট স্টেক।
-তাই নাকি? আমি যে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলাম তা সবাই জেনে গেছে?
-ফালতু কথা বলবা না। সিরিয়াসলি নাও ব্যাপারটা। তোমার সাথে সক্কাল সক্কাল ফাজলামি করার জন্যে ফোন করি নি আমি। আমার অত তেল নাই এখন আর।
-হ্যাঁ, একসময় খুব তৈলাক্ত বস্তু ছিলে বটে। এজন্যেই তো তোমাকে ধরতে গেলে বারবার পিছলে যেতে।
-কেন কী করেছি, কে দোষী আর কে নির্দোষ এসব মীমাংসা পরে হবে। আমি জানি তোমার প্রতি এত অধিকার ফলানো আমার আর শোভা পায় না। তবুও, কারো আসন্ন বিপদ সম্পর্কে জেনেও তাকে সাবধান করবো না এমন অমানুষ তো আমি নই।
জয়া কি অভিমান করছে? তার কণ্ঠে এমন বিপন্ন ক্লান্তি কেন? ব্যাপার কি আসলেই সিরিয়াস? এতদিন পরে, এত কিছু ঘটে যাবার পরেও জয়া কি পেরেছে সব তিক্ততা ভুলে যেতে? বিভ্রান্তি কাটিয়ে মূল ঘটনা জানতে মনোযোগী হলো আসিফ।
-ব্যাপার কী বলো তো?
-শোনো, ফোনে এত কিছু বলতে পারবো না। আজ বিকেল পাঁচটার দিকে আমি তোমার বাসায় আসবো। এর মাঝে কোথাও যেও না।
খানিক বিরতি নিলো জয়া। আর এর মাঝে আসিফ খতিয়ে ভেবে নিলো ঐ সময়টায় বাসা পুরোপুরি ফাঁকা থাকবে কি না। জয়া বহুত পিছলিয়েছে। এবার কি নিজে থেকেই ধরা দিতে যাচ্ছে? বিশ্রী একটা রসিকতা করতে গিয়েও থমকে গেলো জয়ার পরবর্তী বাক্যটি শুনে।
-জলিকে বিশ্বাস করো না। ও খুব প্রতিশোধপরায়ন।
আসিফকে চমকে দিয়ে ফোন রেখে দিলো জয়া। বলতেই হবে এমন টা সে মোটেও আশা করে নি। জলি প্রতিশোধপরায়ন নাকি ক্ষমাশীল, তাতে কী এসে যায়! তার সাথে তো কোন অন্যায় করে নি সে। তার বিপন্ন জীবন, জলির প্রতিশোধ পরায়নতা, এসবের মধ্যে কোন সংযোগ আছে না কি? জয়া তো কিছুই খোলসা করে বললো না। ওকে ফোন করে লাভ নেই জানে সে। জয়া একবার ফোন কেটে দিলে সারা দিনে আর ধরে না। সাবেক সেই অভিমান যে এখনও রহস্যপ্রিয়তা আর নাটকীয়তার আবরনে ক্রিয়াশীল আছে এই বিকিরণটা সে ভালোভাবেই অনুভব করতে পারে এখনও, অনেক দূর থেকেও। তবুও সে ফোন করলো, এবং যথারীতি কেউ ধরলো না। জলিকে ফোন করতে গিয়ে মনে হলো, গতকাল সারাদিন তার সাথে কোন যোগাযোগ হয় নি। এটা খুব অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। অবশ্য উইকেন্ডের রাতে আসিফ সুধারসে মজে থাকে। সেদিন তার সাথে জলির কথা হয় কি না তাতে তার কিছুই এসে যায় না। তবে জলি তাকে ঠিকই ফোন করে। এর ব্যত্যয় হয় নি কোন দিন। গতকাল ফোন করলো না কেন? জলি কে কি কোন ভাবে সে আঘাত দিয়েছে? মনে করার চেষ্টা করলো সে প্রাণপনে। গত এক মাসে সে তিন বৃহস্পতি রাত্রে তার ব্ল্যাক আউট হয়েছে। ওই সময়ের কোন কথাই তার মনে পড়ছে না। কোন ঝগড়া হয়েছিলো? কিংবা অতীতের ক্ষতে বিছুটি পাতা? অথবা ইগোর দ্বন্দ্ব?
জলির নাম্বারে ফোন করে বন্ধ পেলো। জয়া তাকে জীবন বিপন্ন বলে যে সাবধানতা বাণী দিয়েছিলো সেটা সে গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু জলির ব্যাপারটা তাকে ভাবতে বাধ্য করছে। এই মুহূর্তে দুজনের যে কোন একজনের সাথে কথা বলা খুবই দরকার। নেই কেউ। একজন ফোন ধরছে না, আরেকজনের ফোন বন্ধ। নাহ! এইসব মাতারিদের সাথে অভিমান আর ইগো খেলার কোন দরকার নাই। তার এখন দরকার একটা ঘুম। একটা আন্তর্জাতিক মানের ঘুম! তবে বাইরে যাবে কি না সেটাও ভাবছে। এমনিতে সে শুক্রবার দিনে কখনও বাইরে যায় না। তবে জয়া মানা করেছে দেখেই তার মধ্যে ইচ্ছেটা উদগ্র হয়ে উঠছে। এহ! লাইফ এ্যাট ইজ স্টেক, শুভাকাঙ্খা, যতসব আজে বাজে কথা! সে বাইরে যাবার জন্যে শার্ট খুঁজতে গেলো, ঠিক সেই সময়েই জয়া ফোন করলো।
-আমার যদি ভুল না হয়, তাহলে গত এক ঘন্টায় তুমি গভীর ভাবে ভেবেছো নিজের কোন গলতি আছে কি না। তারপর কোন উত্তর না পেয়ে আমাকে গালি দিয়ে বাইরে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছো অথবা নেবে। কথা কি ভুল বললাম? তোমাকে একটা খোলা বইয়ের মতই পড়তে পারতাম আগে। এখনও পারি কি না জানি না।
-কী হচ্ছে এসব! দেখো, আমি বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না। যা বলার এখানেই বলো। কেন আমার লাইফ এ্যাট স্টেক?
-অত টেনশন করো না। একটা লম্বা ঘুম দিয়ে নাও। যত দূর জানি তোমার বাবা-মা বিকেল তিনটার বাসে যশোর যাবে। তারপর বাসাটা ফাঁকা হলে পরে তখন আমি আসবো। জানি, এ কথা শুনে প্রথমেই তোমার মনে হবে সেক্সের কথা। ফাঁকা বাড়ি, তুমি আর আমি! কতবার এরকম করতে চেয়েছিলে! হাহা! অবশ্য এখন তো তুমি অন্যের সাথে কমিটেড। তাই আশা করি তোমার বিবেকের উন্নয়নে বিশ্বস্ততা বজায় থাকবে। অবশ্য তোমাকে যে কথা গুলো বলবো, তা শোনার পরে তোমার মধ্যে যৌনবাসনা কত টুকু কাজ করবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান ।
দীর্ঘ বক্তব্য শেষে জয়া মিটিমিটি হাসলো। সে জানে সম্ভাব্য সবচেয়ে সঠিক কথাগুলোই সে বলেছে।
-তুমি এত কিছু জানো কীভাবে! অদ্ভুত তো! স্পাই লাগাইছো না কি?
-তোমার প্রেমিকাদের কাছে যে তুমি হড়হড় করে সব বলে ফেলো, তা তো জানিই! জলির সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ কিছু সময় কেটেছে আমার। আমরা কিছু কথা শেয়ার করেছি একে অপরের সাথে। হয়তো বা নতুন পাওয়া বন্ধুত্বের উৎফুল্লতায় এমন কিছু বলে ফেলেছি, যা না বললেও চলতো। যা তোমার প্রেমিকার মধ্যে হিংস্র, খুনে মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে।
-তুমি কী বলেছো ওকে?
-যা বলেছি, তা খুন করার মত যথেষ্ট প্রণোদনা যোগাতে পারে। বিশেষ করে তার মত কোন ক্রেইজি বিচের জন্যে। তুমি ওকে কি জাদু করেছো বলো তো?
-দেখ জয়া, আমাদের সম্পর্কটা হয়তো বা নানা কারণে পূর্ণতা পায় নি। কিন্তু এজন্যে একক ভাবে কাউকে দায়ী করা যায় না। তোমারও দোষ ছিলো, আমারও। এখন তাই বলে তুমি এভাবে আমার বর্তমান রিলেশন টাকে ধ্বংস করে দেবে? ব্ল্যাকমেইল করবে?
-ব্যাপারটা ব্ল্যাকমেইল না। জলির সাথে আমার প্রগলভ কিছু মুহূর্তের দুর্বলতায় কিছু কথা বলে ফেলেছি। সেটা যে তোমার জন্যে জীবন সংহারী হয়ে যাবে তা ভাবি নি। আমি তো তোমার অমঙ্গল চাই না। এজন্যেই তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি।
-হইছে! হইছে! থামো এবার। জলির কাছে তুমি কি না কি বলেছো, তাতে সে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে খুন করে ফেলতে চাইছে, এবং সেটা আজই। আমি বাইরে বের হলেই সে আমাকে তাড়া করে মেরে ফেলবে। এইসব কথা আমি বিশ্বাস করবো বলে ভাবছো? ষড়যন্ত্র নির্মাণে তুমি বড়ই কাঁচা বেইবি!
-আমার কথা তোমার কাছে গুরুত্বহীন মনে হতেই পারে। কারণ জলি তোমাকে খুঁজে ফেলে খুন করে ফেলবে, এটা আসলেই কষ্টকল্পিত। তবে এটা কেন ভাবছো না যে এই শহরে অনেক পেশাদার খুনী পাওয়া যায়? তোমার ঘরের উত্তর দিকের জানালা দিয়ে পেয়ারা গাছটি পেরিয়ে সেলুনটার সামনে দেখো, একজন ন্যাড়া মাথার ষণ্ডা মার্কা লোক তোমাকে নজরে রাখছে। আই মিন, রাখার কথা আর কী। জলি আমাকে এমনই বলেছিলো। দেখো তো আছে কি না!
(২)
ব্যাপারটা বেশ ঘোঁট পাকিয়ে উঠেছে, আসিফের নার্ভের ওপর দিয়ে বেশ ধকল চলছে। মোটেও দুই ক্রেইজি বিচের সামান্য চুলোচুলি নয়। অনেক কিছুই অবশ্য জানার বাকি আছে এখনও। জলি আর জয়া কীভাবে একে অপরের সাথে পরিচিত হলো, তাদের মধ্যে এক্সাক্টলি কী কী কথা হয়েছে, এসব জানতে পারে নি সে। এসব সে থোরাই কেয়ার করতো যদি না সে মাঝখানে একবার বাসা থেকে বের হবার চেষ্টা করতো। ষণ্ডা মত লোকটা আসলেই তাকে ফলো করছিলো। ভয় পেয়ে বাসায় ফিরে এসে আবার জানালা দিয়ে ওখানে তাকালে তার সাথে চোখাচোখি হলো। সে শিকারী চোখে তাকিয়ে হাসলো। তুষার চিতা যেমন করে আলস্যে রোদ পোহায়, তেমনি ভাবে বুনো লোকটা আয়েশ করে বসে আছে। সিগারেট টানছে। কোন তাড়াহুড়া নেই তার মাঝে। জয়া কেন আসতে চাচ্ছে সেটাও স্পষ্ট নয়। আপাতত ওর কথা মত চলা ছাড়া কিছুই করার নেই। যেভাবে সেলুনের লোকটার কথা মিলে গেলো, তাতে আশঙ্কা না করে উপায় কী! জয়া তাকে বলেছে, সে এই হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড থামাতে পারবে, তবে এ জন্যে তার সাথে একটা সিটিংয়ের প্রয়োজন আছে। ফাঁকা বাসায় জয়ার আগমন সম্ভাবনাও তার মাঝে কোনরকম উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারলো না। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। কখন যে পাঁচটা বাজবে!
(৩)
-স্যরি দু মিনিট দেরী হয়ে গেলো।
-ইট’জ ওকে।
-বাসায় কেউ নেই তো?
-না।
-তোমার জানালা দিয়ে উকি মেরে দেখো তো, এখনও সেই লোকটা আছে কি না!
-না, সে নেই। তুমি কি তাকে ভাগিয়েছো নাকি?
-হ্যাঁ। দ্যা মোমেন্ট অফ ট্রুথ হ্যাভ কাম। ধরে নিতে পারো জলির খুন পরিকল্পনার সাথে আমিও জড়িত ছিলাম। তাই সব খুঁটিনাটি জানি। বেচারা মেয়েটা! খারাপই লাগছে ওর জন্যে। ওর পরিকল্পনা এভাবে নস্যাৎ করে দিলাম, এটা জানলে নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবে না সে। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে আমরা দুই জনে মিলে একজন কন্ট্রাক্ট কিলারের এ্যাপয়ন্টমেন্ট নিয়েছিলাম। দিলাম ক্যান্সেল করে।
-তুমি...তুমি ত ত ত
-হইছে, এত তোতলায়ো না। হ্যাঁ, আমি খুনের পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলাম। তবে সেটা তোমাকে রক্ষা করার জন্যেই। আমি চাই নি তুমি জলির হাতে মৃত্যুবরণ করো। হাজার হোক, একসময় তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তাই ওর কাছ থেকে সব কিছু জেনে নিয়ে তোমাকে উদ্ধার করতে চেয়েছি।
-সত্যি? ওহ গড! কী যে ঘটছে আমার ভেতর! তুমি...তুমি এখানে এসেছো কেন?
-তোমাকে জলির কাছে পৌঁছে দিতে।
-মানে?
-জলি ইজ ডেড বেইবি।
-কি ক্কি! তুমি...
-বেশি কথা বা বিশ্লেষণের সময় নেই। সে হ্যালো টু মাই লিটল ফ্রেন্ড!
হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটি পিস্তল চলে এলো জয়ার হাতে।
-যদি এটাকে নকল ভেবে থাকো তাহলে ভুল করবে। তোমাকে খুন করার ইচ্ছে আমার অনেকদিন ধরেই। তবে যেনতেন ভাবে তো আর খুন করা যায় না! তোমার মত খেলারামের মৃত্যুর মধ্যে কিছু সাইকোলজিক্যাল গেম, কিছু টুইস্ট না থাকলে কি আর তা মানায়? তাই তো এত গল্প ফাঁদা, তাই তোমায় একলা ঘরের প্রলোভন দেখানো, জলির সাথে কিছু মিথ্যে বলা। তবে জলিকে খুন করার কথা কিন্তু মোটেই মিথ্যে না। এই নাও, দেখো তো এ চোখ দুটো তোমার চেনা কি না!
পিস্তল তাক করে রেখেই সে অভিনব নিপুনতার সাথে তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দুটি রক্তাক্ত মানবচক্ষু ছুড়ে দিলো আসিফের দিকে। আসিফ ততক্ষণে নিজের সমস্ত সম্মান এবং শক্তি বিসর্জন দিয়ে উন্মত্তের মত বিলাপ করছে, কাঁদছে, প্রাণভিক্ষা চাইছে।
-তোমাকে খুন করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। তবে এও মন্দ নয়, তোমার এভাবে কুকড়ে মুকড়ে গিয়ে গুটিয়ে যাওয়া দেখা টা। মোটামুটি সন্তোষজনক এন্টারটেইনমেন্ট। তোমার সেই বিশাল পেনিসটা, যা দিয়ে তুমি জলিকে করেছো, আনফরচুনেটলি সেটা এখন খুব দেখতে ইচ্ছা করছে আমার। হ্যাঁ প্যান্ট খুলে ফেলো। এই তো লক্ষ্মী ছেলে। এবার...হাহা! এত চুপসে আছে কেন ওটা! এই তোমার সেই কথিত গালিভার! বেচারা! তোমাকে একশ সেকেন্ড সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি তুমি ওটাকে ইরেক্ট করে জলি মাগীটার দুই চোখের জলীয় তরলকে লুব্রিকেন্ট হিসেবে ঘষে ইজাকুলেশন করতে পারো, তাহলে তুমি বেঁচে যাবে। নয় তো মরণ। ঠিকাছে? আমি গোনা শুরু করছি।
১০০, ৯৯, ৯৮...
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৫৬