একটি অতীব বিজ্ঞানসম্মত দিন কাটানোর গল্প
আমি একজন প্রোগ্রামার। কারো সাতে পাঁচে নেই। ঘরে বসে কোডিং করেই দিন কাটে। মোটামুটি শান্তিপূর্ণ, নিরুদ্বেগ জীবন কাটাই। মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের টাকাটা বউকে দিয়ে দিই। ব্যাস, আমার দায়িত্ব শেষ। সংসারের ম্যানেজমেন্ট বোঝা আমার কম্ম না, সেটা আমার কাছে রীতিমত এক বোঝা! ভাগ্য ভালো যে আমার বউ খুব ভালো একজন ম্যানেজার। বাজার করা, যাবতীয় বিল দেয়া, সবই সে করে। তো সেদিন সকালে আমি হেডফোনে হেভি মেটাল গান শুনতে শুনতে কোডিং করছিলাম। হঠাৎ সে এলো গজরাতে গজরাতে।
-এই ওঠো। বাজারে যেতে হবে। দুপুরে আব্বা আসবে। তাড়াতাড়ি যাও। দুই কেজি পোলাওয়ের চাল আনবা। আর যদি সরিষার তেল দেখো, তাহলে পাঁচ কেজি আনবা।
আমার সুন্দর সকাল টাকে সে নির্মম আঘাতে ছিন্ন করে দিলো। নতুন একটা প্রোগ্রামের এ্যালগরিদম নিয়ে বসেছিলাম, তার মাঝে এই ঝামেলা? নাহ! বেশি তর্ক করা ঠিক হবে না। দ্রুত যাবো আর আসবো। তর্ক করলে খামোখা সময় নষ্ট হবে। কী দরকার! তাই আমি রিকশা নিয়ে বাজারে গেলাম। দুই কেজি পোলাওয়ের চাল কিনলাম। দেখলাম সরিষার তেলও আছে। তাই আরো পাঁচ কেজি পোলাওয়ের চাল কিনে ফেললাম। সর্বমোট সাত কেজি চাল কিনে মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। কাজটা মোটেও অতটা জটিল না। আমিও পারি। হুহ হু! বউ নিশ্চয়ই আমার কর্ম কুশলতায় খুশি হবে খুব! বুক ফুলিয়ে তার কাছে গিয়ে ব্যাগটা হস্তান্তর করলাম।
-এই নাও তোমার সাত কেজি চাল।
কিন্তু তাকে দেখে মোটেও খুশি মনে হলো না। দেখে মনে হচ্ছে আমাকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবং বলতে না বলতেই সে ফেটে পড়লো।
-সাত কেজি চাল আনলা কোন আক্কেলে? তোমাকে আমি কী বলেছিলাম ভুলে গেছ?
-মোটেও ভুলি নি। আমি দুই কেজি চাল কিনেছি। তারপর দেখলাম সরিষার তেল আছে। তাই আরো পাঁচ কেজি চাল নিলাম। মোট সাত কেজি। সহজ হিসাব!
কিন্তু তাকে মোটেও সন্তুষ্ট মনে হলো না এই ব্যাখ্যায়। সে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করছে! অবিকল বাংলা সিনেমার চৌধুরি সাহেবের মত করে বলছে,
“বেরিয়ে যাও, এখনই বেরিয়ে যাও ঘর থেকে!”
তো কী আর করা! ভগ্ন হৃদয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘন্টা দুয়েক ডুব দিয়ে থেকে আবার বাসায় ফিরে যাবো। এই সময়টায় বড় রাস্তার মোড়ের কফিশপটায় কাটানো যায়। রাত জাগতে হয় বলে আমার কফির অভ্যেস হয়ে গেছে। বড় এক মগ ব্ল্যাক কফি নিয়ে ওয়েটার এবং কফিখোরদের সাথে গুলতানি করে সময়টা বেশ কেটে যাবে।
সেখানে গিয়ে দেখা পেলাম সোবহানের। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। পেশায় কেমিস্ট। খালি মগ নিয়ে বসে আছে, আর একটু পর পর চুমুক দিচ্ছে। ভুলোমনা আর কাকে বলে! কারো ভুল ধরিয়ে দিতে আবার আমার খুব ভালো লাগে। সম্প্রতি ঘটিত জীবনের করুণ অধ্যায়ের কথা ভুলে আমি ফূর্তির সুরে বলে উঠলাম,
-আরে দোস্ত, তুমি করছো টা কী! খালি গ্লাসে চুমুক দিচ্ছো কেন বোকা!
প্রশ্নটি শুনে তার মধ্যে বিরক্তি এবং তাচ্ছিল্যের একটা যৌথ ভঙ্গি ফুটে উঠলো। প্রতিদ্বন্দ্বী বিতার্কিকের দুর্বল যুক্তি শুনলে অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষ এভাবেই তাদের ভাব প্রকাশ করে থাকে। তারপর ক্লিন্ট ইস্টউডের মত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-তুমি ভুল! এই গ্লাসটি পুরোটাই ভরা। বিশূদ্ধ বাতাস দিয়ে। এই কফিশপের বাতাসটা বড্ড ভালো। তুমিও খেয়ে দেখতে পারো চাইলে।
হুহ! আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! বসে বসে বাতাস খাবো! এসব বিকারগ্রস্তের কথায় কান দেয়াটাই বৃথা। রোষের সাথে রূঢ় ভঙ্গিতে তার টেবিলটা ত্যাগ করলাম।
সামনে এগিয়ে দেখি ‘হিলিয়াম’ এসেছে কফি পান করতে। কিন্তু কী বিশ্রী ব্যাপার! ওয়েটার তার সাথে যা তা ব্যবহার করছে। সাফ সাফ বলে দিলো- “আমরা নিষ্ক্রিয় গ্যাসদের কফি সার্ভ করি না”। আমি ভাবলাম হিলিয়াম নিশ্চয়ই এবার খুব ক্ষেপে যাবে। একটা মারামারি না লেগেই যায় না! বিনি পয়সায় এমন এ্যাকশন দেখতে কার না ভালো লাগে! কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে সে কোন ‘React’ করলো না। ভাঙা মন নিয়ে আমার কোণার টেবিলটায় ফিরে যাওয়াটাই স্থির করলাম। আমি সবসময় এখানেই বসি। কিন্তু সেখানে পটাসিয়াম আর অক্সিজেন বসে আছে। আমি ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম,
-কী খবর?
পটাসিয়াম বললো,
-OK
অক্সিজেনও প্রতিধ্বনি করলো,
-OK
আমি তাদের এই শীতল আচরণে দুঃখিত হলাম। তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর সূক্ষ্ণ চেষ্টা চালালাম।
-জানো পটাসিয়াম, কালকে আমি অক্সিজেনকে কার সাথে দেখেছি? ম্যাগনেসিয়াম! আমার কথা শুনে পটাসিয়াম বিস্ময়ে অভিভূত হলো,
-Omg
অক্সিজেন ভাবে নি আমি এই কথাটি ফাঁস করে দেবো। সেও অবিশ্বাসে বিড়বিড় করতে লাগলো,
-Omg
তাদেরকে যথোচিত শিক্ষা দেয়া হয়েছে ভেবে আমি সন্তুষ্ট চিত্তে অন্য একটি টেবিলে চলে গেলাম। এদিকে দিনের শুরুতেই কোত্থেকে যেন দুই মাতাল কেমিস্ট এসে বসলো কফিশপটায়। ওরা তো চাইলেই এ্যালকোহল উৎপন্ন করতে পারে। তাই খেয়েই মনে হয় বিগড়ে গেছে। সমানে ইংরেজিতে কথা বলছে। বিরক্তিকর অবস্থা। ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলো তাদের,
-কী নিবেন?
প্রথম জনের খুব পানি পিপাসা পেয়েছিলো। সে বললো,
-I want H20
তাকে পানি এনে দেয়া হলো।
দ্বিতীয়জন তখন জড়ানো গলায় মুখ খুললো,
-I want H20 too.
তাকে এনে দেয়া হলো। সে পান করলো এবং মারা গেলো।
বিচ্ছিরি রকম গ্যাঞ্জাম লেগে গেলো। কোলাহল এবং চিৎকারে তিষ্টানো দায়। আমি এক ছুটে পালিয়ে এলাম সেখান থেকে। কেমিস্ট দের আড্ডাখানা কখনই সময় কাটানোর জন্যে উত্তম স্থান হতে পারে না।
দু ঘন্টা এখনও হয় নি। আর তা ছাড়া দৌড়াদৌড়ি করে এত ঘেমে নেয়ে গেছি, বাসায় ফিরলে আবারও বৌ এর রুদ্রমূর্তির সম্মুখীন হতে হবে। তাই বাসায় না গিয়ে কিছুক্ষণ পার্কে সময় কাটাবো ভাবলাম। সেখানে আবার নতুন আপদ! তিন জন লোক সমানে আমার পাশের বেঞ্চিটায় বসে বকবক করছে। তাদের আলাপচারিতা থেকে বোঝা গেলো, তাদের একজন পদার্থবিদ, একজন ইঞ্জিনিয়ার, আরেক জন পরিসংখ্যানবিদ। তাদের সামনে এক বেচারা বন্দুকঅলা তার বেলুনগুলো নিয়ে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না তাদের এমন বিতণ্ডার। আমাকে দেখে তারা যেন হালে পানি পেলো! পরিসংখ্যানবিদ আমার কাছে এসে বললো,
-এই যে ভাই শোনেন, আমাদের ঝামেলার কথাটা আপনাকে বলি। আমরা বেলুন ফোটানোর খেলা খেলছি। প্রথমে পদার্থবিদ মজনু নানারকম এ্যাঙ্গেল, গতিশক্তি, ইত্যাদি ব্যবহার করে গুলি ছুড়লো। তা পড়লো বেলুনের পাঁচ মিটার পেছনে। ইঞ্জিনিয়ার কিসলু নানা ক্যালকুলেশন করে একটা ফায রেজিস্টেন্স হিসেব করে গুলি ছুড়লো। তা পড়লো পাঁচ মিটার আগে। তা দেখে আমি হাত তালি দিলাম। বেলুনের অবস্থান নির্ণিত হয়েছে! বলেন, আমি কী ভুল কিছু বলেছি? আপনিই বলেন!
নাহ! আজকে হলোটা কী! যেখানে যাই সেখানেই গ্যাঞ্জাম। বাসায় গিয়ে একটা কড়া ঘুম দিতে হবে। না হলে কোডিং করা মাথায় উঠবে।
ঘন্টা দুয়েক পরের কথা। বাসায় ফিরে পোলাও আর মাংস খেয়ে মারাত্মক একটা ঘুম দিয়েছি। ঘুমের মধ্যে দেখি, আমি স্বর্গে পৌঁছে গেছি। সেখানে নিউটন, আইনস্টাইন আর প্যাসকেল লুকোচুরি খেলার আয়োজন করেছে। আইনস্টাইন হলো ‘চোর’। প্যাসকেল লুকোতে গেল। কিন্তু নিউটন ঠাঁয় বসে থাকলো। বসে বসে তার চারিদিকে ১ বর্গমিটারের একটি স্কয়ার আঁকলো। আইনস্টাইন চোখ খুলে তো মহা খুশি! “এই যে নিউটন, তোমাকে পেয়ে গেছি!”। জবাবে নিউটন বললো, “এই মুহূর্তে আমি নিউটন না। প্যাসকেল।”
ঘুম ভেঙে গেলো আমার। আব্বাজান আসার কারণে বউয়ের মন বেশ ভালো। আমাকে দেখে সহৃদয় কণ্ঠে বললো, “ঘুম ভেঙেছে? কফি বানিয়ে দিই?”
প্রশ্নটি শুনে আমি রীতিমত আতঙ্কিত! প্রবল ভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম,
“প্লিজ ঐ কথাটি আর ভুলেও উচ্চারণ করো না, খোদার কসম লাগে!”
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৪