মিঠিকে আমি ভালোবাসি। ওর বুকে বকুলফুলের গন্ধ আছে। ওর ঠোঁটে কামরাঙা ফলের সুবাস। যতবারই আমি কামজর্জরিত হয়ে ওর রাঙা ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছি, ততবারই আবিষ্কার করেছি এক নতুন বোধ, আনকোরা অনুভূতি, যা প্রেম কাম দেহ মন সবকিছুর ঊর্ধে এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে, যা সময়, সমাজ, বিজ্ঞান, সাইকোলজি, ফিজিক্স, মেডিকেল, রসায়ন কোনো কিছু দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না। চুম্বন আর চুম্বক যেন দুই জমজ বোন, হাত ধরাধরি করে বসে থাকে। একে অপরের থেকে বিযুক্ত করা খুব কঠিন। মিঠির চুলে হাসনাহেনার গন্ধ আছে। হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সর্পজাতি খুব প্রলুদ্ধ হয়। আমি মিঠির চারপাশে অনেক সর্প দেখি। ওরা চায় মিঠির চুলের গহীন অরণ্যে বসবাস করতে। ওরা চায় হাসনাহেনার তীব্র সুবাসে মাতোয়ারা হয়ে চল্লিশ কোটি বছর উন্মাতাল নাচতে। চাইলেই হলো আর কী! আমি মিঠিকে উপহার দেই কার্বলিক এসিড। ও তা নিয়ম করে চুলে মাখে। বিষাক্ত সরিসৃপের দল তিরোহিত হয়। মিঠির নাকটা গ্রিক দেবীদের মতো খাড়া। একটু ছুঁয়ে দিলেই তা রক্তের উচ্ছাসে প্লাবিত হয়ে লালচে বর্ণ ধারণ করে। আর তখন হাজার জোনাকপোকা তাদের ঝোপঝাড় থেকে উঠে এসে আলোকআদর জানায় তাকে। আর তার চোখ! তার এক ফোঁটা অশ্রূ ধারণ করে মহাসাগরের বিশালতা। সেখানে আমার অবাধ সন্তরণ। ওর চোখের গভীরে ডুবে যেতে যেতে যেতে আমি আহরণ করি কিছু নিঃসঙ্গ , বিষাদাক্রান্ত শঙ্খ। শঙ্খের হাহাকার চোখে নিয়ে দুঃখবিলাসী মেয়েটা যখন আমার দিকে তাকায়, আমি তখন উদভ্রান্ত বোধ করি। আমার তখন ভীষণ তেষ্টা পায়। ইচ্ছে করে ওকে কাঁদিয়ে ওর নোনাজল পান করে তৃষ্ণা মেটাই। এমন পিপাসা আমার! কিন্তু মিঠি সহজে কাঁদে না। বড়জোর অশ্রুতে টলমল করে চোখ। আর আমি দেখে নেই সে চোখের মাঝে একটা মাছরাঙা পাখি শিকারের অপেক্ষায় তার অশ্রুজলে ডুবে থাকা বিষাদী ডুমুর। মিঠি এমনই। ওর চোখ, নাক, ঠোঁট, চুল সবখানেই ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতিমাতার স্নেহ। ওকে জড়িয়ে ধরলে, চুম্বন করলে ও একটা লতানো গাছের মতো নরম হয়ে পেঁচিয়ে রাখে আমাকে। আমি তখন শিউলি, বেলি, হাসনাহেনা, গোলাপ প্রভৃতি ফুলের সুবাসে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তখন সর্প, মাছরাঙা এবং বিবিধ প্রাণীরা নিজেদেরকে প্রত্যখ্যাত জেনে সরোষে প্রস্থান করে। মিঠি, আমার প্রেমিকা তার খোঁপায় আমি গুঁজে দিয়েছি নক্ষত্রফুল।
মিঠির জন্যে অপেক্ষা করে আছি আমি। আজ বিকেল পাঁচটায় ওর এখানে আসার কথা। আমি একটু আগেই চলে এসেছি। অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না আমার। সপ্তাহের একটা দিন আমরা আমাদের সীমিত আয়ের কিছু অংশ ব্যয় করে রিকশায় চড়ে ঘুরি, সিনেমা দেখি, আর ভালোমন্দ কিছু খাই। এই দিনটায় আমরা ভুলে যাই নাগরিক জীবনের ক্লেশ এবং ক্লান্তি, ক্যারিয়ার গঠনের ইঁদুর দৌড়, সবরকম দায়বদ্ধতা, এবং ভবিষ্যতের চিন্তা। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম, তাই মিঠি যখন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে দু হাত দিয়ে আমার চোখ ঢেকে জিজ্ঞেস করলো "বলোতো আমি কে?" তখন তার আগমনঘটিত আনন্দে মনটা উড়ুউড়ু হলেও আমি কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম "জানি না"। তারপর কিছু দুষ্টুমি, কিছু খুনসুটির পরে আমরা এই বিকেল থেকে সন্ধ্যার পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলি। প্রথমে রিকশায় ভ্রমণ। ঘন্টাচুক্তিতে রিকশা ভাড়া করে শহরের এমাথা থেকে ওমাথা। মিঠি আমার পাশে বসে আছে। ওকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি আমি। আমার ভেতরে একটা খরস্রোতা পাহাড়ী নদীর ঢেউ ঝাপটা মারতে থাকে। ওরা আমাকে বলে, "আরো নিবিড়, আরো ঘনিষ্ঠ হও। স্রোতের তোড়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাও! চুম্বন করো, হাত ধরো, ওকে পিষে ফেলো, আঁকড়ে ধরো ও তোমার, শুধুই তোমার!"। কথাগুলো আমার বেশ পছন্দ হয়, তবে এই হুডখোলা রিকশায় জনবহুল স্থানে তা সমাধা করতে আড়ষ্ট লাগে। তাই ওসব অন্য কোন সময়ের জন্যে গচ্ছিত রাখি। হাত ধরে থাকি, এতেই অঢেল সুখ।
-কী ভাবছো? মিঠি সুধোয় আমাকে।
- ভাবছি আজকে কোথায় এবং কী খাবার খাওয়া যায়। ক্ষিধে লেগেছে বেশ।
-আমারও। চলো আমরা মতিঝিলে নতুন একটা হোটেল খুলেছে "ফিলিস্তিন বিরিয়ানি" সেখানে যাই।
ফিলিস্তিনের বিরিয়ানি! চলো, চেখে দেখা যাক!
বিরিয়ানি খেতে খেতে আজ কি সিনেমা দেখবো সেটা নিয়ে আলোচনা করি।
-এ্যান্ট ম্যান দেখবা? বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে চলছে।
-থ্রিডি?
-হ্যাঁ থ্রিডি।
-চলো তবে দেখা যাক!
মতিঝিল থেকে বসুন্ধরা। বেশ অনেকটা পথ। এবার আর রিকশায় নয়, ট্যাক্সি ক্যাবে। ব্যস্ত রাস্তার কোলাহলে তেমন কথা বলা হয় না। শুধু দুজনের বসে থাকা হাত ধরে। আমি হারিয়ে যাই সুখভাবনার অন্তরমহলে। এই যে শাহরিক ব্যস্ততা, বাসে ওঠার জন্যে কুস্তি করা, কন্ডাকটরের সাথে ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল, ট্রাফিক জ্যাম, ব্যাংক একাউন্ট খোলো, টাকা জমাও, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে পীড়ন, এর মাঝে আমাদের সপ্তাহান্তের ডেটিং যেন নিকষ কালো গহবরের মাঝে এক চিলতে আলো। এই যে হাত ধরা, এই যে নাও শোবার জন্যে আমার কাঁধ, দাও তোমার ঠোঁট, নাও আমার চুমু, দাও আমায় হাসনাহেনার সুবাস, দাও আমায় শিউলি ফুলের ঘ্রাণ, কত কীই না দেবার আছে তোমার! আর আমারও পাওয়ার জন্যে কী ভীষণ কাঙালপনা! সপ্তাহের একটা দিন, এই একটা দিন তোমার সকল রহস্য উন্মোচিত করো আমার কাছে। তাও কি সবটা পাওয়া যায়? কখনও তোমার চুলে হাসনাহেনার সুবাস, আবার কখনও তা পরিবর্তিত হয়ে রজনীগন্ধা। কখনও তোমার ঠোঁটে কমলালেবুর মিষ্টতা, আবার কখনও স্ট্রবেরি আইসক্রিমের ফ্লেভার। এই একটা দিন, একটা দিনে তোমাকে মনে হয় সদ্য কলেজে ওঠা চপলা তরুণীর মতো, যে প্রথমবার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে এসে লজ্জায়, উত্তেজনায় লালাভ হয় নিয়মিত বিরতিতে। যার সংকোচ জড়ানো তিরতির করে কাঁপা হাত জানান দেয় ভালোবাসা কী ভীষণ জীবন্ত এখনও! মিঠি, তোমার লাজনম্র মুখাবয়বে রচিত হয় ভালোবাসার পরিশূদ্ধ ইশতেহার। আমি যার মুগ্ধ পাঠক এবং রচয়িতা। এই একটা দিনে তুমি তেল ঝাল নুন কর্কশ কটূ পটু মানবী থেকে ভালোবাসার নরম আবরণে জড়ানো একটা লাজুক পরীতে রূপান্তরিত হও। আহা! সত্যিই যদি তোমার ডানা থাকতো, কী ভালোই না হতো! আমরা হারিয়ে যেতাম মহাবিশ্বের অনন্ত অম্বরে, ভালোবাসার উচ্চতম মন্দিরে। সিনেমা হলের কাছাকাছি এসে গেছি আমরা। কিন্তু আমার কেন যেন আজ সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে না। সেলুলয়েডের ত্রিমাত্রিক জগতের ধুন্ধুমার মারপিট, এ্যাকশন,স্পেশাল এফেক্ট এর চেয়ে মিঠির সাথে ঘাসের বিছানায় বসে গল্প করাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে। ট্যাক্সি থেকে নামার পর মিঠি কেমন যেন উশখুশ করতে লাগলো।
-কী হয়েছে?
সুধোলাম আমি।
-পিঠের কাছে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ফুঁড়ে বের হবে। ব্যথা করছে। আমি চিন্তিত মুখে তার পিঠে হাত রাখলাম। আশ্চর্য! সত্যিইতো কিছু একটা বের হবে বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ করে সেটা ভীষণ নড়াচড়া শুরু করলো। পোষাক ফুঁড়েই বের হবে,এমনই তার রোষ! ব্যাপারটা কী! আরে! আরে!! আরে!!! এ তো দেখছি সত্যিকারের ডানা! কিছুক্ষণ আগেই ভাবছিলাম এমন কথা।আমার অবচেতন মনের এই স্পর্ধিত আকাঙ্খা যাবতীয় বিজ্ঞান আর নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে চলে এসেছে আমাদের এই ধূলোমাটির জগতে। ঈশ্বরের এই অপ্রত্যাশিত উপহারে আমরা যুগপৎ আনন্দিত, বিস্মিত, এবং বিব্রত হতে থাকি। আশেপাশের মানুষেরা কারো কোন বিকার নেই। যেন এমন ঘটনা নিত্যনিয়মিতই ঘটে। নাকি তারা দেখতেই পাচ্ছে নাপ্রকৃতির এই টুকরো খেয়ালিপনা? মিঠি তখন প্রাথমিক অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে ডানা ঝাপটে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। "আমাকে নেবে না?" আমি ব্যাকুল হয়ে সুধোই। "জড়িয়ে ধর আমাকে। আমরা এখন উড়বো!" উল্লসিত কণ্ঠ তার। আমরা উড়তে থাকি। এ এক অসাধারণ মুহূর্ত! আমরা ক্রমশ উপরে উঠতে থাকি, আর এই শহরের বিশাল বিশাল দালানগুলোকে ম্যাচের বাক্সের মত ছোট আর ঠুনকো মনে হয়। আমরা মেঘেদের রাজ্য পরিভ্রমণ করছি! দেখো হিংসুক নগরবাসী, দেখো অফিসের বড় কর্তা, দেখো মামলাবাজ গ্রাম্য মাতব্বর, দেখো কুশলী পকেটমার, দেখো উত্তরাধনিক কবি, দেখো সচিবালয়ের আমলা, দেখো লুতুপুতু ভালোবাসার গল্পের পেইজ চালানো হামবড়া বোকাসোকা এ্যাডমিন, দেখতে পারছো? আমরা উড়ছি! উড়তে উড়তে কোথায় যাবো তা জানি না, তবে মেঘেদের রাজ্য থেকে হাজারো ভালোবাসার রূপকথা এনে দেবো তোমাদের জন্যে। তোমরা পড়বে, তোমরা প্রাজ্ঞ হবে, ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে হাজারো লাইক কামাবে, কিন্তু উড়তে পারবে কি? পারবে না। তোমরা বড়জোর ফ্যান্টাসি কিংডমের ভয়াবহ রাইডগুলোতে "ফ্রেন্ডস"দের সাথে "মাস্তি" করে চড়ে একাধিক প্রেমিক প্রেমিকাদের সাথে ছবি শেয়ার করবে। ইতিমধ্যে হয়তো বা টিভি চ্যানেলগুলো জেনে গেছে এই অদ্ভুত উড্ডয়নের কথা। কিন্তু সরেজমিনে আমাদের দেখে নিউজ কাভার করবে তার উপায় নেই। বাঁচা গেলো! নইলে আমাদের এই অলীক উড্ডয়নের মজাটা তাদের বিরক্তিকর প্রশ্নাবলি আর উজবুক কৌতুহলের দাপটে ম্রিয়মাণ হয়ে যেতো।।
হঠাৎ আমরা একটা নিম্নমুখী চাপ অনুভব করি। মিঠি ক্রমশ নিচে নামছে।ও আর ডানা ঝাপটাতে পারছে না। ব্যাপারটা কী! ওহ হো, আমাদের সাপ্তাহিক মিলনপর্বের মেয়াদ শেষ হবার পথে। যতই নীচে নামতে থাকি ততই বাস্তব জগতের নিত্যদিনের কার্যক্রম আমাদের উড্ডয়নের পরাবাস্তব অনুভূতিকে নাকচ করে দিতে থাকে। আমাদের ভাবনাগুলো প্রতিস্থাপিত হতে থাকে।
আমাদের সন্তান আনাহিতার দুধ এবং ডায়াপার শেষ হয়ে গেছে। কিনতে হবে।বেচারা বাবা-মাকে মনে করে খুব কাঁদছে নিশ্চয়ই? আমরা নিচে নামছি... ঐ দেখা যায় আমাদের বাসা! ঐখানে আমাদের ছোট্ট সুখের সংসার। যেখানে বাস করে আমাদের সন্তান এবং আমার বাবা মা। বিবাহিত জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে নতুন করে শুরু করার অভিপ্রায়ে আমরা ঠিক করেছিলাম প্রতি সপ্তাহে একবার আমরা প্রেমিক প্রেমিকাদের মতো ঘুরবো যাবতীয় ক্লান্তি, ক্লেশ এবং টেনশন বাদ দিয়ে। ঠিক সেই বিবাহপূর্ব প্রেম করার সময়ের মতো। বাসায় আসার পর আমরা আগ্রহ ভরে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকলাম খবর শোনার জন্যে। শহরে এত বড় একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেলো তা নিশ্চয়ই ব্রেকিং নিউজ এবং সংবাদের প্রধান শিরোনাম হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে! কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তেমন কোন খবরই কেউ দেখালো না। যাকগে, না দেখাক! আমরা তো উড়েছি সত্যিই, আমরা তো প্রেম করার দিনগুলিতে ঠিকই ফেরত গিয়েছিলাম। আবারও যাবো নিশ্চয়ই। আমরা খুঁজে পেয়েছি স্বপ্নলোকের চাবি। এই কথাটা কাউকে বলবো না, কক্ষনো না!
#এই প্রায় একই থিম নিয়ে সমুদ্রকন্যার গল্প জলের ছিটেয় পাগলামি
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৬