লোকটা আমাকে দেখে এড়িয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম। ঘাড় ধরে, কনুই দিয়ে একটা প্যাচ কষিিয়ে বগলদাবা করে ফেললাম। এখন সে আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। পিস্তলটা পকেট থেকে বের করে তার মাথায় ধরলাম। ছয়টি গুলি আছে এখানে। প্রতিটাই আজকে তার শরীরে রোপন করে দেবো। লোকটা আমার কাছে কাকুতি-মিনতি করলো শুরু করলো তার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে। আমার অবশ্য তাকে খুন করার কোন পরিকল্পনা ছিলো না। আমি তাকে নিয়ে একটি পরীক্ষা করতে চাই। অসম্ভব যন্ত্রণা আর চাপের মধ্যে রেখে তাকে নিয়ে কিছু লেখাবো। আমি দেখবো কীভাবে বিষাদভোরে বিদীর্ণ হয় ছায়াশালিকের বুক, কোন সে সুরের মূর্ছনায় নেচে ওঠে প্যালিকনের দল, কাঠঠোকরাদের হুল্লোরে কার আকাশে রঙধনু ফুটে ওঠে। এসমস্ত অজানা দৃশ্যকল্প আমি অনুভব করতে চাই। লোকটা আমার কাছে অনুনয় করা শুরু করেছে। কোন অনুনয়ে কান দেবো না আমি। জীবনের কাছে পরাজিত হয়েছি প্রতিটি পদক্ষেপে। আমার শোবার ঘরে গোলাপী রঙের সুগন্ধী কাপড় দিয়ে শোভাবর্ধন করে না কেউ। সন্ধ্যে হলে সান্নিধ্য পাই না খোলাচুলের কোনো তরুণীর। আমি পরাজিত। পরাজয় স্বীকার করে নিলে অনেকেই নেতিয়ে পড়ে, আবার অনেকেই রুখে দাঁড়ায়। ক্ষ্যাপাটে হয়ে ওঠে। আমার মতো। আর তাই আমার সমস্ত অপূর্ণ ইচ্ছের সত্যি হবার সম্ভাবনা যে জাগাতে পারতো এমন একজনকে ধরে টর্চার করে সত্যি হতে পারতো এমন গল্পগুলো লিখিয়ে নিলে তবেই আমার শান্তি। আমি তার চুল মুঠি করে ধরে ঝাঁকাই। খুব তো আমাকে এড়িয়ে চলেছো এতদিন! আমি জানতাম একদিন তোমাকে কাছে পাবোই। আদায় করে নেবো আমার অসুন্দর কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু ও ত্বকের অভিমানী আব্দারগুলো। আমার পঞ্চইন্দ্রিয় খুব ভুগেছে তোমাদের অবহেলায়। আজ তোমার পঞ্চ অঙ্গে আঘাত করে আমি বুঝিয়ে দেবো অবহেলার বেদনা।লোকটার কান ধরে আছি আমি সাড়াশি দিয়ে। লেখো, লিখতে থাকো আমার কানের অধরা শব্দাবলী। লেখা বন্ধ করলে, বা আমার অপছন্দের কিছু লিখলেই কানটা উপড়ে ফেলবো। স্টার্ট!
লোকটা লিখছে,
শব্দ... আমি শুনেছি ঝিঝিপোকাদের কোরাস...আমি শুনেছি বিষণ্ণ মেঘেদের মৃদু গর্জন...আমি শুনেছি দেবশিশুদের ঘুমানোর সময়কার নাক ডাকা। আমি শুনেছি পিংক ফ্লয়েডের সম্মোহনী সাইকেডেলিক মিউজিক, রেডিওহেডের সেই একাকী লোকটার কথা, যে নিজেকে 'ক্রিপ' ভাবতো। মিস্টার বিগের ওয়াইল্ড ওয়ার্ডে গায়ককে ছেড়ে যাওয়া মেয়েটা বুনোমানুষদের পৃথিবীতে যেন হারিয়ে না যায় তার আকুতি, অথবা এরিক ক্ল্যাপটনের পুত্রকে নিয়ে লেখা গানটি, যেখানে স্বর্গের উদ্যানে মৃত সন্তানকে আবারো খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছে...আমি শুনেছি বর্ষায় এঁদো ডোবা থেকে ব্যাঙের বৃষ্টি আবাহনের ডাক...আমি শুনেছি...
-কী হলো, থামলে কেন?
-আমি... আমি শুনেছি দ্বিচারিণী প্রেমিকার সঙ্গমকালীন শিৎকার...
স্টপ! আমার মাথার ভেতর যেন দাবানল শুরু হয়েছে,কোটি কোটি মগজকোষ যেন দাউদাউ করে জ্বলছ। আমি লোকটার ডান কান কেটে নেই নিপুন দক্ষতায়। সে উন্মাদের মতো তড়পাচ্ছে। দরদর করে রক্ত পড়ছে কানের ফাঁকা অংশটা থেকে। এখনই এমন করলে চলবে? খেলার তো কেবল শুরু!
তার নাকটা ধরি এবার সাড়াশি দিয়ে। নির্দেশ করি গন্ধ বর্ণনের। লোকটার লেখার হাত নেহায়েৎ খারাপ না! কর্ণ অংশের লেখাটা বেশ পছন্দ হয়েছে আমার। সে লেখা শুরু করে,
আমি গন্ধ নিয়েছি ভোরে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের। গন্ধ নিয়েছি বকুল, গোলাপ, জেসমিনের। শহরের পুরোনো অংশের মশলাসম্পন্ন খাবারের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রাণ ভরে ঘ্রাণে অর্ধভোজন করেছি। বোনের নেইলপলিশের গন্ধে নেশা ধরে যেতো আমার। নেইল পলিশ রিমুভার তো আরো এক কাঠি সরেশ! তবে এই ঘ্রাণ নাকি ক্ষতিকারক।
আমি তার নাকে একসেরি একটা ঘুষি বসিয়ে দেই।
-কী লিখছো এসব? মোটেও ভালো হচ্ছে না। আরো উপমা এবং চরিত্র চাই।
সে লিখতে থাকে,
বাচ্চাদের গায়ে তেল-জল-শ্যাম্পু-বেবি পাউডারের মিশ্রণে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়। পুরোনো কাপড় ঘাঁটতে গিয়ে ন্যাপথালিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিলাম একবার। সেটার গন্ধও নেশা ধরানো ছিলো। মা'র শরীরে একটা অদ্ভুত গন্ধ ছিলো। কিছুটা পাউডারের কিছুটা বিস্কুটের মতো। আর বাবার শরীরে ঘামের একটা ঝাঁঝালো ঘ্রাণ ছিলো। সেটাও খুব ভালো লাগতো। ভালো লাগতো বার্নিশে, শিরীষ কাগজ, নোসিলা, স্ট্রবেরি, ভ্যানিলার গন্ধ। আর ভালো লাগতো মাটির গন্ধ। বিশেষ করে তপ্ত রোদের পর বৃষ্টি নেমে এলে মাটির ভেতর থেকে একটা স্নিগ্ধ গন্ধ আসে, সে ঘ্রাণটা আমি খুঁজে ফিরি। আর...আর...
-লিখছো না কেন? নাকটা হারাতে চাও?
শাসিয়ে উঠি আমি। সে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখে,
-আর ভালো লাগতো প্রেমিকার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অন্তর্বাসের সোঁদা গন্ধ।
এমন কিছুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম আমি। 'পারভার্ট!' চিৎকার করে উঠে তার নাকে সজোরে ঘুষি চালিয়ে দিই।
যাক, খেলার প্রথম দুই রাউন্ড ভালোভাবেই শেষ হলো। এখন বাকি রইলো জিহবা, চক্ষু আর ত্বকের পালা। রক্তে প্লাবিত তার দেহ। কান আর নাক ভচকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাকে। আমি তাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার সময় দেই।
-কেন এমন করছো আমার সাথে? কী আমার অপরাধ?
-তোমার অপরাধ বয়ানের জন্যে এখনও তিন রাউন্ড বাকি। এখন লিখে ফেলো চটপট যা যা খেয়ে রসনা তৃপ্ত করেছো।
-এই লিস্টে কোন কাব্যিকতা করতে পারবো না বলে দিচ্ছি। শুধু লিস্ট ধরে লিখে যাবো।
অনুনয় প্রকাশ পায় তার কথায়। আমি ঠাস করে তার গালে একটা থাপ্পর মারি। "কাব্যিকতা করতে পারবি নে মানে! করতে তোকে হবেই। আমি কাব্যিকতা করতে যেয়ে উষ্টো খেয়ে পড়ে গিয়ে সবার সামনে অপদার্থ হিসেবে বিবেচিত হয়েছি। আমার হয়ে তোকেই কাজটা করে দিতে হবে বুঝলি? নে শুরু কর।"
-খাবার মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের বিরিয়ানি। ঢাকা শহরের সব ভালো ভালো বিরিয়ানির দোকানে আমি খেয়েছি। নান্না মিয়ার দোকান তো এখন প্রতি পাড়ায় পাড়ায় দেখা যায়। ওদের মূল শাখাটা, বেচারাম দেউরী অথবা চানখারপুলেরটার স্বাদ তুলনাহীন। পরিমাণেও বেশি দেয় ওরা। আর থাকে দু দুটো খাসীর মাংসল মাংস। অমৃত! মক্কা বিরিয়ানির নাম শুনেছিলাম, খেয়ে দেখেছি, খারাপ না। স্টারের কাচ্চি চমৎকার, শুধু খাবার সময় একটু বেশি লবণ নিতে হবে। পুরান ঢাকার কলকাতা কাচ্চির স্বাদ অপূর্ব, তেল-ঝালও কম বলে হজমে সুবিধা হয়। খুলনার দৌলতপুরে হারুন হোটেলের খাবার যে না খেয়েছে সে বিশাল কিছু মিস করেছে। আমরা যখন খেতাম, মাত্র ত্রিশ টাকায় পেটচুক্তিতে ভাত, কচু শাক আর খাসীর মাংস অথবা ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়া যেতো। পোলাপান এমনই খাওয়া শুরু করেছিলো যে সে পেটচুক্তিতে ভাতের সিস্টেম বাদ দিয়ে দুই প্লেটের পর প্রতি প্লেটের জন্যে আলাদা দাম ধার্য্য করেছিলো। মোহাম্মদপুরের বিহারীদের চাপ আর কাবাবের কথা তো সবারই জানা। আর...
-আর কী?
-আর মনে করতে পারছি না! এত কিছু একসাথে মনে পড়ছে, যে কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারছি না।
-দরকারও নেই লেখার, বলার। আমি তার জিহবাটায় হালকা একটা পোঁচ দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলি। চরম টর্চার সহ্য করেও সে টিকে আছে কী ভাবে! আমি তো ভাবতেই পারি নি সে তিন রাউন্ড শেষ করতে পারবে! আর মাত্র দুই রাউন্ড বাকি। এবার ত্বকের পালা।
-আমি সারাজীবন এমন একটা স্পর্শের কথা কল্পনা করে কাটিয়ে দিতে পারবো, যে স্পর্শে মুছে যাবে আমার সান্ধ্যকালীন বিমর্ষতা, দুপুরের ঘুম বুদবুদ থেকে বেলুন হয়ে একটা তিন ঘন্টা ব্যাপী আরামদায়ক সিয়েস্তার আয়োজন করে ফেলবে। আমি সারাজীবন এমন একটা স্পর্শের কথা কল্পনা করে কাটিয়ে দিতে পারবো, যে স্পর্শে আমার শুষ্ক ত্বকের রুক্ষতা নিমিষেই মুছে গিয়ে মোলায়েম হয়ে যাবে। সেই মোলায়েম ত্বকের ওপর একটা দিকহারা দেশান্তরী পাখি বসে ওম নেবে। সে তার ঠোঁট দিয়ে আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে দেবে। একটা প্রজাপতি এসে তার সাথে মিতালী করবে। এমন একটা স্পর্শের জন্যে আমার খুব তৃষ্ণা হয়, যেখানে আলতো করে ছোঁয়া থাকবে সেটা অনুভূত হয় কী হয় না এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে ঘুরপাক খাবে। আর বারবার সেই আলতো স্পর্শটা ফিরে ফিরে এসে ত্বকদরোজায় কড়া নেড়ে জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দুষ্ট খরগোশের মত দুর্দান্ত গতিতে পালিয়ে যাবে... হারিয়ে যাবে। আমি সেই স্পর্শটা খুঁজে খুঁজে যাবো, সেই অলীক অনুসন্ধানে আমার ভেতরের রোমকূপেদের গোড়ায় জমবে জল, আমি পরিশ্রান্ত হবো, আমি ঘেমে নেয়ে যাবো, যেন সেই স্পর্শটাকে আর্দ্রতা দিয়ে ধরে রাখতে পারি। পারি কি না পারি সেই স্পর্শ আমার চাই...
-চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়? ব্লেড দিয়ে তার পিঠ চিড়ে দিলাম আমি। খেলার আর একটা মাত্র রাউন্ড বাকি। চক্ষু। তুমি চক্ষু খুলে দেখো... আজ অন্ধকার একা নয় চোখের নীচে... বাপ্পাদার গান।
-নাও, শুরু করো তোমার চক্ষু অভিযানের বর্ণনা।
হঠাৎ সে বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে যায়। আমি তার এই আচম্বিত আচরনে হতভম্ব হয়ে যাই। শরীরে এত কাটাকুটি, রক্ত তারপরেও সে দাঁড়ালো কীভাবে! তার কি একটুও ব্যথা লাগছে না?
-খেলার শেষ দানটা আমিই দেই কী বলো? আমি তোমার ছায়া, এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না! এই মুহূর্তে আমি দেখছি আমার কায়াকে, তোমাকে। একটা পরাজিত মুখ। বিষণ্ণতা মানুষকে সুন্দর করে। আর তোমাকে করেছে কুৎসিত। হ্যাঁ তুমিই রেডিওহেডের সেই গানের 'ক্রিপ' যে নিজেকে বলে "আই ডোন্ট বিলং হিয়ার"! নিজের ছায়ার ওপর নানা কসরৎ করে রক্ত ঝরাতে চেয়েছো, অসম্ভব জেনেও। কারণ এছাড়া তোমার আর কোনো গতি নেই। তুমি পলকা এবং দুর্বল। কারো সাথে মারামারিতে জিততে পারতে না। তুমি চেয়েছিলে পঞ্চইন্দ্রিয়ের সবটুকু স্বাদ উপভোগ করতে। কিন্তু তোমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ, তুমি চোখে প্রায় দেখোই না। তোমার পেটে ভারী খাবার সয় না। তোমার ত্বকে একটু চোটেই ফুঁসকুড়ি ওঠে, আর রয়ে যায় অনেকদিন। তুমি কানেও কম শোনো। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তুমি এতটাই হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলে, যে শেষপর্যন্ত নিজের ছায়াকেই জাগিয়ে তুললে। তুমি একটা জিনিসই কিছুটা পারতে তা হলো, লেখালেখি। কিন্তু অনেকদিন যাবৎ লিখতেও পারছিলে না। তাই আমাকে তলব করে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের স্বাদ নেবার পাশাপাশি লেখার কাজটাও করিয়ে নিতে চেয়েছিলে। কিন্তু হায়! ছায়ার কী শরীর থাকে? এতক্ষণ ধরে টর্চারের অনুকরণ অবশ্য বেশ ভালোই করেছিলে। আর নিজে নিজে আউরে যাচ্ছিলে যা তাও বেশ ভালো হচ্ছিলো। কিন্তু এসব কিছুই শেষপর্যন্ত তোমার দখলে থাকবে না। খাতা আর কলম রাখা আছে। ইচ্ছে হলে কিছু লেখার চেষ্টা করে দেখতে পারো।
হঠাৎ সব আলো নিভে যায়। আমি আমার ছায়াকে হারিয়ে ফেলি। হারিয়ে খুঁজি। কোথায় গেলে তুমি? প্লিজ ফিরে আসো! অন্ধকার ঘরে আমার আর্ত কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিটা খুব ভূতুরে আর অদ্ভুত শোনায়।