হঠাৎ করেই আমার সাথে দেখা হয়ে গেলো সাহসের। সে একরত্তি ছোট্ট একটা অস্তিত্ব, পকেটে করেই ঘুরে ফেরা যায় অনায়াসে। সে আমাকে দেখে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো। আমি সসংকোচে আমার কড়ে আঙ্গুল দিয়ে তার হাত স্পর্শ করলাম। সাথে সাথেই কী একটা দারুণ পরিবর্তন ঘটে গেলো! আমি অনুভব করলাম আমার ভেতরের ভীতু, জবুথবু অন্তঃপুরে রণদামামা বাজছে। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা হৃদয়টা রক্তোচ্ছাসে প্লাবিত হয়ে আনন্দডম্বুরের সাথে নৃত্যরত। মনের ভেতর তোলপাড়, এতদিন সাহসের অভাবে যা যা করতে পারি নি সব আজকের ভেতরেই করে ফেলবো। সাহস ছাড়া আমরা কী ভীষণ কাপুরুষ আর নপুংশক যেন সমুদ্রতটের মাতাল ঢেউয়ের ঝাপটায় ত্রস্ত বালিহাঁস সেঁধিয়ে যাচ্ছে চোরাবালিতে। আমি উঠে দাঁড়ালাম ভস্ম থেকে জীবন পাওয়া ফিনিক্সের মতো। এবার আমার উড্ডয়ন কাল মৃত ইচ্ছের স্তব্ধ অম্বরে।
সাহসের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা আমার জন্যে অবশ্যম্ভাবীই ছিলো। বেশ অনেকদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তার সাথে দেখা করার। চুপিচুপি রাত নেমে এলে আমার একাকীত্ব যখন জাঁকিয়ে বসতো পাথর হয়ে বুকের পরে, তখন তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে গিয়েই একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললাম তার অস্তিত্ব। একা হয়ে গেলেই আমি ভীতু হয়ে যাই। আমার প্রতিদিনের হেরে যাওয়া, প্রবঞ্চনা, গঞ্জনা, গোত্তা খাওয়া উচ্চাভিলাস আর আহত ইচ্ছেরা চারিপাশে ঘিরে ধরে ভয়ার্ত আবহ সঙ্গীতের শোকগীতি গায়। তখন ঘামে আমার শরীর ভিজে আসে, গলা শুকিয়ে শিরীষ কাগজের মত খসখসে হয়ে যায়, আর হৃৎপিণ্ডটা খাঁচায় বন্দী বাচ্চা খরগোশের মতো লাফাতে থাকে। একাকীত্বজাত এসব ভয়ার্ত অনুভূতি ক্রমশই আমাকে গ্রাস করে বিপন্নতার ঘুপচি সড়কে দানবসদৃশ মরণযানদের হুড়োহুড়ির ভেতর ঠেলে দিচ্ছিলো। সংঘর্ষের কবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ছুটতে ছুটতে গলদঘর্ম হয়ে একদিন হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আর নয় এভাবে ত্রস্ত হরিণীর মতো ছুটে পালিয়ে জীবনসন্ধান। একদিন জানালা খুলে দিয়ে আমার অভ্যস্ত আবদ্ধতাকে উড়িয়ে দিলাম চৈতালী বাতাসের সাথে, ঘর আলো করে জীবনরঙে রাঙিয়ে দিলো নক্ষত্রের বক্ষ থেকে আবির্ভূত অলীক আভা। সেই হাওয়া আর আলোর মন্টাজ আমায় জীবনকে অন্যভাবে ভাবতে শেখালো। আর সেইদিন থেকেই একটু একটু করে মনোবল সঞ্চয় করছিলাম সাহসের সাথে দেখা করার টিকেট ক্রয়ের জন্যে। দিনকেদিন আমার মধ্যে বিশ্বাসের শেকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হচ্ছিলো, সাহসের সাথে দেখা হয়ে যেতে খুব বেশি দেরী নেই হয়তো।
আমি জানতাম সাহসকে পেতে হলে বিশেষ কিছু ঘটাতে হবে, যা আমার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেবে। হয়তো বা বাসের ভীড়ে সুযোগসন্ধানী লম্পট যুবককে খুব একচোট নিয়ে নেয়া, অথবা যার জন্যে বিনিদ্র রাত কাটে, সেই মেয়েটার কাছে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গাঢ় কণ্ঠে ভালোবাসার কথা জানানো। সাহস আমার কাছে চলে আসতে পারে হাঁটতে গিয়ে ধাক্কা লাগা দশাসই রূঢ় ব্যক্তির দেহ থেকে হেলেদুলে অথবা দশতলা উঁচু দালানের প্রাচীরে বসে থাকা অবস্থায় উড়েউড়ে। আমার ক্ষেত্রে সাহসের আগমন অবশ্য এতসব ঘটনার অছিলার ধার ধারেনি। প্রথমে যেমন বলেছি, হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেলো তার সাথে! তখন আমি রাত জেগে নানারকম আকাশকুসুম চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। ভাবতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ভাবনাগুলো নেতিবাচক অনুভূতি দ্বারা গ্রেপ্তার হয়ে ভয়সরনী ধরে বিপদজনক ভ্রমন শুরু করতে বাধ্য হয়। সেদিন তেমন কিছু হচ্ছিলো না। আমি অপেক্ষা করে ছিলাম, এসো কদর্য হীনমন্যতা, বোবা ব্যথা, পঙ্গু যন্ত্রণা! না, তারা কেউই আসছিলো না। চিন্তার সাম্পানে চিত্তের সম্পদ বোঝাই হতে লাগলো। এতদিন ধরে জমানো বিশ্বাসের মাটির ব্যাংকের আধুলিগুলো ঝনঝন করে বাজতে লাগলো, আমি নিজেকে পূর্ণ এবং আত্মবিশ্বাসী অনুভব করলাম। আর ঠিক তখনই দেখলাম সাহসের ছোট্ট শরীরটা। কখনও তা ভোরঘোষক তেজী মোরগের লাল ঝুঁটির মতো, কখনও তা ফুটবল খেলায় প্রতিপক্ষের ভয়ংকর ট্যাকল সয়ে এগিয়ে যাওয়া দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকারের রক্তমানচিত্র। আমার একটা মোরগ ছিলো ছেলেবেলায়, আমি একসময় ফুটবল খেলতাম। সাহসের বিভিন্ন রূপ আমার শরীরে সাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলো কাঁচপোকার মতো। সেই স্পর্শে আমার চোখে প্রশান্তির ঘুম নেমে এলো। কতদিন এমন আরাম করে ঘুমোই নি!
সাহসের স্পর্শে মানুষ সুন্দর হয়। সতেজতার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পাহাড় থেকে নিয়ে আসা টাটকা চা পাতা গরম পানির সাথে মেশানোর মত করে। সাহসের স্পর্শে মানুষের চোয়াল দৃঢ় আর জ্যামিতিক আকৃতিতে ঋজু হয়ে প্রতিজ্ঞা করে নানাবিধ। সকালে ঘুম থেকে উঠে এসব নতুন অনুভূতিতে ঋদ্ধ হয়ে স্নান সেরে চললাম এই শহরের পথে দৃপ্ত পায়ে। অনেক কিছু করার বাকি, আমার কোন তাড়া নেই অবশ্য। বুকপকেট আঁকড়ে ধরে নতুন পৃথিবীর দিকনির্দেশনা দিচ্ছে আমায় সাহস। এতদিন ভয়ে, আত্মবিশ্বাসের অভাবে যা যা করতে পারিনি, নিজেকে দেয়া সেসব প্রতিশ্রূতি পালন করার যথাযথ সময় উপস্থিত। আজ আমি প্রিয় নারীর কাছে গিয়ে উপহার দেবো একতাড়া গোলাপ। কাল দেনাদারের কলার চেপে ধরে হুমকি দেবো, পাওনা টাকাটা পরিশোধ না করলে তার বিবিধ ক্ষতির বয়ান দিয়ে। পরশু যাবো দূর পাহাড়ে, উঠবো চূড়ায় আর দেখবো আশ্চর্য মেঘদলের ছোটাছুটি। ধীরে ধীরে বড় হবে আমার নিরাকার সাহস। হাতের তেলো থেকে উঠে আসবে সে মনের চূড়ায়। কাঁচপোকা থেকে ঘাসফড়িঙের আকৃতি পাবে সে। একসময় আমার সমান বড় হয়ে ছায়াসঙ্গী হয়ে চলতে থাকবে পাশেপাশে। সে অবশ্য অনেক পরের কথা। ততদিনে আমার সব জয় করা হয়ে যাবে। আমি পারবো। স্পর্ধিত অহংকারে প্রত্যয় ব্যক্ত করি।
-একটু চাইপা খাড়ান না মিয়া। আপনে তো পুরা গায়ের ওপর উইঠা পড়ছেন। বাসে চড়েন নাই জীবনে? মফিজ কুনহানকার!
বড্ড বাজে সময় বেছে নিলো লোকটা এমন আচরণের জন্যে। অন্যসময় হলে হয়তো আমি মিনমিনে কণ্ঠে মৃদু প্রতিবাদ করে সরে দাঁড়াতাম। কিন্তু ততক্ষণে আমার কাঁচপোকা সাহস চঞ্চল পায়ে হাঁটা শুরু করেছে। আমি শীতল চোখে তাকালাম লোকটার দিকে। এর সাথে বেশি কথা বলে সাহসের নিক্তিটা ভারী করে নেয়া নিতান্তই খেলো ব্যাপার মনে হলো আমার কাছে।
-সবার সাথে এক আচরণ করলে কি চলে মিয়াভাই? নিজে সরেন ভালোয় ভালোয়। আর একবার ব্যাড ল্যাংগুয়েজ ইউজ করলে জিহবা টাইনা ছিড়্ড়া ফালামু।
আমার বলনে এবং চলনে এমন কিছু ছিলো যে লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে গজগজ করতে করতে সরে পড়লো। সাহসপোকা তখন কাঁচপোকার আকৃতি থেকে ঘাসফড়িং হয়ে গেছে। বড়সড় পোকাখেকো ম্যানটিস। গন্তব্য তখনও অনেক দূর। মিরার সাথে কথোপকথনটা ঝালিয়ে নেয়া যাক।
-মিরা, তোমাকে ভালোবাসি। হয়তো বা আমি তেমন কোন কেউকেটা নই, হয়তো বা আমার অনেক খামতি আছে। কিন্তু জেনো একটা জিনিসের কমতি নেই আমার। তোমাকে পাবার জন্যে সঞ্চিত দূরন্ত সাহস। যত বাধাই আসুক না কেনো, আমি লড়বো বুক চিতিয়ে। বিশ্বাস রাখবে কি আমার প্রতি?
হ্যাঁ, আমি জানি সাহস দিয়ে মন জয় নাও করা যেতে পারে। কী দিয়ে যে মন জয় করা যায় সেটা এক গভীর সংশয়ের বিষয় বটে! তবে মিরাকে পাই বা না পাই, এতদিনের সংকোচ, ভীতি আর হীনমন্যতাকে জয় করে এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে তাকে এই কথাগুলো বলার ফলে নিজের প্রতিই আমার ভালোবাসা বেড়ে যাবে, জীবনটা হবে অনেক সহনীয় এবং সুখময়। সাহসের ম্যানটিস হয়ে যাবে দূরন্ত চড়ুই। তার পরিচর্যা করার জন্যে হলেও মিরাকে এই কথাগুলো বলা দরকার। আরো অনেক অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে আমাকে। সাহসের পরিচর্যা না করলে চলবে কী করে!
বাস থেকে নেমে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু। কী যেন একটা নেই! অস্বস্তি আর সংশয় ভর করলো আবার আমার মধ্যে। বুকপকেটটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। তবে কী... আমার আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করেই বুকপকেটের শূন্যতা জানান দিলো সাহস আর নেই। পকেটমার হয়ে গেছে। নামার সময় একজন লোকের সাথে বচসা হয়েছিলো। বলা যায় আমিই যেচে পড়ে করেছিলাম। কোন দরকার ছিলো না তার। সেই লোকটা ছিলো ভীতু আর আত্মবিশ্বাসহীন চেহারার শীর্ণ শরীরের একজন, আর আমি সাহসের দম্ভে গর্বিত প্রবল পুরুষ! অযথাই তাকে গালমন্দ করেছিলাম...
-হালার কৈত্থিকা যে এইসব আসে!
লোকটা দুঃখিত চোখে চেয়েছিলো আমার দিকে।
-ঐ কন্ডাক্টর, এইসব বলদরে বাসে ওঠাও কিল্লিগা?
লোকটা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়েছিলো। এখন বুঝতে পারছি, আমার দিকে মানে নির্দিষ্ট করে বললে আমার বুকের দিকে, বুকপকেটে রক্ষিত সাহসের দিকে। তার মতলবটা যদি তখন বুঝতে পারতাম! কিছুক্ষণ পর সে তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে আমার বুক ঘেঁষে চলে যায়। তারপর থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগা শুরু, ক্রমবর্ধমান অস্বস্তিটা এখন ভীতির রূপ নিয়েছে। এত কষ্টে অর্জিত সাহসটা শেষমেষ পকেটমার হয়ে গেলো! হতাশায় ফুটপাতের ওপর মাথা চেপে ধরে বসে পড়ি আমি। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর মুখ তুলে আমি দেখতে পাই সে লোকটাকে। যে আমার পকেট মেরে সাহস নিয়ে গেছে। তার চোখমুখে বলিষ্ঠ বিশ্বাসের ছাপ। প্রতি পদক্ষেপে সাহসের সৌন্দর্য। এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারি। সাহসের অতি ব্যবহারে যে নৈতিক অবক্ষয় হবার সম্ভাবনা থাকে, দুর্বল মনের মানুষেরা তা সামাল দিতে পারে না। হয় তারা আরো দুর্বল হয়ে যায়, নয়তো শয়তান হতে থাকে। শয়তানতম, যাকে কোন কিছুই স্পর্শ করে না। আমার মতো মৌসুমী সাহসী লোকেরা দুর্বলের প্রতি সাহস ফলিয়ে অন্যায় করে মনঃপীড়ায় ভুগে আবারও ভীতু হয়ে পড়লে পকেটের ফাঁক গলে সাহস চলে যায়, অথবা প্রতিপক্ষ ছিনিয়ে নেয়। লোকটা আমার দিকেই আসছে। কিছুক্ষণ আগের অপ্রীতিকর ঘটনার শোধ তুলতে কি না কে জানে! লোকটা এসে যায় আমার কাছে। কলার ধরে উঁচিয়ে তোলে আমাকে।
-৬৬৬/৩ বাড়িটা কোথায়?
দুর্বিনীত দামাল প্রশ্ন তার। ৬৬৬/৩। মীরাদের বাড়ি। শেষ পর্যন্ত সে এমনভাবে শোধ তুলবে ভাবতেও পারি নি। জীবন হয়তো এমনিভাবেই মৌসুমী সাহসী দুর্বল লোকদের পরাজয়ের চড়কায় করে ঘোরাতে থাকে। আমি দুর্বল ভঙ্গিমায় দিক নির্দেশনা দেই মীরাদের বাড়ির। লোকটা আমায় একটা চড় বসায় সজোরে। তারপর বিজয়ীর হাসি হেসে যেতে থাকে মীরাদের বাসার অভিমুখে। আমি গাল চেপে শূন্য পকেটে বিমূঢ় বসে থাকি। অর্ধসাহস আর অর্ধশয়তানী সংযোগে পৃথিবীর নিঃস্বতম মানুষ হয়ে অপেক্ষা করে থাকি সাহসের নতুন মৌসুমের জন্যে।
#বছর দুই আগে একটি কবিতা পড়ে বেশ উদ্বেলিত হয়েছিলাম। অবশেষে কবি "সোনালী ডানার চিল" এর কবিতা পলাতক সাহসকে উপজীব্য করে গল্পটি লেখা হলো।