বরাহ বিষাদ
এই শহরে কোন মানুষ নেই। কখনও ছিলো কী না আধো ঘুম আধো তন্দ্রার প্রভাবে ক্ষয়াটে স্বপ্নের জঠরে বাস করে ববির তা মনেও পড়ে না। সে শুধু জানে একাকীত্বের বর্ণমালা। সে জানে ঘর থেকে বেরিয়ে দিগন্তের দিকে তাকালে শুধু শূন্যতার ঘরবাড়ি, ক্ষেত, আর বাগান চোখে পড়ে। শূন্যতার সমাগম বড়ই কোলাহলপূর্ণ মনে হয় তার কাছে। সে কোলাহল পছন্দ করে না। সে মানুষ পছন্দ করে না। হয়তোবা একসময় করতো। হয়তো বা একসময় ভালোবাসা, পাপ-পূণ্য, লাভ-ক্ষতির খতিয়ান লিখতো সে তার ইচ্ছেখাতায়, রোজনামচায়। সে খাতার পাতাগুলো পুড়ে গেছে, উড়ে গেছে সেই কবে! হয়তোবা মানুষই পুড়িয়ে দিয়েছে সব। ববির আবছা আবছা মনে পড়ে, এখানে তন্বী তরুণীর নিষ্ঠুর ভ্রূকুটি ছিলো, ডাকসাইটে মানুষদের ভীড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে একটা অনিচ্ছুক জীবন ছিলো, হল্লাপ্রেমী বারফেরতা যুবকের দলের খিস্তিতে অস্বস্তি ছিলো। ববি কোনকিছুর সাথেই খাপ খাওয়াতে পারতো না। একা থাকতো, একা থাকাই ভবিতব্য মেনে নিয়েছিলো সে। তাই যখন সবাই দল বেঁধে মারা গেলো একদিন, একসাথে; ববির খুব একটু খারাপ লাগে নি। কী কারণে মারা গিয়েছিলো তারা? না, কোন মহামারী বা দুর্ভিক্ষ নয়। নয় কোন কলকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব, অথবা মোড়ল রাষ্ট্রের পরিচালিত ম্যাসাকার। ববি এজন্যে নিজেকেই দায়ী করে। তার ইচ্ছেখাতায় সে একদিন সবার মৃত্যু কামনা করে অল্প কিছু লাইন লিখেছিলো। স্রষ্টার কাছে মিনতি জানিয়েছিলো যেন এই চিরযৌবনা, অমিত শক্তিধর, পায়াভারী মানুষগুলো সবাই শহর থেকে চলে যায়। তাকে যেন একা থাকতে দেয়। এই শহরের সবাইকে ববির মনে হতো বিপুল শক্তির উৎস, যারা একাকীত্বে ভোগা মানুষকে কীটসম মনে করে পদদলিত করতে ভালোবাসে। সেই যে ভ্রুকুটি করা তন্বী তরুণীর কথা বলা হলো না? সেও সুযোগ পেলেই ববিকে হাই হিল দিয়ে খোঁচা মারতো। আর তার বান্ধবীরা সবাই বেদম হাসতো। সে হাসি ছড়িয়ে যেতো সবখানে। অফিস বাদ দিয়ে লোকজন এসে মজমা বসাতো ববির নাকাল হওয়া দেখার জন্যে। তারা এসব উপলক্ষ্যে মদ্যপান করলে তাদের স্ত্রীরা কিছু মনে করতো না। করবে কেন? তারাও যে মজা দেখতে বিভোর তখন। হাইহিল পরা মেয়েগুলোকে উৎসাহিত করার জন্যে চিৎকার করে যেতো। সেই চিৎকার শুনে আমোদিত হয়ে আশেপাশের অন্যসব শহর থেকে লোকজন এসে জড়ো হয়ে যেতো। ববির প্রার্থনাদ নালায় ভেসে যাওয়া কেঁচোর মতো হারিয়ে যেতো। তারপর যথেষ্ট হয়েছে মনে করে ববিকে ছেড়ে দিলে ক্লান্ত-বিদ্ধস্ত ববির দেহে চোরকাঁটা আর বিছুটি ছেড়ে দিয়ে ঘুমুতে যেত প্রশান্তির অনুভূতি নিয়ে।
এতসব কিছুর পরেও ববি হাল ছাড়ে নি। সে খুব বোকার মতো বিশ্বাস করতো একদিন তারও একটা বন্ধু হবে। প্রেমিকার দুরাশা করা ছেড়ে দিয়েছিলো সে অনেক আগেই। একজন বন্ধু, তার কাছে সে ভালোবাসা বা সহানুভূতি কিচ্ছু চাইতো না। শুধু চাইতো তার ইচ্ছেগুলোর কথা ব্যক্ত করতে, তার প্রবঞ্চণাময় জীবনের গল্প শোনাতে। প্রায় জুটেও গিয়েছিলো একদিন। সেদিন সে বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা ছিলে ফেলেছিলো অনেকখানি। ফার্মেসিতে সেলাইয়ের জন্যে গেলে দোকানদারের হাসি দুকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
-আরে ববি... দ্যা আলটিমেট লুজার যে! পা ছিললে কীভাবে?
-বাস থেকে নামতে গিয়ে।
-তোমার মতো বোকার হদ্দের ক্ষেত্রে তো এমনই হবে। বাস থেকে নামতে গিয়ে পা হড়কাবে, ভীড়ের মধ্যে মেয়েদের হাইহিলের গুঁতো খেয়ে ত্রাহিসুরে চিৎকার করবে, মদ খেতে গেলে এক পেগ খেয়েই বমি করে দিবে...
-এখন দয়া করে আমার ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করে দিন না, বড় কষ্ট পাচ্ছি।
এই কথা শুনে দোকানদার আরো উল্লসিত হয়। প্রফুল্ল কণ্ঠে সে বলে,
-আরে তোমার পা কেটে গেছে এটা তো বিশাল খবর। এই খবর শহরের আর সবাই জানবে না তা কী করে হয়। তোমার পায়ের পরিচর্যা করার জন্যে মেয়েরা আসবে, চিকিৎসার খরচ বহনের জন্যে চাকুরেরা আসবে, ব্যবসায়ীরা তোমার পায়ের পরিচর্যা অনুষ্ঠান দেখানোর জন্যে টিকেটের ব্যবস্থা করবে, তারপরেই না চিকিৎসা! এখন তো তোমার কাছে ফুটো পয়সাটাও নেই। হয় মানিব্যাগ হারিয়েছো, নয়তো আনতে ভুলে গেছো, ঠিক না?
-ঠিক না। মানিব্যাগটা পকেটমার হয়ে গেছে।
এবার দোকানদারের কন্ঠ কঠোর হয়।
-খবরদার আমাদের শহরের অন্য কাউকে নিয়ে কুৎসা রটাবি না। কার এমন দায় পড়েছে যে তোর মতো লুজারের পকেট কাটবে? মনে রাখবি, এই শহর আমাদের, তোর না। এখন যা ভাগ! সন্ধ্যের পর তোর কাটা পা নিয়ে আমরা উৎসব করবো।
বিষণ্ণ মনে ফার্মেসি থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে সে। যথাসম্ভব দ্রুত পায়ে। কারণ এই এলাকাটা জনবহুল। কিছুক্ষণ পর তাকে নিয়ে মজা দেখতে মানুষজন উপস্থিত হবে। তার আগেই শহরের নির্জন কোন প্রান্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকা ভালো। হাঁটতে থাকে ববি। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। দূর থেকে শোনা যায় কোলাহল। তাকে খুঁজতে বের হয়েছে শহরবাসী। হঠাৎ একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় ববি। শঙ্কিত হয় সে। আবার না নতুন কোন হেনস্থার শিকার হতে হয় তাকে! কিন্তু লোকটা তাকে দেখে হাসলো না, বিদ্রুপ, কটাক্ষ বা গালাগালি কিছুই করলো না। জড়ানো গলায় আশ্চর্য কোমল কণ্ঠে সে বলে,
-ইটজ ওকে। আপনি ব্যথা পান নি তো!
জীবনে প্রথম এমন কোমল আচরনের মুখোমুখি হয়ে তার ভেতর এক অনির্বচনীয় অভূতপূর্ব অনুভূতি হয়।
-না ব্যথা পাই নি।
বাষ্পরূদ্ধ ববির কণ্ঠ।
-আমি এই শহরে নতুন এসেছি। চলে যাবো আজকেই। আপনি কি এখানকার স্থানীয়?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুশকিলে পড়ে যায় ববি। সে আসলে কে? কোথায় তার জন্ম? এই বিরুদ্ধ বাতাসের নিষ্ঠুর শহরে সে কীভাবে এলো? প্রশ্নগুলোর উত্তর হাজারো হাতরেও সে খুঁজে পায় না।
-আমি... ঠিক জানি না।
-বলেন কী! আমিও তো নিজের পরিচয় জানি না। হয়তো বা জানতাম কোন এক কালে, কিন্তু কারা যেন ভুলিয়ে দিতে চায়। কারা যেন বলে, "ইউ ডোন্ট বিলং হিয়ার"।
এই কথাগুলো ববিকেও কে যেন বলে। নিজের এক সতীর্থ পেয়ে সে আবেগপ্রবণ হয়। কিন্তু কথা বলা শেষ করে আগন্তুক ভীষণ কাশতে শুরু করলে ববিকে উদ্বিগ্নতা পেয়ে বসে। লোকটা কাশতে কাশতে রক্তাভ বমিতে রাস্তা ভাসিয়ে দেয়।
-আপনি কি অসুস্থ?
উদ্বিগ্ন ববির জিজ্ঞাসা।
-হ্যাঁ। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি।
-প্লিজ মারা যাবেন না!
আকুল অনুরোধ ববির।
-মারা না গিয়ে উপায় নেই আমার। আপনিও বাঁচতে চাইলে মরে যান, অথবা সবাইকে মেরে ফেলুন।
-সবাইকে মেরে ফেলবো! অত শক্তি তো আমার নেই।
-তাহলে আমি কীভাবে মারলাম! আমার শহরের সবাই মৃত। কারণ তারা আমাকে চাইতো না। আমি তাদেরকে চাইতাম। একসময় আমার চাওয়াটা তাদের মৃত্যুকামনায় রূপ নিলো। তারপর থেকে সবাই মরে গেছে। আমি জানি, আপনিও আমার মতো একজন। আপনি চান আমার মত করে, পেয়ে যাবেন।
সেই রাতে ববি তার ইচ্ছেখাতায় লিখলো,
"এই শহরে কোন জীবিত মানুষ নেই। এই শহরের কাউকে আমি চাই না। হে ঈশ্বর, আমাকে পূর্ণ একাকীত্বে ঋদ্ধ করো। এই কোলাহলচর্চিত, অপমানকর একাকীত্ব থেকে আমাকে মুক্তি দাও।"
ববি তার ইচ্ছেখাতাটি নিয়ে সন্তর্পণে চললো শহরের নির্জনতম জায়গায়। একটি পরিত্যক্ত কসাইখানায়। এখন থেকে এটাই হবে তার নতুন নিবাস।
তারপর...
ববির ইচ্ছেখাতাটি দমকা বাতাসে উড়ে গেলো। সেদিন ভীষণ ঝড় হচ্ছিলো। বিজলীর চমকে পুড়ে গেলো। তারপর বাতাসে মিশে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাস হয়ে সবার শ্বাসরূদ্ধ করে ববির ইচ্ছে পূর্ণ করলো।
এখন এই শহরে কেউ নেই। ববি আর কসাইখানায় প্রাপ্ত একটা বখাটে শুকর ছাড়া। ববি পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে দেখেছিলো অসংখ্য লাশ। সেই বালিকার, সেই দোকানীর, সেই গৃহবধুর... চমকে উঠে সে দৌড়ে ফিরে গিয়েছিলো তার নতুন আস্তানায়। তার ঘুম ঘুম ভাব কাটেনি তখনও। এখন যদি আবার দেখে যে সবাই বেঁচে উঠেছে, কিংবা সে ঘুমের ঘোরে ভুল দেখেছে, তবে উপায়! তাই ববি এর পরের দশ বছরে আর জঙ্গলের ভেতর নিভৃত কসাইখানাটি থেকে বের হয় নি।
*
ববির আশা পূরণ হয়েছে। অবশেষে সে সত্যিকারের একাকীত্বের স্বাদ পেয়েছে। এখন এই কসাইখানা, পচে যাওয়া মাংস, শুকিয়ে যাওয়া রক্ত আর ধেড়ে শুকরটা নিয়ে বেশ ভালো আছে সে। শুকরটার সাথে সে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছে। তবে বন্য শুকর তো, সহজে পোষ মানতে চায় নি। ববি তার নিয়মিত পরিচর্যা করতে লাগলো। নিজের মল প্লেটে করে সাজিয়ে খাইয়ে বেশ নধর করে তুললো শুকরটাকে। এখন সে ববির আহবানে সাড়া দেয় ঘোঁতঘোঁত করে। শুকরটাকে নিয়ে ববির অনেক স্বপ্ন। তবে তার ইচ্ছেখাতাটি হারিয়ে গেছে বলে সে সমস্ত লিখে রাখার সুযোগ হয় না। তার পৃথিবী বলতে ছোট্ট এই জংলা জায়গা আর পরিত্যক্ত কসাইখানাটাই। সে এর বাইরে যাওয়ার সাহস পায় না। তার দিনকাল অবশ্য বেশ ভালোই কাটছে। কসাইখানাটায় পচা গলা মাংসের অভাব নেই। সেসব খেয়ে তার ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়। মাঝেমধ্যে ঝড়ো বাতাসের সাথে চলে আসা পচা বটফল পেলে তো রীতিমত একটা ভোজ হয়ে যায়। এমনই এক ঝড়ের দিনে পচা মাংস আর বটফল দিয়ে আহার করতে করতে সে শুকরটার সাথে গল্প করছিলো,
"বুঝলি বেশ ভালো আছি আমরা, কী বলিস? ভাগ্যিস সেদিন সেই মাতাল লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো! সে উপায় বাতলে না দিলে আজো মানুষের কিল-চড়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, আর অসুস্থ আনন্দের উপকরণ হয়ে থাকতে হতো। আজ তারা সবাই মৃত। ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন"
জবাবে শুকরটি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে আপত্তি করে ওঠায় ববি মনে করে যে কথাটি সে পছন্দ করে নি, তাই অন্যভাবে বলে,
"আরে শোন রাগ করিস কেন? ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন না কি শোনেন নি, সেটা বড় ব্যাপার না। আমি আমার ইচ্ছাশক্তির বলে পরম একাকীত্ব অর্জন করতে পেরেছি। মুছে দিতে পেরেছি সমস্ত দীনতা, হীনমন্যতা, প্রতিষ্ঠা করেছি আমার একলার রাজত্ব। আর হ্যাঁ, আমি ভুলেও ঐ পৃথিবীতে দেখতে যাবো না কিছু অবশিষ্ট আছে কী না। আমাদের এ রাজত্বে আমি আর তুই'ই হলাম রাজা গজা হাহাহা!"
শুকরটি এবার নরম হয়ে মৃদু গরগর শব্দ করতে থাকলে ববি আশ্বস্ত হয়। সে শুকরের নরম গালে হাত বুলিয়ে দেয়, তার পিঠ চুলকে দেয়। জীবনটা বেশ সুখময় মনে হয় তার কাছে।
যদিও ববি অলৌকিক কোন প্রক্রিয়ায় হোক বা নিজের ইচ্ছের দুনিয়ার বাদশাহ হয়ে হোক, আশেপাশের মনুষ্যজাতিকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে এবং সর্বময় একাকীত্ব আর নির্জনতায় ডুবে থেকে মানুষের অভাব পুরোপুরি ভুলে থাকতে পেরেছে, তবুও মাঝেমধ্যে জৈবিক কামনা জেগে ওঠে তার। স্বমেহন করে সে সেই চাহিদা মেটায়। একদিন সেরকম এক সকালে মর্নিং ইরেকশনের সময় ববি বিছানায় শুয়েই ঝাঁকাচ্ছিলো নিজেকে, তখন হঠাৎ খেয়াল করে শুকরটা অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সে স্বমেহন বন্ধ করে শুকরটির দিকে ছুটে যায়। তাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
"দেখ, ব্যাপারটা তুই অন্যভাবে নিস নে। আমি তো মানুষ। আমারও তো কিছু চাহিদা আছে। আমি তো আর ব্রহ্মাচার ব্রত নিই নি। তোর কাছে ব্যাপারটা হয়তোবা খারাপ লেগেছে। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোর প্রতি সৎ"
এটুকু বলার পর ববি শুকরটার দিকে গাঢ় মমতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। সে তার কসাইখানার নিভৃত জীবনে প্রথমবারের মতো খেয়াল করে দেখতে চায় শুকরটা মাদী না মর্দা।
মাদী শুকর। ববি ভাবে তাদের সম্পর্কটা নতুন একটা পর্যায়ে উপনীত হতে যাচ্ছে। যেখানে পারস্পরিক দায়বোধ, বিশ্বাস, আস্থা, আর সম্মানের ব্যাপারগুলো মেনে চলতে হবে। আর এভাবেই ববির জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়। সে নতুন স্বপ্ন দেখে।
এইখানে কেউ নাই। সমাজের চোখ রাঙানি, বস্তাপচা যতসব নিয়মকানুন, আদ্যিকালের নীতিবোধ, পাপ পুণ্যের খতিয়ান, কিছু নাই। এখানে ভালবাসাকে নতুন করে জানবার অবারিত সুযোগ, নতুন স্বপ্ন দেখার উৎসব। ষোড়ষী মেয়ের চেয়ে মাদী শুকরটাই ববির কাছে বেশি কামনার বস্তু হয়ে ওঠে। সে এখন স্বমেহন করে লুকিয়ে, শুকরটার ওপর উপগত হবার কথা ভেবে। ইদানিং সে তাকে তুমি করে বলা শুরু করেছে। তার বেশি করে যত্ন নিচ্ছে। শুকরটাও এখন ববির সাথে সময় কাটাতে বেশ পছন্দ করে। ববি সময় নেয় তাদের সম্পর্কের গভীরতা আরো বেড়ে যাওয়াতক। তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। একদিন সে লাজুক কণ্ঠে তাকে বলেই বসে,
"আমি তোমাকে ভালোবাসি। আশা করি আমার হতে তোমার কোন আপত্তি নেই।"
শুকরটা ববির পাশ ঘেঁষে আসে। ববি বুঝতে পারে, তাদের সেই সময় এসে গেছে। এখন শারীরিক মিলন করলে দোষ হবে না...
*
এক বছর পর। ববির স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সে এখন চার চারটি শুকরশাবকের পিতা। যেদিন প্রথম সে শুকরটির সাথে মিলিত হলো, তাতে কোন বিকৃত যৌনকামনা বা লালসার ব্যাপার ছিলো না। সে ভালোবেসে প্রেমিকার মতো করে আদর করেছিলো তাকে। এরপর এ বিষয়টি ক্রমাগত চলতে থাকে, এবং শুকরটি গর্ভবতী হয়। তখন ববির ইচ্ছে করেছিলো মৃত মানুষদের অথবা শূন্যের বসতিতে গিয়ে চিৎকার করে বলে,
"হ্যাঁ, এই দেখ, আমি ববি। আমিও কাউকে ভালোবাসতে পারি। আমিও কারো পিতা হতে পারি, স্বামী হতে পারি, প্রেমিক হতে পারি। তোদের কারো সাহস থাকলে আয় এখন আমাকে অপদস্থ করার জন্যে। আমি এখন হবু পিতা, আমি একটি মহিয়সী শুকরের বিশ্বাসী প্রেমিক, আমার শক্তি কত বেড়ে গেছে জানিস তোরা? এখন কেউ আয় আমার সামনে যদি সাহস থাকে"
কিন্তু ববি যায় না ওকথাগুলো বলার জন্যে। তার চোখে মৃত মানুষের সারি, ইচ্ছেখাতার ছেড়া পৃষ্ঠার দূরন্ত অভিযাত্রা, আর শূন্যের নামতা ভাসে। সে একবার ঐ জিনিস দেখেছে, হয়তোবা ঘুমের ঘোরে, হয়তোবা ঈশ্বরের ইচ্ছায়, হয়তো বা সত্যি হয়তো বা মিথ্যা, সে এটুকু দেখেই খুশি। তার আর দ্বিতীয়বার যাচাই করার ইচ্ছে জাগে না। তার আগত সন্তানদের জন্যে ছোট ছোট কাপড় বুনে বেশ সময় কেটে যায়। সন্তানগুলো মানুষ না শুকর হবে, নাকি কোন এক শঙ্কর প্রজাতি, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তবে এটা তার অবকাশকালীন ভাবনার চমৎকার একটা উপকরণ হয়ে থাকে। সে ছোট্ট কিছু ছড়াও বেঁধেছে। যেমন,
"ওরে আমার বাচ্চাটা
তুই কি হবি, মানুষ নাকি?
হলিই না হয় ছোট্ট শুকর
খোদার কাছে হাজার শোকর"
ছড়াটি সে তার প্রেমিকাকে পড়ে শুনিয়েছে। সে পছন্দ করেছে বলেই মনে হলো। এভাবে আশ্চর্য নির্মল অনুভবে কেটে যাচ্ছিলো ববির দিনকাল। হঠাৎ একদিন তাদের মধ্যে দাম্পত্য জটিলতা শুরু হলো। দোষটা অবশ্য ববিরই। সে স্বপ্নে দেখেছিলো তার প্রেমিকাকে গর্ভবতী করেছে অন্য কোন শুয়োর। এরপর সে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি শুরু করে তাকে অযথাই। তাকে "চরিত্রহীনা" পর্যন্ত বলে বসে। এবং এই কসাইখানা থেকে তার আর কোথাও যাওয়া বারণ বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে অবশ্য তার অনুতাপ হয়েছিলো। সে জানে তার প্রেমিকা অমন শুকরিনীই নয়। তবে দাম্পত্য জীবনে মাঝেমধ্যে তো এমনটা হতেই পারে। ববি আচ্ছা করে স্যরি বলে মাফ চেয়ে নেয়।
দিনগুলো কেবল দীর্ঘ হতে থাকে। বুনতে বুনতে কাপড় শেষ হয়ে যায়। নতুন জামা বানানোর আর কোন সুযোগ নেই। ববি ছটফট করতে থাকে পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার জন্যে।
"শরীর খারাপ করছে তোমার সোনা?"
শুকরিনী সকাল থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি প্রকাশ করছে ব্যথায়। মাঝেমধ্যেই ককিয়ে উঠছে। ববি বুঝতে পারে আজকেই সেই দিন! উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়ে সে। পানি গরম করা, ছুরিটা পরিষ্কার করা, কত কাজ!
"একটু ধৈর্য্য ধর সোনা, মা হতে হলে একটু কষ্ট করতেই হয়"
সে নিবেদিতপ্রাণ স্বামীর মত করে সাহস যোগায় তাকে।
অবশেষে চারটি ফুটফুটে শুকর ছানা পৃথিবীর আলো দেখে। ববির জীবনটাও আলোকিত হয়ে ওঠে। সে তাদের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চাগুলো বেশ লাফঝাঁপ শুরু করে। ববি তাদেরকে যত্ন করে গোসল করায়, পোষাক পরায়, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার স্ত্রীকে বলে,
"ছেলেগুলো দেখতে আমার মতো হয়েছে, আর মেয়েগুলো তোমার মতো, তাই না?"
কিছুদিন পর ববির মধ্য থেকে আনন্দের ভাবটা কেটে গিয়ে বিষাদ ভর করে। কারণ, তার সন্তানেরা মোটেও তাকে পছন্দ করে না। মায়ের ন্যাওটা হয়েছে বড়। ববির জীবনটা শূন্য লাগে। যে পরম একাকীত্বের জন্যে সে মনুষ্যপ্রজাতির হন্তারক হয়ে পরিত্যক্ত কসাইখানায় শুকরিনীর সাথে একাকী জীবন ভাগাভাগি করছিলো সেই একাকীত্ব তাকে এমন উপহাস করবে সে ভাবতেই পারে নি। ববি চেষ্টার কোন ত্রুটি করে নি। সে তাদেরকে খাইয়ে দেয়, কাপড় চোপড় পাল্টে দেয়, শরীর নোংরা হলে পরিষ্কার করে, খুশির আতিশয্যে সে কয়েকটি নতুন ছড়াও লিখে ফেলেছিলো তার সন্তানদের জন্যে। এখন এসব কিছুই অর্থহীন মনে হয়। বাচ্চাগুলো তাদের মায়ের কাছেই ঘুমোয়, মায়ের সাথেই খেলা করে, আহ্লাদ দেখায়। শুধুমাত্র প্রয়োজন হলে ববির কাছে আসে। যেন সে পরিবারের পরিচারক। ববির পিতৃসত্ত্বা প্রবলভাবে আহত হয়। তার স্বপ্নগুলো ভীষণ গোত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। আসলে পরিবারের স্বপ্ন দেখাই তার জন্যে কাল হয়েছে। সে একাকী ছিলো তাই ভালো ছিলো। আবার বাড়ছে ভীড়, বাড়ছে শঙ্কা, বাজছে অপমানিত আর হেনস্থা হবার টঙ্কার। দরকার নেই তার প্রেমিকার, দরকার নেই সন্তানের। মুখ ভার করে ভাবে সে। বিক্ষিপ্ত মনকে স্থির করার জন্যে সে বুনো মহুয়া ফুল খায়। প্রায়ই সে মহুয়া খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে গভীর রাত করে। এ নিয়ে তার স্ত্রীর সাথে মাঝেমধ্যেই তর্ক হয়। একদিন, মহুয়া একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিলো সে। উৎফুল্ল মনে বাসায় এসে সন্তানদের কোলে তুলে নিতে চায়। কিন্তু তারা বন্য ঘোঁৎঘোঁৎ শব্দ করে তাকে তাড়িয়ে দেয়। এবার ববির ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। নিজের সন্তান তার সাথে এমন বেয়াদবী করবে ভাবতেও পারে নি। ছেলেমেয়েদের সামনে সে কখনও মুখ খারাপ করে নি, কিন্তু এবার সে বিশ্রী গালাগাল করে ওঠে।
"নটি মাগীর ছেলেপিলে সব! তোদের মা যেমন অসতী তোরাও তেমনই হবি। তোদের জন্যে কী না করেছি! জামা কাপড় বানিয়ে সভ্য করেছি, খাইয়ে দিয়েছি, আদর করেছি আর তোরা বাপের সাথে বেয়াদবী করিস! এমন সন্তান দরকার নেই আমার। মর তোরা!"
বলেই হাতের কাছে ছুরিটা নিয়ে তার চার সন্তানকেই গলা কেটে হত্যা করে। হত্যা করার পর নেশা কেটে সে অনুতাপ-শোক ইত্যাদি করতো হয়তো, কিন্তু সে সুযোগটাই দিলো না তাকে তাদের মা। ভীষণ আক্রোশে ধাওয়া করে তাকে মেরে ফেলার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে। হয়তো বা নিজের সন্তানদের হত্যা করার পর তার জীবনের কোন অর্থই থাকতো না, সে হয়তো নিজেই নিজের প্রাণ সংহার করতো, কিন্তু মনের ভেতর আদিম, বুনো কেউ তার মধ্যে বাঁচার জন্যে দৌড়োতে উদ্বুদ্ধ করে,
"পালাও ববি পালাও"
ববি ছুটতে থাকে। সে ভুলেই যায় পরম একাকীত্ব অর্জনের জন্যে তার প্রার্থনার অলৌকিক ফলাফলে অথবা দৃষ্টিভ্রমে অথবা অবচেতন মনের কারসাজিতে সে একটা মৃত শহর উপহার পেয়েছিলো, যার সীমানায় যাওয়া বারণ। গেলেই যদি মৃতেরা বেঁচে ওঠে! অথবা, হয়তো তারা সবাই একসাথে ঘুমোচ্ছিলো, যদি জেগে ওঠে! যদি তার কসাইখানার পচা মাংস, বীর্য, মানবসারের প্রাসাদ ভেঙে যায়! যদি...
*
-এই দেখ দেখ, ওটা কে দৌড়ুচ্ছে ববি না?
-হ্যাঁ, পেছন পেছন একটা শুকর। আজকে মজা জমবে ভালো। দাঁড়া সবাইকে খবর দিয়ে আসি!
দুই কিশোরীর মন ফূর্তিতে ভরে ওঠে।
ববি তার নিজস্ব বলয় পেরিয়ে হতাশ চোখে দেখতে পায়, শহরের কিছুই বদলায় নি!
গল্পটি একটি বেলজিয়ান ফিল্ম Vase de noces দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন