তার ধারণা আমি আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গেছি। বুকে, পেটে কিছু বাড়তি মাংস জমেছে। ত্বক হয়েছে কমনীয়, পেলব এবং মসৃণ। আগের সেই হাড়গিলে ভাবটা নেই, স্বাস্থ্যের সৌন্দর্যে আমি নাকি ঝলমল করছি। আমরা দুজনে বিকেলে পার্কে বসে চিনাবাদাম চিবুচ্ছিলাম। সে যখন কথাগুলো আমাকে বললো, আমার মনোযোগ ছিলো বাদামের খোসাগুলোর প্রতি। কী সুন্দর পলকা, মচমচে শরীর ওদের! একটু মুচড়ে দিলেই ভেঙে যায় টকাশ করে, ফু দিলেই উড়ে যায়। আমার সৌন্দর্য বৃদ্ধিজনিত ব্যাপারে তার বক্তব্য আনমনে হেলা ভরে শুনছিলাম।তবে শুনতে ভালোই লাগছিলো। তার স্তুতিপর্ব শেষ হলে আমার কাছে জানতে চায় কীভাবে আমি এমন সুন্দর স্বাস্থ্য আর কোমল ত্বকের অধিকারী হলাম। প্রশ্নবোধক বাক্যের জবাবে কিছু না বলাটা অভদ্রতা। কিন্তু আমি ভাবছিলাম তার উদ্দেশ্যটা কী। বাদামের খোসাগুলো হাত দিয়ে ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
-মতলবটা কি তোমার? প্রপোজ করবে নাকি সেক্স? এত ভূমিকা না করে বলেই দাও না।
আমার এমন উদ্ধত, দুর্বিনীত প্রশ্নে অবশ্য তাকে কিছুমাত্র বিচলিত মনে হলো না। হয়তোবা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলো, তবে দ্রুত সামলে নিয়ে সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সৌন্দর্যকলার প্রসঙ্গে কথা বলে চললো হড়বড় করে। এবং বলতে বলতে ঘুরে ফিরে সেই একই প্রসঙ্গ চলে এলো আবার, আমার সৌন্দর্য।
-তুমি তাদের কারো চেয়ে কম নও।
এই বলে সে উপসংহার টানলো।
বাদামের খোসাগুলো দুরমুশ করে কাগজের প্যাকেটে ভরে দূরে ছুড়ে দিয়েছি আমি ততক্ষণে। করার মতো আর কোন কাজ না থাকায় এবার আমি তার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেই।
-থ্যাংকিউ। তবে তুমি যাকে সৌন্দর্য বলছো, আমার কাছে এটা বয়সবৃদ্ধিজনিত মেদমোহ ছাড়া আর কিছুই না।
-মেদ কথাটা বড় স্থুল এবং কর্কশ। আর বয়সের নিজস্ব একটা সৌন্দর্য তো আছেই যাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেবে এলে এবং স্থানটিকে আমাদের বিবেচনায় অনিরাপদ মনে হওয়ায় আমরা চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। সে আমাকে প্রস্তাব দেয় বিদায়চুম্বন করার জন্যে, কিন্তু আমি তাকে জানাই যে সকালে ঠিকমতো ব্রাশ না করার কারনে আমার মুখে দুর্গন্ধ থাকতে পারে, এছাড়াও বলি যে আমাদের সম্পর্কটা এখনও তেমন পর্যায়ে যায় নি। তবে আসল কথাটাই চেপে যাই, আমি কিছু বাদামের খোসা হাতে রেখে দিয়েছিলাম, সেগুলো মুখে পুরে চিবুচ্ছিলাম। এমন একটা বদঅভ্যাস আমার আছে তা তাকে জানতে দিতে চাই নি, তারচেয়েও বড় কথা চিবুতে বড় ভালো লাগছিলো। রাতের বেলা বাসায় খাবার মতো কিছু নেই। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাদামের খোসা খুঁজতে বেরুলাম। এই সন্ধ্যায়, নির্জন আঁধার পার্কে বাদামবিক্রেতা পাওয়া দুষ্কর। তবে মানুষের ফেলে দেওয়া খোসা থেকে খুঁজে খুঁজে প্রায় ৫০ গ্রামের মতো সংগ্রহ করতে পারলাম। বাদামের খোসা এবং শারিরীক সৌন্দর্য বিষয়ক আলোচনা আমার আজকের রাতটাকে অর্থময় করে তুলবে নিঃসন্দেহে।
আমায় সে সুন্দর বললো কেন, আর আমার বাদামের খোসা চিবুতে ভালো লাগছিলো কেন, এই দুটি প্রশ্নের মধ্যিখানের জংশনে কিছু একটা জবাব অপেক্ষমান রয়েছে আমি বেশ বুঝতে পারছি। শহরে নতুন চালু হয়েছে মেট্রোরেল। আমি সেই অজানা জংশনটার খোঁজে ট্রেনে উঠে পড়ি। ভাবতে ভাবতে আর চিবুতে চিবুতে একসময় ঠিক স্টপেজটাতে নেমে যাবো। রেলের কামরায় খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, আমি তাকেও খুঁজে পেলাম এখানে। সেও হয়তো কোন কুহকজংশনের মায়ায় বাঁধা পড়ে সন্ধ্যাকালীন কাজকর্ম স্থগিত করে উঠে পড়েছে ট্রেনে। আমাকে দেখে সে কোনরকম বিস্ময় প্রকাশ বা কুশল বিনিময় ব্যতিরেকেই আবারও আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুরু করলো। তার এমন আচরণে আমি বাদামের খোসা আর সৌন্দর্যের মধ্যবর্তী বিন্দুটি খুঁজতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হই, এবং তাকে জিজ্ঞেস করি সে কোথায় চলেছে। উত্তরে সে জানালো পার্ক থেকে বের হবার সময় আমার পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে সে এখানে এসে পড়েছে। তার গন্তব্য কোথায় জানা নেই। এতে আমি বিরক্ত হয়ে আবারও সেই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করি,
-চাও কী তুমি বলোতো? প্রপোজ করবে নাকি সেক্স?
এবার সে আর প্রসঙ্গটা না এড়িয়ে মুখোমুখি হয়,
-আমি আসলে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। তোমার সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে এটা ঠিক। কিন্তু প্রপোজ করার মতো অসামাজিক, অশৈলী, বর্বর কাজ করার মতো জঘন্য নিশ্চয়ই আমাকে ভাবতে পারো না তুমি। আর তোমার সাথে সেক্স করাটা স্বাস্থ্যসম্মত হবে না। কারণ আমি লোকমুখে শুনেছি তোমার সিফিলিস আছে।
তার জবাবের প্রথমার্ধ আমার বেশ পছন্দ হয়। চিন্তা এবং মননে সে বেশ আধুনিক হয়ে উঠেছে। আমি তাকে এরকম ভাবতাম না। চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যের ঝাঁকি দেয়ার মতো ব্যাপারগুলোকে সবসময়ই সে পরিহার করে এসেছে। তার কথার দ্বিতীয়ার্ধ আমার আরো বেশি পছন্দ হয়। প্রথমত, আমার যে সিফিলিস আছে এই সত্যি কথাটা জানার ফলে তার প্রজ্ঞাই প্রকাশ পায়, দ্বিতীয়ত, যৌনকর্মের ব্যাপারে তার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি খুশী হয়ে তাকে কিছু বাদামের খোসা উপহার দিই। সে তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। বলে যে তার মাসিক চলছে। এসময় বাদামের খোসা খেলে তার শ্বেতস্রাব হয়।
-তুমি আগেও বাদামের খোসা খেয়েছো নাকি?
-না খাই নি।
-তবে কীভাবে জানলে এটা খেলে শ্বেতস্রাব হয়?
-তোমার দেয়া উপহারে এমন ক্ষতিকর জীবাণু থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তুমি সিফিলিসের রোগী।
বলে সে অবহেলার ভঙ্গিতে হাসতে থাকে আমার দিকে চেয়ে। আমি বুঝে নেই অজান্তেই তাকে প্রপোজ করে ফেলেছি, আর সে আমায় রিফিউজ করো। এই চর্বিজর্জর, খসখসে খোসার সময়ের প্রসারে কফ-থুতুর সোঁদা গন্ধে নিমজ্জিত সান্ধ্যকালীন ট্রেনের যাত্রীদের ভালোবাসার আদান প্রদান এমনই হয়ে উঠেছে। আমি তাকে বাদামের খোসা দেয়ার কথা বলায় নিজের অজান্তেই প্রপোজ করে ফেলি, আর সে বানিয়ে বানিয়ে শ্বেতস্রাবের কথা বলায় আমাকে রিফিউজ করে। শেষপর্যন্ত পুরোনো সেই নারীবাদী তত্ত্বেরই জয় হলো, ছেলেরা প্রপোজ করবে আর মেয়েরা হালকা ছিনালি, হালকা নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে না করবে।
আমি বিমর্ষ মনে বাদামের খোসা চিবুতে থাকি। এই নিষ্ঠুর, কঠিন পৃথিবীতে, যেখানে আজকাল সৌন্দর্যের প্রশংসা করে অবচেতনেই নিবেদন করতে প্রলুদ্ধ করে তারপর না করে দেয়া হয়, সেখানে বাদামের খোসার মত নিরর্থক, অকেজো একটি বস্তুই বড় সহায়! আমি ধীরে ধীরে মধ্যবিন্দুতে পৌঁছে যাচ্ছি, সমীকরণের সমাধানের দ্বারপ্রান্তে, হুইসেল শোনা যাচ্ছে, সেই অজানা জংশন নিকটবর্তী। আমি জেনেছি আমাদের সৌন্দর্যস্তুতির চেয়ে ভঙ্গুর বাদামের খোসা বেশি টেকসই, আমি জেনেছি প্রেমের নিবেদন বা প্রত্যাখ্যানের মধ্যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য সিফিলিস আর শ্বেতস্রাব জাতীয় রোগের জীবাণু। আমাকে এখন নেমে যেতে হবে। অচেনা, আঁধার জংশনে একা। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি সেই স্টেশনের জন্যে।
ট্রেনের গতি থেমে আসছে। আমি নেমে যাবো এখন। নেমে যাবো ভঙ্গুর পদার্থ আর জীবাণুআক্রান্ত কোন নির্জন জায়গায়। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নেমে যাই। স্টেশনটা খুব পরিচিত লাগে। আরে... এটাতো সেই পার্কটা! যেখানে আজকে বিকেলে বসে আমরা গল্প করছিলাম। সেই বেঞ্চের সামনে গিয়ে বসার পর আবিষ্কার করি সেও আমার সাথে রয়েছে। তার শরীরের তলদেশ থেকে একটা বোঁটকা গন্ধ।
-তুমি এখানে এলে কেন?
জিজ্ঞাসা করলাম।
-তোমার বাদামের খোসাগুলোর মোহময় গন্ধই আমাকে টেনে নিয়ে এলো। কী মনে করে একটা মুখে দিলাম, আর সত্যিই দেখ আমার শ্বেতস্রাব শুরু হলো। তাই তো এমন বোঁটকা গন্ধ বেরুচ্ছে।
-ভালো। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমার এখন। তোমাকে একটা শুভরাতচুম্বন দিয়ে ঘুমুতে যাবো।
-নাহ, আমার পেটে গ্যাস হয়েছে। বাজে ঢেকুর উঠছে। তোমার চুম্বন প্রত্যাখ্যান করছি বলে ভেবো না যে তোমাকে কুৎসিত লাগছে। তুমি সুন্দর হয়ে গেছো আগের চেয়ে।
-সেক্স না প্রপোজ?
সে কোন উত্তর দেয় না। আমরা দুজনে তন্নতন্ন করে সমস্ত উদ্যান খুঁজে বাদামের খোসা খুঁজে বের করে বিছানা বানানোর কাজে লেগে পড়ি। ঘুমুতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা, স্বপ্ন দেখতে হবে। যেই স্বপ্নে বাদামের খোসার বিছানার বদলে আমরা শুয়ে থাকবো কুসমাস্তীর্ণ বিছানায়। যেখানে আমাদের সিফিলিস, শ্বেতস্রাব, প্রপোজ বিষয়ক জটিলতা, মুখের গন্ধ, বাজে ঢেকুর কিচ্ছু থাকবে না। আমরা সহজেই একে অপরকে বলতে পারবো...
-আজ সারারাত লেগে যাবে, তাও বিছানা গোছানো শেষ হবে না। এত বাদামের খোসা পাবো কোথায়?
তার কথায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। একটা বিছানা, একটা ঘুম, একটা স্বপ্নের জন্যে হয়তো বা আমাদের রাতের পর রাত বাদামের খোসা সংগ্রহ করতে হবে, তারপর আমরা বুড়িয়ে যাবো, আমাদের চামড়া কুঁচকে যাবে, যৌনক্ষমতা রহিত হবে, তখন আর কেউ কাউকে বলতে পারবো না "তুমি খুব সুন্দর" অথবা "এটা সেক্স নাকি প্রপোজের জন্যে বলা!"। কুঞ্চিত চামড়ায় অশক্ত শরীরে জরাগ্রস্ত মনে অত কিছু বলার বা ভাবার জটিলতা কে টেনে আনবে খামোখা!