মিতিন
ছোট্ট একটা সরিষাবীজের আকৃতি নিয়ে পৃথিবীর বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেকে অধিষ্ঠিত করার আগ্রহে চুপচাপ শুয়ে আছি এমনিয়োটিক ঝুলির ভেতর। একটু ভয় ভয় করছিলো অবশ্য, কিন্তু প্লাসেন্টার মাধ্যমে যখন মায়ের শরীরের সাথে সংযুক্ত হলাম, খাদ্য এবং পুষ্টির অবাধ যোগানে ভয়টা কেটে গেলো। এই অবস্থায় আমাকে বলা হয় এমব্রায়ো। কী সব বিটকেলে যাচ্ছেতাই নাম রে বাবা! আর তোমরা বড়রা আমার কথা শুনে এমন গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থেকোনা তো! পঞ্চম সপ্তাহের মধ্যেই আমার ফুসফুস, মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, স্পাইনাল কর্ড তৈরি হয়ে যাবে। একটা মানুষের মিনিয়েচার না হলেও মাইক্রোয়েচার তো বলা যেতে পারে আমাকে তখন নাকি! আমি হয়তো বা এখন তোমাদের দৃষ্টিতে একটা এককোষী জীবের বেশি কিছু নই, তাই আমার এমন গড়গড় করে কথা বলায় তোমাদের ভারী গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। বড়দের নিয়ে এই এক ঝামেলা। সবকিছুর শূলুকসন্ধান, তত্ত্বতালাশ তাদের করা চাই'ই চাই! যাও তো, আমাকে একটু বুঝতে দাও ব্যাপারস্যাপার। মায়ের শরীর থেকে খাদ্য আসছে আমার কাছে। আমার এখন লাঞ্চটাইম। বিরক্ত করো না।
জীবনের প্রয়োজনে আমাকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে, চিনতে হয়েছে প্রথম আবাস, সুপেয় তরল, বন্ধু গ্রন্থিসমূহ। আমার ভেতরেও যে জীবনের অনুরণন বয়ে চলেছে, বাঁচার তীব্র আকুতি তোমাদের কারো চেয়ে কম নয়, তা কি তোমরা বোঝো? তোমরা না বুঝলেও মা ঠিকই বুঝবে। তবে মাকে আমি এখনও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি নি। যুগ যুগান্তর থেকে বয়ে আসা আদিম বুনো তথ্য আমাকে বাঁচার প্রেষণা যুগিয়েছে, মায়ের কথা জানিয়েছে। শুনেছি মাকে ছাড়া নাকি আমাদের মত প্রাকপ্রাণীপর্বের জীবেরা একদম থাকতে পারে না। ব্যাপারটা শুধুমাত্র খাদ্য আর পুষ্টির নিশ্চিত নির্ভরতা আছে বলে নয়, তাহলে তো কেমন যেন দেয়া-নেয়ার মত হয়ে গেলো। এটা আরো গভীর এবং অসম্ভব প্রভাববিস্তারী। সামনের দিনগুলোতে জানতে পারবো। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
আমি
আর মাত্র দুই দিন পর মিতিনের প্রথম জন্মদিন। প্রথম জন্মদিনে বেশ ঘটা করে আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবার এক আবদার-খাওয়াতে হবে। সে খাওয়ানো যাবে। দু:খের বিষয় এত আয়োজন-আনন্দের কোন স্মৃতিই তার থাকবে না পরবর্তীতে। এক বছর বয়সের স্মৃতি কি মানুষের মনে থাকে? গত একবছরে আমার জীবন পাল্টে গেছে অনেকটাই। পাল্টাবে না কেন! বাবা হওয়া কী যে সে কথা? আগে বাসায় ফিরতে দেরী করতাম মাঝেমধ্যেই; ইচ্ছে করেই। আর এখন মনটা ছটফট করে কখন বাসায় গিয়ে আমার ছোট্ট জীবন্ত পুতুলটাকে কোলে নেবো, আদর করবো। লোকে বলে ও নাকি দেখতে একদম আমার মতই হয়েছে। বেশ ভালো লাগে শুনতে। "রক্তের বন্ধন" "নাড়িছেঁড়া ধন" এসব শব্দের মানে এখন বেশ বুঝতে পারি আমি। আগে কেমন অতি নাটুকেপনা আর কৃত্রিম আবেগের সমন্বয় মনে হতো শব্দগুলোকে। রাতের বেলা ঘুম ভেঙে বাজে স্বপ্ন দেখে কিংবা পেটব্যথায়; কে জানে, মিতিন যখন করুণ স্বরে কেঁদে ওঠে, তখন তাকে কোলে নিয়ে হাঁটার সময় বুঝি, রক্ত বস্তুটা কত শক্ত সূতোয় বাঁধতে পারে পরস্পরকে। এই যে একবছর কেটে গেলো তার জন্মের, গত এক বছরে একটা বোধ আমাকে ঋদ্ধ করেছে। আগে একটা বছর পেরিয়ে গেলে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়তো। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া হলো আরো একধাপ। আর এখন? এখন মনে হয় আমার মেয়ের বয়স যত বাড়ছে তা যেন আমার জীবনসম্ভারে ধনাত্মক প্রাণচিহ্নের আকারে যুক্ত হচ্ছে। গত একবছরে আমার বয়স এক বাড়লেও তা মৃত্যুমুখী ছিলোনা, ভীষণভাবেই জীবনমুখী।
মিতিন
আরেব্বাহ! আমার নাক, মুখ, আঙুল, পায়ের পাতা তৈরি হয়ে গেছে। আকারও পেয়েছে বেশ সুন্দর। অবশ্য বড় মানুষেরা বলে এই পর্যায়ে নাকি এলিয়েনের মতো লাগে দেখতে। এলিয়েনরা দুষ্টু। আমার মনটা তাই একটু খারাপ। আরো একটা ব্যাপার নিয়ে বিব্রত, ব্যাঙাচির মত একটা লেজ গজিয়েছে আমার। উটকো জিনিসটাকে মোটেই সহ্য হচ্ছে না। যদি ওটা থেকেই যায় ভুমিষ্ট হবার পরেও? বাবা-মা কি তখন আমাকে এখনকার মতো করে এত যত্ন করবে? এই যে তারা এখন রিক্সায় চড়লে ভাঙা রাস্তা এড়িয়ে চলে, সাবধানে চালানো নিয়ে রিকশাঅলার সাথে ঝগড়া করে, সামনে কোন স্পিডব্রেকার থাকলে ঝাঁকুনি এড়ানোর জন্যে মা দাঁড়িয়ে যায়, মাথাব্যথা হলেও আমার ক্ষতি হতে পারে ভেবে ঔষধ খায় না, এই যে আমাকে নিয়ে বাবার এত দুশ্চিন্তা, মাসে মাসে চেক-আপ, গাদাগাদা ঔষধ কেনা, এতকিছুর পরে যদি দেখে যে আমি লেজঅলা কিম্ভূত একটা প্রাণী, তখন কী হবে? মনমরা হয়ে আছি কদিন ধরে এ কথাটা ভেবে।
যাক! লেজটা খসে গেছে অবশেষে! ছোটছোট দাঁতও গজিয়েছে আমার। ইচ্ছে করে কুটকুটিয়ে কামড় দেই সবাইকে। এখানে কামড়ানোর মত তেমন কিছু নেই। আচ্ছা, বড় হয়ে নেই দাঁড়াও! হৃৎপিন্ডটা সারাক্ষণ প্রবল গতিতে স্পন্দিত হতে থাকে। বেশ মজা লাগে আমার। সারাক্ষণ যেন ড্রামস বাজছে। আমি এখন চোখ পিটপিট করতে, হাত নাড়াতে পারি। আঙুল বাঁকানোটাও শিখে গেছি। সপ্তাহখানেক এভাবে বেশ মৌজে কাটলো। তারপর একদিন দেখি কী, তাজ্জব ব্যাপার! আমি রেগে গেলে, বিরক্ত হলে তাও প্রকাশ করতে পারছি! সেদিন যখন বাবা রাত করে বাসায় ফিরে মায়ের সাথে ঝগড়া করছিলো, আমার রাগ হচ্ছিলো খুব। রেগেমেগে কিছু বলবো ভাবতেই দেখি যে আমার চোখ কুঁচকে আসছে বিরক্তিতে! এ এক দারুণ নতুন ব্যাপার। এখন থেকে আমার সামনে বাবা-মা কোন ঝগড়াঝাটি করলে এভাবে খুব বকে দেবো। আরো একটা বিষয় নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। আমাকে এখন আর এলিয়েনদের মত দেখায় না। এবার যখন আল্টাসনোগ্রাম করতে গেলো, ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম আমি। বাবা-মার সাথে যোগাযোগের এ মাধ্যমটা বেশ পছন্দ আমার। তারা আমাকে দেখছে! কী দারুণ! একটু সাজুগুজু করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সে সুযোগ তো নেই, তা নিয়ে আর ভেবে কী হবে! আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম তাদের দুজনের আবেগটুকু। আনন্দাশ্রু লুকোনোর ছল করে অন্যদিকে তাকানো, কী ছেলেমানুষ আমার বাবাটা!
আমি
যতই দিনটা এগিয়ে আসছে, আমার মানসিক অস্থিরতা তত বাড়ছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে আছি। মাতৃগর্ভে শিশু থাকা অবস্থায় হবু বাবারা অনেকসময় মানসিক বিপর্যয়ে পতিত হয়। আমার ক্ষেত্রে অবস্থাটা বিপর্যস্ত না হলেও খুব একটু ভালোও না। নানারকম আশঙ্কা আর উদ্ভট চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। তিথির পেটে হাত দিয়ে আমার অনাগত সন্তানের 'কিক' অনুভব করা এখন আমার শ্রেষ্ঠ বিনোদন। কখনও কিক দিতে দেরী হলে বা কমজোরী কিক হলে মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। গত ১৪ই ডিসেম্বর দিনটা যা গেলো না! সকাল থেকে প্রায় চার ঘন্টা বাচ্চার নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই। ওর মায়ের তো কাঁদোকাঁদো অবস্থা। দুপুর ১২টার পর সিদ্ধান্ত নিলাম আর অপেক্ষা নয়, আর কোনো ঝুঁকি নেয়া চলবে না। রবি ফুপার গাড়িটা ধার করে হাসপাতালে ছুটলাম। বেছে বেছে ওইদিনই যে কেন শুক্রবার পড়লো! আশেপাশের ডেল্টা আর সেলিনা হসপিটালের ইমার্জেন্সি বন্ধ। ছুটতে হলো সেই গ্রিন লাইফে। ডাক্তার এসে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন বেবির হার্টবিট নরমালের তুলনায় বেশি। সম্ভবত অক্সিজেন কম পাওয়াতে এমন হচ্ছে। এ্যামনিয়োটিক কর্ডের অবস্থানগত পরিবর্তনে এমন হতে পারে। অক্সিজেন দিতে হবে তিথিকে। অবশেষে অক্সিজেন দেয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক হলো। সস্তা ঘিঞ্জি ওয়ার্ডে সারাক্ষণ তিথির সাথে কাটিয়ে দিনটা অবশ্য খারাপ গেলো না একেবারে। আগত মাতৃসম্ভাবনা, স্বস্তিদায়ক অক্সিজেন আর সবার সামনে নির্লজ্জের মত হাত ধরে থাকা, ফাঁকতালে একটা চুমু সব মিলিয়ে তার মুখে এক আশ্চর্য আনন্দ আভা খেলা করছিলো, যা আগে কখনও দেখি নি।
সামনের মাসটা যেন কতদূর! আল্টাসনোগ্রামের রিপোর্টে লেখা আছে সম্ভাব্য তারিখ ৮ থেকে ১৮ই জানুয়ারির মধ্যে। ইদানিং আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সন্তানকে দেখে যাবার সৌভাগ্য নেই আমার। তার আগেই ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। আমি মারা যাবো। এরকম অবশ্য অনেকদিন ধরেই মনে হচ্ছে, তবে তীব্রতাটা খুব বেশি আজকাল।
আমাদের সন্তানের নাম কী দেবো সব বাবা-মার মতই আমরাও সেটা নিয়ে ভাবছিলাম খুব। কত সাহিত্যিভরা, দুষ্টুমী মাখা দেশী, ইরানি, আরবী, ইতালিয়ান, ইংরেজি শব্দ মাথায় আসে, কোনটাই আমাদের নিরীখ পার হয়ে চুড়ান্ত হতে পারে না। একদিন হঠাৎ করেই নাম নিয়ে চিন্তা ভাবনার অবসান ঘটলো। কবিবন্ধু শিরীষের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে মিতিন নামটা পেলাম। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি শব্দ, যার অর্থ বন্ধু। নামটা আমাদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়ে গেলো। ঠিক করলাম, ছেলে হোক বা মেয়ে, ডাকনাম এটাই হবে।
অবশেষে সেই দিনটি এলো! সকাল ছটায় তিথি আমার ঘুম ভাঙিয়ে জানালো যে তার পেইন হচ্ছে। আমি তার চোখমুখ দেখেই বুঝলাম হাসপাতালে নিতে হবে। বাসার সবাই তড়িঘড়ি করে প্রস্তুত হয়ে গেলো। গাড়িও রেডি। গন্তব্য সেই গ্রিন লাইফ হসপিটাল। তিথির ডাক্তার চাইছিলো নরমাল ডেলিভারিই হোক, দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। তখন বাজে কেবল দশটা। আরো চার ঘন্টা! এদিকে তিথির পেইন দেখে আমার নিজেরও কেমন যেন লাগছে। মাথা ঝিমঝিম আর শরীর দুর্বল করতে লাগলো। একটু পানি দেয়ার জন্যে বেসিনের কাছে গিয়ে আমি এক অদ্ভুত কান্ড করলাম। পিতা হবার ঘন্টাকয়েক আগের টেনশনটা ফ্রেমবন্দী করে রাখতে সেলফোন দিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম নিজের। বুকের ভেতর ভীষণ তোলপাড়। মনে হচ্ছিলো হৃৎপিন্ডটা ছিটকে বের হয়ে আসবে। হার্টের কোন সমস্যা হলো নাকি কে জানে!
বেলা দেড়টার সময় তিথির ভাই ইশতিকে নিয়ে রক্তের ক্রসম্যাচিং করার জন্যে গ্রিন লাইফের আরেকটা ভবনে যেতে হলো। 'ও' নেগেটিভ রক্ত খুব রেয়ার, তাই ডাক্তার বলেছে আগে থেকেই ডোনার রেডি রাখতে। বেলা ১.৩৮ এ আমার মা ফোন করে আনন্দমুখর উষ্ণ কণ্ঠে জানালেন "হাসান তোর মেয়ে হয়েছে!"। খবর শুনেই আমি দৌড়ে ছয়তলা সিঁড়ি ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছুলাম ওটিতে। আমার কোলে যখন মিতিনকে দেয়া হলো, সময় তখন ১.৪০, তারিখ ৩'রা জানুয়ারি,২০১৩।
মিতিন
এখন আমার ওজন কত জানো? আড়াই আউন্স। দৈর্ঘ্যে চার ইঞ্চি। দাঁড়াও দাঁড়াও! এখন আমি পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের পাঁচ আউন্স ওজনের একটা দশাসই শিশু! গত দুই সপ্তাহে খুব দ্রুত বেড়েছি। মাথাটা ঘাড়ের ওপর শক্তভাবে সেঁটে থাকে। নরম কার্টিলেজগুলো ক্রমশ শক্ত হয়ে হাড়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্লাসেন্টার সাথে সংযোগকারী নলটা অনেক দৃঢ় এবং পুরু। মাতৃগর্ভ জায়গাটা দিনদিন আরামদায়ক হয়ে উঠছে। মন ভালো থাকলে আমি নড়াচড়া করি, খেলি। তবে বেশিরভাগ সময়ই কাটে ঘুমিয়ে। না ঘুমিয়ে করবোই বা কী! এত উষ্ণ, আরামদায়ক জায়গা আর কোথাও আছে! আমার নড়াচড়াকে প্রথমে মা বুঝতে পারে নি। প্রথমে নাকি বোঝা যায় না অতটা। ছোট্ট প্রজাপতির হালকা করে ডানা ঝাপটানোর মত করে এতটুকু নড়েছি, আর মামনি ভেবেছে মনে হয় গ্যাসের কারণে পেট গুড়গুড় করছে। হাহা! কী বোকা বলতো? ধীরে ধীরে আমি দ্রুত এবং জোরে নড়াচড়া করা শিখছি। একদিন মামনি বুঝে গেলো যে ওটাই আমি। বুঝতে এতো সময় লাগলো! বড়দের নিয়ে আর পারা যায় না! আমার সবরকম ইন্দ্রিয় অনুভূতি তৈরি হয়ে গেছে। স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ, শ্রবণ সব বুঝি সব! বড় হয়ে যাচ্ছি আমি। মামনিও এখন খুব বুঝতে পেরেছে যে আমি আর সেই ছোট্ট ব্যাঙাচিটা নেই। আমার সাথে কথা বলা যেতে পারে, গান শুনতেও খুব ভালোবাসি। গানের ব্যাপারটা অবশ্য বাবাই বেশিরভাগ সময় করে। কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারি ওটা বাবা। মা আর বাবা, এই দুজনের কণ্ঠ আর কথা বলার ভঙ্গি সবার থেকে কী ভীষণ আলাদা!
বড় হচ্ছি, তাই জীবনযাপনের ধারাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন আমি আর ছোটদের মত সারাক্ষণ ঘুমাই না। ঘুমের একটা রুটিন তৈরি হয়েছে। নতুন একটা ব্যাপার শিখেছি, হেঁচকি তোলা। প্রথমদিকে মা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো, এটা আবার কেমনতর বিষয় ভেবে! আমি নিয়মিত বিরতিতে হেঁচকি তুলে তাকে বুঝিয়ে দিই যে এটা অস্বাভাবিক কিছু না। মা দ্রুতই বুঝতে পারে। আমাকে সে না বুঝলে কে বুঝবে?
আমি
এক হাজার টাকা খরচ করে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চলচ্চিত্রটি দেখে আসলাম আজকে আমরা। চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য অবশ্য খুব কম, মিনিট পাঁচেক হবে। খরচটা সেই তুলনায় বেশি মনে হচ্ছে? মোটেও না। আল্টাসোনোগ্রাম মেশিনে যখন তার গুটিসুটি মেরে থাকা অস্পষ্ট হাত-পা দেখলাম আমার মনে তখন অনির্বচনীয় অনুভূতি। তিথির প্রেগনেন্সির শুরু থেকেই আমার ভেতর নানারকম অযৌক্তিক বাজে চিন্তা কাজ করা শুরু করেছিলো। আমার সন্তান ঠিকমতো আছে তো? ডাক্তাররা ডায়গনোসিস করতে কোন ভুল করে নি তো? স্বচক্ষে দেখার পর একটা বিশাল ভার যেন নেমে গেলো শরীর থেকে, সাথে ঝিরঝিরে প্রশান্তির হাওয়া আর গলায় দলা পাঁকিয়ে ওঠা কান্না। একটি শিশুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত জটিলতা এবং ঝুঁকির কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করা অবশ্য এরপরেও থেমে থাকে নি। আমার শুধু সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কথাই মনে আসতো সবসময়। এমনিতে অবশ্য সব ঠিকঠাকই চলছিলো, মাঝখানে একবার চেক-আপের সময় দেখা গেলো তিথির শরীরে হিমোগ্লোবিন কম। হিমোগ্লোবিন কম থাকা মানে প্রসব-পরবর্তী রক্ত সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাওয়া। আয়রন ট্যাবলেট আর সুষম খাদ্যের প্রচেষ্টায় এক মাস পর হিমোগ্লোবিন কিছুটা বাড়লো বটে, তবে তা যথেষ্ট ছিলো না। ডাক্তারের পরামর্শে তাই প্রথমবারের মতো হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো তাকে। আয়রন ইনজেকশন দিয়ে হিমোগ্লোবিন লেভেল বাড়াতে হবে।
আমার মনে হয় ছেলেই হবে। যে কিক পায়ের! এ ফুটবলার না হয়েই যায় না! আর যদি মেয়ে হয়, তবে অবশ্যই সে নৃত্যপটিয়সী হবে। তার কিকের মধ্যে আমি এক ধরণের ছন্দ খুঁজে পাই। হয়তো বা এটা পিতৃমনের অতিকল্পনা। হোক না! এইসব সুখকল্পনাই তো জীবনের স্বাদ! ডান্স বিটের গান ছেড়ে দিলে সে খুব লাফায়। বিশেষ করে ব্রাজিলিয়ান একটা গান আছে এলিট স্কোয়াড সিনেমার "মোরো দি দান্দো" না কী যেন নাম, ওটা ছেড়ে দিলে তো দস্যিটা ঘুমিয়ে থাকলেও উঠে এক পাক নেচে নেবেই! ওর ঘুম, জেগে ওঠা, নেচে নেয়া, খেলা করা, এসব আমার দৈনন্দিন জীবনের সাথে জরিয়ে গেছে। তবে নারী হওয়ার বিশেষ সুবিধার বলে তিথি বুঝতে পারে আরো বেশি কিছু। ওর হেঁচকি তোলা, হাই তোলা এসবও নাকি সে বোঝে! জীবনে এই প্রথমবারের মত আমার মেয়ে হয়ে না জন্মানোর জন্যে দুঃখ হলো।
সেদিন তিথির বাবার বাড়ি থেকে সবাই এসে শুভকামনামন্ডিত মিষ্টান্ন দিয়ে গেলো। সবাই ভালো ভালো খাবার খেলাম। ছবি তুললাম। আশীর্বাদ বা দোয়াতে আমার বিশ্বাস নেই, কিন্তু সেদিন আমার মনে হচ্ছিলো শুভার্থী অগ্রজদের আশীর্বাদ বা দোয়ার চেয়ে বেশি প্রার্থিত আর কিছু নেই। আমাদের চলার পথে আরো বেশ কিছুদূর বাকি। এখন আমি শুভ কোনকিছু থেকেই বঞ্চিত করতে রাজী নই নিজেকে। আজকের দিনটা তো বেশ ভালোই গেলো। সামনের দিনগুলোও যাবে তো? শুনেছি একসময় নাকি সবকিছু অসম্ভব রকমের দীর্ঘ মনে হতে থাকে। তেমন কিছু হবে নাকি?
মিতিন
আমি এখন প্রায় ষোল ইঞ্চি লম্বা। ওজন তিন পাউন্ড। মাতৃগর্ভের আরামদায়ক দিন মনে হয় শেষের পথে। আমারও কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগে। কম তো বড় হই নি। কবে তোমরা আমাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে? এই ছোট্ট জায়গায় আমার শরীর যে আর আঁটে না! মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি। আমার নড়াচড়া এখন বাইরে থেকেও টের পাওয়া যায়। আমি খুব অস্থির হয়ে গেছি ইদানিং। নড়াচড়া বেশি করছি। মামনির ঘুমের ব্যাঘাৎ হচ্ছে এজন্যে, বুঝতে পারছি। এছাড়া আমার চুল আর নখের জন্যেও তার সমস্যা হচ্ছে খেতে, হজমে। আরো দ্রুত ওজন বাড়ছে আমার। নড়াচড়ার জায়গা সীমিত হয়ে আসছে। কী ভীষণ আঁটোসাঁটো অবস্থা! ভালো লাগছে না আর এ জায়গাটা। কবে আমি পৃথিবীর আলো দেখবো? কবে, কবে, কবে? এমনতর মানসিক দূরাবস্থার মধ্যে একটা ভালো ব্যাপার ঘটে গেলো। আমার শরীরের কুঁচকানো চামড়াগুলো সব ঝরে গেলো। এখন নিশ্চয়ই আলটাসনোগ্রামে আমাকে আরো ভালো আর স্পষ্ট আকৃতির দেখাবে? বাবা-মা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে? এই চিন্তাটা মাথায় আসার পর আমার মন ফুরফুরে হয়ে গেলো।
শরীরের ভেতর নতুন কিছুর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। কত্তগুলা নতুন রে! এটাকে নাকি বলে ফ্যাটসেল। আমার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হবে এর মাধ্যমে। জিনিসটা নেহায়েৎ মন্দ না বোধ হয়!
নড়াচড়া এখন আর প্রায় করতেই পারি না। পারবো কী করে? প্রায় আঠার ইঞ্চির মতো লম্বা হয়ে গেছি। এতটুকু পেটে এত বড় একটা বাচ্চা কীভাবে নড়বে? বিরক্ত হয়ে মাঝেমধ্যে কিক দিই, এই আর কী। তবে পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, মানিয়ে নিয়ে নতুন কিছুতে মজে থাকার দক্ষতা আমাদের, মাতৃগর্ভের শিশুদের সহজাত। এখন মামনির পেটে বাবা টোকা দিলে আমিও পাল্টা কিক দিয়ে জানান দেই। এই খেলাটার নাম দিয়েছি টরেটক্কা খেলা। খুব মজা লাগে খেলতে।
আমার ওজন এখন প্রায় সাত পাউন্ড, দৈর্ঘ্য ২০ ইঞ্চি। আর কতোকাল আমাকে এই অন্ধ গহবরে থাকতে হবে? আমার ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, হাত, পা, চোখ সবকিছুই পৃথিবীতে আসতে প্রস্তুত। আর কত দেরী মা? কবে তোমার কোলে উঠবো বাবা?
আমি
গতকাল রাতে বিচ্ছিরি কান্ড ঘটে গেছে। বাবা-মার সাথে সামান্য বিষয় নিয়ে ভীষণ তর্কাতর্কি, তিথি তাদের পক্ষ নেয়াতে তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি। বিয়ে করাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, এ কথাটা পুরুষতান্ত্রিক দম্ভে জানিয়ে তিথিকে তার বাপের বাড়িতে চলে যাবার আহবান জানালাম। বাবা-মা'কেও তুচ্ছ এবং অজানা সব কারণে দায়ী করে গলা ফাটাতে লাগলাম। চরম বেয়াদবিটা করলাম শেষ পর্যায়ে। আমাকে তারা সোফায় বসিয়ে রেখে কী সব ইতং বিতং বোঝাচ্ছিলো, আমি ঝামটা মেরে উঠে এসে ঘরের দরোজা খোলা রেখেই একের পর এক সিগারেট টানা শুরু করলাম ভোঁসভোঁস করে। সিগারেট টানতে টানতে উত্তপ্ত মস্তিষ্কে বিবাহপরবর্তী পরাধীন জীবনে আটকে পড়ে এবং প্রাকবৈবাহিক স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে কী ভুল করেছি তা সশব্দে জানান দিতে থাকলো আমার মন। আগেই বোঝা উচিত ছিলো বৈবাহিক জীবন আমার জন্যে না। আমি সিগারেট, হার্ড ড্রিংকস, হার্ড রক, ডার্ক থটস, ফ্লার্ট গার্লস এসব নিয়ে মজে থেকে ভার্চুয়ালি নিজেকে সেলিব্রেটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবো। কোন বাঁধনে বাধা পড়া কি আমার মানায়? সবার কী আর রুটিনমানা আটপৌরে জীবনে চলে? কোথায় গেলাম সেই আত্মবিধ্বংসী, নিহিলিস্ট, সেল্ফ স্যাডিস্টিক রেকলেস ছেলেটা? ল্যাপটপের সামনে পড়ে থাকা সিডিটা নিয়ে ভেঙে নিজের হাত কেটে রক্ত ঝরিয়ে এক মুঠো ঘুমের ট্যাবলেট মুখে পুরে তবেই আমার ঘুম এলো।পরদিন বাসায় ফিরলাম ইচ্ছে করেই দেরীতে। বাসায় ফেরার পথে এক সিএনজিঅলার সাথে ভাড়ায় বনিবনা না হওয়ায় তাকে যাচ্ছেতাই গালি দিয়ে গাড়িতে বেশ কয়েকটা ঘুষি মেরেছি। এর ফলে অবশ্য বেশ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে, তবে রাগটা ঝাড়া গেছে এতেই খুশি। কালকে থেকে মেজাজটা বড্ড খিঁচড়ে আছে।
বাসায় ফেরার পর তিথি গতকাল রাতের কথা ভুলে গিয়ে আশ্চর্য কোমল ব্যবহার করলো আমার সাথে। ব্যাপারটা কী? ও তো এমন মেয়ে না। বড্ড জেদ তার। ভেবেছিলাম টানা দুই দিন কোন কথাই বলবে না। কিন্তু যে কথা তার পেটে জমে আছে, যে কবিতার পঙক্তিতে তার শরীরে আশ্চর্য আবৃত্তি অনুষ্ঠান, তার ভাগীদার আমাকে না করে সে পারে কীভাবে? ভালোবেসে ডাকলো সে আমায়,
-শোনো...
-হু বলো।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তার গালে লজ্জার রক্তিম দীপ্তি। আমি হঠাৎ করেই যেন বুঝে গেলাম সব। তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে বললাম,
-সত্যি?
-হ্যাঁ সত্যি!
*
আজ মিতিনের জন্মদিনে বায়োস্কোপের রিলের মতো পুরোনো সব ছবি ভাসতে লাগলো আমার চোখের সামনে। এই যে বদলে যাওয়া, এই যে উৎকন্ঠার প্রহর, এই যে টুকরো দুষ্টুমী, এই যে স্বপ্নভরা চোখ, প্রতীক্ষার যন্ত্রণা, মানসিক অবসাদ, অজানা আশঙ্কা, শুভাকাঙ্খীদের ভালোবাসা এসবকে আমি অস্বীকার করি কীভাবে? মিতিন যত বেড়ে উঠেছে আমি ততই ফিরে গেছি উৎসে। উচ্ছাসের উৎসাহে। আমার রাজকন্যাটা, আমার তোতোরো, মেরি পপিন্স তার অদৃশ্য ডানা দিয়ে যতই এগুতে থাকবে সামনে, যতবার তার জন্মদিন ফিরে আসবে, মৃত্যুর দিকে ধীরে এগিয়ে যাওয়া এই আমি বয়সের হিসেব তুচ্ছ করে বুড়ো থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে যুবক হয়ে বারবার ফিরে যাবো সেই উৎসমুখে, মৃত্যুকে অস্বীকার করে নতুন জীবনের আনন্দ আবিষ্কারে।