হিমসকালের রোদনকশা
তার পরনে ছিলো গোল গোল ফুলকাটা ঢিলেঢালা একটা জামা। দৈর্ঘ্য একটু বেশি হওয়ায় প্রায় মেঝে ছুঁয়েছিলো তা। এমন অবস্থায় চলাফেরার সময় সাবধানতা অবলম্বন না করলে দুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক না। অবশ্য ঘটন, দুর্ঘটন কখন জীবনের স্রোতকে কোনদিকে বইয়ে নিয়ে যায় বলা মুশকিল। আপাত দৃষ্টিতে যা দুর্ঘটনা, সেখান থেকেও ফুটতে পারে স্নেহের ফুল, জেগে উঠতে পারে আলোর পাখিরা। সেই মেয়ে আর তার প্রিয়তা চিনেছিলো এসব আলোর ফুল। তারা হয়ে উঠেছিলো দীপ্তিময়। মেয়েটার তো নামই হয়ে গেলো দীপ্তিময়ী! ভালোবাসার ডাকপিওনকে যদি তার আসল নাম বলে চিঠি পৌঁছে দিতে বলা হয়, সে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবে। কিন্তু যদি বলা হয় দীপ্তিময়ীর কাছে যাও, নিমিষেই চিনে নেবে সে। ভালোবাসার মাঝে ডাকপিওনের দাপ্তরিক কাজটা অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রম হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। আর সে খাটতেও পারে খুব।
দীপ্তিময়ী আলুথালু বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে। প্রসবপরবর্তী জটিলতার ফলে চলাফেরায় সাচ্ছন্দ্য আসেনি এখনও। দীপ্তিময়ীর এমন চলন আমার বেশ লাগে দেখতে। ভাবছি সাবধানে হাঁটতে বলবো, কাপড়টা পায়ে জরিয়ে যাচ্ছে তো! কিন্তু এক অলস ঔদাসীন্যে আমার আর কিছুই বলা হয় না। হিমসকালের রোদনকশা দেখতে থাকি। সূর্য তার আগ্নেয় ভান্ডার থেকে দেখেশুনে নরম তুলতুলে এক টুকরো রোদস্ফটিক পাঠিয়েছে যেন আমাদের জন্যে। কি ঝকঝকে রোদ! চোখ ধাঁধায় না, আবার ঔজ্জল্যও কমে না। গুটি গুটি পায়ে দুষ্টু কাঠবেড়ালির মতো করে জানলা, পর্দা আর গ্রিল ভেদ করে আমাদের কাছে আসতে গিয়ে তারা নকশা হয়ে যায়। এই যে আমার পাশে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট একটা স্বর্গের পরী, তার গাল, চিবুক ধরে কতই না নকশা করছে রৌদ্রদল! এসব দেখতে দেখতে আমার সময় কেটে যায়। হিমহিম ছুটির দিনে সূর্যের স্নেহে প্লাবিত হয়ে জীবন্ত জাগতিক হৃদুপকরণ দেখার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
-ঘরটা ভালো করে ঝাঁট দেয়া হয় না অনেকদিন। কী অবস্থা!
দীপ্তিময়ী আমাকে অনুযোগ করে।
-তোমার আর এই অবস্থায় ঝাঁট দিতে হবে না। পুরোপুরি ফিট হয়ে নাও তারপর।
-তার আর পর আসতে বয়েই গেছে! উঠো, আমি এখন ঘর ঝাড়ু দেবো। উঠো!
সে 'ওঠো' না বলে 'উঠো' বলে সবসময়। এই মৃদু আঞ্চলিক টানটা বেশ লাগে আমার।
আমি উঠতে যাবো, দীপ্তিময়ী এগিয়ে এসে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করবে, ঠিক তখনই...
তখনই হয়তো চুলোয় বসিয়ে দেয়া মাছটা ভেজে পুড়ে গেছে। তখনই হয়তোবা আবর্জনা নেয়ার লোকটা আমাদের ঘর অভিমুখে আসছে, হয়তোবা মেঘেদের খবরদারিতে রোদ ঢেকে যাচ্ছে, আমাদের ঝুলবারান্দায় বাসা বাঁধা চড়ুই দম্পতি ঝগড়া করছে, আমি জানি না এসব হয়েছিলো কী না। নৈরাশ্যের জমাট অন্ধকারে জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছি দৃষ্টিপ্রদীপ। তাই দীপ্তিময়ীর পা হড়কে পড়াটা, যেটা আমি আগেই আশঙ্কা করেছিলাম, একটা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে আমাকে ইতিউতি করতে হয় নি। আমি তাকে ধরে ফেলি দু হাত দিয়ে।
এই যে স্পর্শ, এই যে স্পর্শসঞ্চালিকা, আর আমার রোদবালিকা, নতুন কিছু তো নয়। আমরা বরাবরই বিশ্বাস করে এসেছি আমাদের জোড় বাঁধাটা নিয়তিবদ্ধই ছিলো। যদিও আমরা সবরকম অদৃষ্টবাদীতা এবং কুসংস্কারকে হেলাভরে কাটিয়ে এসেছি, কিন্তু এই একটা ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস গোঁড়া ঈশ্বরভক্তকেও হার মানাবে।
স্পর্শ! স্পর্শ! স্পর্শ!
কতভাবেই না উচ্চারণ করা যায় শব্দটি। কতভাবেই না এর প্রয়োগ ঘটানো যায়! দীপ্তিময়ীকে প্রথমবার স্পর্শ করার সুখস্মৃতি আনাড়ী হাতে, এরপর হাতগুলো তার পাওনা বুঝে নিয়ে লোভী জমিদারের মত খাজনার খোঁজে চলে যেত তার শরীরের সমস্ত অঞ্চলে, কতবার, কত সহস্রবার স্পর্শ করেছি তাকে। একসময় রোমাঞ্চ থিতিয়ে আসে কিছুটা, দৈনন্দিন ক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে যায় তা। তারপরেও কিছু কিছু স্পর্শ উজ্জীবনী সুধার কাজ করে, ফিরিয়ে আনে সেই পুরোনো বিদ্যুচ্চমক, নির্ভরতার অব্যক্ত পঙক্তিমালা...
আমি ধরে ফেললাম তাকে। এই ধরে ফেলাটা স্বাভাবিক প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মতই সিলগালা হয়ে চলে যেতো আটপৌরে দপ্তরে, কিন্তু তা আর হলো কই! আমি তাকে ধরলাম, সে আমার দিকে তাকালো, এমন কিছু না, বলতে গেলে কিছুই না! তারপরেও তার কৃতজ্ঞ এবং ভীত দুটি চোখ এর পক্ষ থেকে কে যেন আমাকে বলে দিলো, আমি শুনলাম দৈববাণী, "যাকে তুমি ধরে আছো, তার হাত একবার ছেড়ে দিলেই সে তলিয়ে যাবে অতল গহবরে। সেখানে অশ্রূর নদী বয়ে যায়। তুফান ওঠে খুব। চোখের জলের নোনতা স্বাদ অবহেলা আর প্রত্যাখ্যানের তিক্ততার সাথে মিশে তৈরি করে নতুন এক অপ-অনুভূতি।"
আমি ভাবি, দুর ছাই, কী সব বলছে কোন পন্ডিতে! হাত একটু ছেড়ে দিলেই যদি সে বেনোজলে ভেসে চলে যায়, প্রতিকূল স্রোতে সাঁতরাবার শক্তি যদি তার নাই বা থাকে, তাহলে ভাটার টান এলে, শরীরে বয়সের উগ্র নখর পড়লে সে কী আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আমার প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাই তৎক্ষনাত।
দৈবকন্ঠে অশরীরী বলে, "হাত ছেড়ে দেয়া খুব সহজ। ইদানিং তো মহামারীর মতো আক্রমণ করছে এই রোগটা। অনেকগুলো যদি এবং কিন্তুর কিম্ভুত সমীকরণ মিলাতে না পেরে হাপুশ নয়নে কাঁদছে দেখো বোকা ছেলে-মেয়ের দল। এখন চারপাশে অনেক হাত। সবাই খুঁজছে কাউকে না কাউকে। কাকে, কেন সেসব ভালো জানে না। তাই চকিতে হাত ছেড়ে দিলে সেটা অন্য কেউ কুক্ষিগত করার চেষ্টা করবে, এ আশঙ্কা অমূলক না। হাতের বড়ই অভাব আজকাল। হাতের জন্যে হাহাকার"।
ঐ যে বললাম না! কিছু কিছু স্পর্শ থাকে এমন নতুন অনুভূতির উদ্ভাবক, কিছু কিছু দৃষ্টিতে থাকে একলা হুতুমের চোখের বিষাদ। আর তাই তো ফুলকাটা ঢিলেঢোলা জামা পরিহিতা দীপ্তিময়ী গৃহস্থ কার্যে ব্যস্ত হতে নিয়ে আমার কাছে তার পতন সমর্পণ করলে স্পর্শেরা পন করে বসে, ছাড়ছি না, ছাড়ছি না এত সহজে! আমি ছাড়ি না তাকে। বুকে টেনে নিই। আমাদের মাঝে কোন কথা হয় না। নিবিড় স্পর্শে যে যার মত অনুভব করতে ব্যস্ত তখন। এ সময় উন্মত্ততার না, এ সময় চোখ বুঁজে গভীর আবেশ নেয়ার। অনুভব করার। বোধের উন্মেষের। এসময় আমি ভাবি নির্ভরতা খুঁজে ফেরা হরিণচোখে শ্বাপদ যেন কখনও দৃষ্টিসীমায় না আসতে পারে সে দায়িত্ব আমারই। এসময় আমি ভাবি হাজারো প্রলুদ্ধ চোখ আর হাহাকার হাতের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মাঝে একটা সময়, তার মাতৃত্বকালীন শারিরীক জটিলতাগুলো যখন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছিলো, আমাদের পরীটাকে আলোর ভূবনে আনার পর যখন সে 'ব্লু-বেবি' নামক মানসিক রোগের শিকার হয়ে বিক্ষিপ্ত থাকতো, তখন আমি ব্যস্ত ছিলাম অন্য কাজে। তাকে যতটা সময় দেবার কথা, তা দিতে পারি নি। তার অনুযোগে তেমন গা করি নি। ঠিকই স্পর্শ করেছি, চুম্বন করেছি, তা যে দৈনন্দিন অভ্যাসের পথ পরিক্রমায় হারিয়ে যেতো, ছুটে পালাতো সুযোগ পেলেই, তা কি অনুভব করতে পেরেছি?
পারি নি।
আর তাই ফুলতোলা কাপড়ে নড়োবড়ো দীপ্তিময়ী সাচ্ছন্দ্যে হাঁটার ব্যর্থ চেষ্টা করলে তাকে স্পর্শ করে আমার স্মৃতির সংরক্ষণাগারে সঞ্চিত হতে থাকে রত্ন। নিপুন শিল্পীরা অমোচনীয় কালি দিয়ে এঁকে দেয় চিরস্থায়ী স্কেচ আর পোট্রেট। দীপ্তিময়ী হারাবে না কখনও।
এর বেশ কিছুদিন পরে, তা বছরখানেক তো হবেই, কোন একটা ভরা জলসায় কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছিলো
"স্ত্রীর সাথে আপনার বিশেষ একটি স্মৃতি শেয়ার করুন"।
আমি তাকে উত্তরে আমাদের সাগরপাড়ের মধুচন্দ্রিমার দিনগুলোর কথা জানালাম, সেখানে একদিন সাগরে সূর্যাস্ত দেখে কেমন বিমোহিত হয়েছিলাম তার বিশদ বিবরণ দিলাম। অথচ আমি জানি, এর চেয়েও বিশেষ স্মৃতি আমার আছে। সেই হিমসকালের রোদনকশা, যেদিন ফুলতোলা ঢিলে জামা পরে পা হড়কে পড়ে গিয়েছিলো দীপ্তিময়ী। সেদিনের সকালটা ছিলো অনেক সুন্দর। আমার অত বিশদ মনে নেই অবশ্য। শুধু মনে আছে সেই স্পর্শজনিত অনুভব, আর উপলদ্ধি। মনের এই মুকুর সব ঋতুতেই স্মৃতিবৃক্ষকে ভরাট করে রাখে। তার বিহবলতা, তার ভীতি, তার আকাঙ্খা, তার প্রীতি, তার অধিকারগরিমা, তার উৎকন্ঠা সবই এক পলকে দেখা হয়ে গিয়েছিলো। সাথে এটাও মনে পড়ে, অনেকদিন এমন স্ফূরণস্পর্শ আমি পাই নি। কোনো তাড়াহুড়ো নেই আমার। ওসব তো আর নিত্যদিন আসে না! হয়তো বা আজও আসতে পারে, কিংবা দশ বছর পর। আজই কেন নয়? আমি তার হাত ধরে বলি,
-যাবে না? অনেক রাত হয়ে গেছে কিন্তু!
দীপ্তিময়ী হাসে। তার হাসির দ্যুতিতে আলোকিত হয় চারিধার। বেহায়া রঙচঙে ঝিকিমিকি আলোগুলোর মত না। স্নিগ্ধ, পেলব, আর একান্তই আমার।
আরো একটা স্পর্শে উবে যায় ক্লান্তি, গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা শরীরে পাই আর্দ্র স্পর্শ। এঁটোকাটার এটিকেট ভঙ্গ করে দুর্বিনীত ভাবে ছুটে চলে অদৃশ্য চুম্বন। তারা থামবে কোথায় কে জানে! বহুল প্রতীক্ষিত স্পর্শস্ফুরণ ঘটে গেছে। আমি সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি। সেদিন ছিলো হিমসকালের রোদনকশা, আজকে হয়তো হবে জোনাকরাতের তারানামচা। স্পর্শের নতুন নতুন রূপ দেখে আমার ভয়ও করে কিছুটা।
এত তীব্র বাঁধনে যে বেঁধেছে তার হাতটা ছেড়ে দিলেই হাহাকার হাতগুলো আমাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করবে। মনে আছে আমার সেই দৈব সতর্কবাণী।
-এই যে, আপনাকে আরেকটু শরবত দেবো?
অনুষ্ঠানের শুরুতে এই মেয়েটার সাথে কিছু প্রগলভ সময় কেটেছিলো আমার। তার হাতে শরবত, মুখে হাসি। আমি তার হাতে হাহাকার দেখতে পাই।
-চলো, উঠি এবার।
দীপ্তিময়ীর হাত ধরে প্রগলভা তরুণীর ছিনালি উপেক্ষা করে দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে যাই বাহির দরজার দিকে।
ওখানটায় খুব ভালো সাজিয়েছে আজ ফুল আর আলো দিয়ে।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন