বড়'পা সম্পর্কে ভাবতে গেলে প্রথমেই যে দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা এরকম, ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখের এক কিশোরীকে বেণী ধরে টেনে তুলছে আমার রাগান্বিতা মা। তার একটু পরে মেজাজ মর্জি খারাপ করে সেই কিশোরী ঘুম থেকে ওঠে। পাঠ্যপুস্তক পড়ার ভান করতে থাকা এক বালকের পিঠে দুমদাম করে দুটো কিল বসিয়ে দেয়।
বালকটা আমি সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে আজ এতকাল পরে স্মৃতির দুমড়ানো মলিন দেরাজ ঘাটতে গিয়ে আমি এই ছবিটিই কেন খুঁজে পেলাম কে জানে। যদিও সে মুহুর্তগুলোর পারস্পরিক কিল ঘুষি বিনিময়ে আক্রোশ বা ঘৃনার কোন লেনদেন ছিলোনা, কিন্তু দৃশ্যটি খুব স্পষ্ট আর পীড়াদায়ক হয়ে উঠতে থাকে। মনে হয় যেন পুনঃঅভিনীত হতে যাচ্ছে সেটা।
"এ্যাই ছেমড়ি ওঠ ঘুম থেকে। তোর কোন কাজ কাম নাই?"
ঢুলুঢুলু চোখের সেই কিশোরী এক ঝটকায় মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে আমার দিকে এগুতে থাকে। দৃশ্যটি ঠিক এরকম হবার কথা ছিলোনা। রান্নাঘর থেকে একটা খুন্তি নিয়ে এসে আমাকে খোঁচানোর চেষ্টা করে অযথাই। আমি আতঙ্কিত হয়ে সরে যাই তার রুদ্রমূর্তি দেখে।
শশব্যস্ত হয়ে দেরাজটা বন্ধ করে দিই। এলোমেলো হয়ে আছে সব। সাজাতে হবে। ঘুণে ধরেছে পুরোনো আসবাবটায়। মেরামত করতে হবে।
বড়'পা সবসময়ই একটু উদ্ধত, বেপরোয়া, মারমুখী আর রাগী ছিলো। কিন্তু আমার প্রতি স্নেহের কমতি ছিলোনা তার কখনও। অবশ্য প্রকাশভঙ্গিটা প্রায়শঃই হত কিল ,ঘুষি বা চুলটানার মাধ্যমে। কিন্তু আমি এতে বেশ আমোদই পেতাম। কারণ বেশিরভাগ সময়ই এর পরে সে আমাকে চকলেট বা রঙপেন্সিল অথবা ভাগ্য খুব ভালো থাকলে কখনও কপালে একটা চুমু দিতো। তবে এসব সুন্দর দৃশ্য মনে করতে পারিনা এখন ঠিকমত। বড়'পা সম্পর্কে ভাবলেই মনে আসে প্রথমে উল্লেখ করা দৃশ্যটি। কত কি যে হারিয়ে ফেলেছি! এখন এটা যে মনে আছে তা'ই সই। কিন্তু আজে স্মৃতির ড্রয়ারটা ঘাঁটতে গিয়ে এরকম বিপত্তি ঘটল কেন বুঝতে পারছিনা। মস্তিস্কে পঁচন ধরেছে নাকি আমার! নাকি আমি স্মৃতিভ্রংশতায় আক্রান্ত এক ধ্বংস রোমন্থনকারী? এইসব বিষণ্ণ এবং অস্থির ভাবালুতায় নিমজ্জিত ছিলাম বলে শুনতে পাইনি কতক্ষণ ধরে কলিংবেলটা বাজছে। কার যেন আসার কথা ছিলো? কাউকে কি আসতে বলেছিলাম আমি? দরজা খুলে দেবার পরে চিনতে পাই তাকে। চিনতে কি পাই? ঠিক তা নয়। তবে খুব চেনা চেনা লাগে। কাঁধে একটা ঝোলা, হাসিমুখের এক প্রাণোচ্ছল তরুণ। তার সাথে কুশল বিনিময়ের পর সে আমাকে ঝোলা থেকে তার সরঞ্জামাদি বের করে দেখালো।
"এই যে ক্যামেরাটা দেখছেন, এটা অত্যাধুনিক এবং বিশেষ। ছবির মান নিয়ে সংশয় প্রকাশের কোন অবকাশই নেই। একদম ঝকঝকে আসবে। চলমান দৃশ্যও ধারণ করার ব্যবস্থা আছে..." সে গুণকীর্তন করতে থাকে।
"কিন্তু আমি যে ছবিটা তুলতে চাইছি ওটা যে অনেক আগেকার। অনেক দূরে যেতে হবে। আপনি কি এত ঝক্কি পোহাতে রাজী আছেন?"
"রাজী না থাকলে আসব কেন? আর তাছাড়া আমিতো জানিই সব"
আমি তার স্বতস্ফুর্ততায় সহায় পাই।
"তাহলে চলুন, রওনা দেয়া যাক। আমি গুছিয়ে নিই। চকলেট খাবেন? অথবা রঙপেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকুন ততক্ষণ?"
কথাটা বলেই আমি বিব্রত হই। কারণ, আমার কাছে সেসব কিছুই ছিলোনা। সে মনে হয় বুঝতে পারে। মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে আমাকে অস্বস্তি থেকে রক্ষা করে।
তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমি দৃশ্যগুলোর কথা মনে করার চেষ্টা করি পুনরায়। আমার শৈশব, কৈশোর, খেলার মাঠ, নদীর তীর, প্রথম প্রেম সব ছাপিয়ে আজ কেন যেন বড়'পার কথাই মনে পড়ছে শুধু। চলতে চলতে আমার তরুণ চঞ্চল সঙ্গীটি ক্যামেরাবন্দী করতে থাকে বিভিন্ন দৃশ্য। কিন্তু তাকে মোটেও সন্তুষ্ট মনে হয়না ছবির মান দেখে।
"কি ব্যাপার, কোন সমস্যা? কাজ করছেনা ঠিকমত?"
আমার প্রশ্নে সে একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। এর আগে বস্তুটির এত প্রশংসা করেছিলো ভেবে লজ্জিত হয়।
"সমস্যা করছে কেন বুঝতে পারছিনা। সবকিছুতো ঠিকই আছে, কিন্তু ছবি ভালো উঠছেনা"।
"দেখি কেমন উঠেছে, কি তুলেছেন?"
"না-না দেখতে হবেনা" সে প্রবল আপত্তি জানায়।
"আসলে সঠিক জায়গায় পৌঁছুলে সেখানকার আলো এবং পারিপার্শ্বিকতার বদৌলতে ঠিকই সুন্দর ছবি উঠবে। চিন্তার কিছু নেই। চলুন চলুন!"
তার এরকম পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা আমার মধ্যে সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। কিন্তু উপায় কি? আমার ঘুণে ধরা পুরোনো দেরাজটা মেরামত না করা পর্যন্ত এর ওপরেই ভরসা করতে হবে।
দেখতে দেখতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই। পুরোনো সেই বাড়িটা! আমাদের সাদা বাড়ি! সবকিছুই ঠিকঠাক আছে একদম আগের মতই। ঐতো বড়'পা ঘুমুচ্ছে। একটু পরই মা'র গজগজ করতে করতে চলে আসার কথা। আমি সাগ্রহে অপেক্ষারত থাকি। হ্যাঁ, ওইতো মা! চুলের মুঠি ধরে বড়'পাকে টেনে তুলছে। আমি আমার সঙ্গীকে ইঙ্গিত দিই দ্রুত এটি ফ্রেমবন্দি করার জন্যে। অবশ্য এর কোন প্রয়োজন ছিলোনা। সে আগেই চলমান চিত্র ধারণ করা শুরু করেছে। আমি তাকালাম চিত্রধারণ প্রক্রিয়ার দিকে। না, এবার কোন ভুল হচ্ছেনা। সুন্দর ঝকঝকে ছবি উঠছে। আরো কিছু দৃশ্য ধারণ করার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু কিছু উটকো লোক এসে ঝামেলা শুরু করল। তারা দাপ্তরিক পোষাক পড়ে পৈশাচিক গাম্ভীর্য মুখে নিয়ে হাজির হয়। ফিতা দিয়ে মাপজোখ শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের নিয়োগকৃত শ্রমিকের দল চলে এসে শাবল, গাঁইতি দিয়ে ঘর ভাঙতে শুরু করে। ছুড়ে ফেলে দেয় আমার ছোট্ট সাইকেলটা, বড়'পার প্রিয় ট্রানজিস্টর, মা'র বাহারি পানদানী। আমাদের প্রিয় সবকছুই। বজ্জাত ক্যামেরাম্যানটা গভীর আগ্রহে এসবও ধারণ করে চলেছে।
"থামুন! এসবের কোন দরকার নেই। চলুন যাই এখান থেকে। প্রথমাংশটুকুই যথেষ্ঠ। আমি ওটাই চেয়েছিলাম। আপনাকে আর আলগা মাতব্বরি করতে হবেনা|
"নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! চলুন যাওয়া যাক। কাজতো হয়েই গেছে। দেখবেন কি চমৎকার তুলেছি ছবি এবং চলমান দৃশ্য! গালভরা হাসি নিয়ে সে বলে। আমি খুশী হয়ে তাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাই। তার কোন আপত্তি না থাকায় বেছেবুছে ভালো একটা রেস্তোরা খুঁজে নিয়ে বসি। অর্ডার নেয়ার জন্যে ওয়েটার আসলে আমার মনে হয় শুধুই চা খাওয়ানোটা কৃপণতা হয়ে যাবে।
"কি কি আছে?" সুধোই তাকে।
"যা যা চান। অথবা যা কিছু চান না সবই!"
"যা যা চাইনা তা চাইতে যাবো কেন? আশ্চর্য!"
বিরক্তি প্রকাশ করি আমি। তবে যেহেতু তার কথামত যা চাই সবই পাওয়া সম্ভব, তাই মনে মনে একটি লোভনীয় তালিকা প্রস্তুত করতে থাকি। বড়'পা কুঁচোমাছ দিয়ে চমৎকার একধরনের ভর্তা তৈরী করত, আর নারিকেলের নাড়ু। এখনও জিভে লেগে আছে সেই স্বাদ। আমি ওগুলো প্রস্তুত করার ফরমায়েশ দিই। সে টুকে নিয়ে চলে যায়।
"দেখান দেখি কিরকম উঠেছে ছবি, ভিডিও।" আমি আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যানকে জিজ্ঞাসা করি।
সে সোৎসাহে তার যন্ত্রের কলকব্জা নাড়াচাড়া করে সবকিছু ঠিকঠাক করে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
বড়'পা! আজকে তোমাকে খুব মনে পড়ছে। কতদিন তোমার চুলটানা খাইনা! আজে সকালে তোমাকে মনে করতে গেলে তুমি ওরকম তেড়ে এলে কেন খুন্তি নিয়ে? অভিমানী আমি মনেমনে অনুযোগ জানাই। যাক, এখনতো দেখতে পাবো আমার সেই প্রিয় দৃশ্যটি! আমি ক্যামেরার দিকে মনোসংযোগ করি। চলছে দৃশ্য। দ্রুতগতিতে সময়ের চাকা লাগিয়ে ছুটছে। আমাদের ঘর ভাঙার দৃশ্য। সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশ আর শ্রমিকদের নিরলস পরিশ্রমে দ্রুত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় আমাদের ঘর। তাতে চাপা পড়ে চিৎকার করতে থাকে বড়'পা, মা, বাবা, ছোট্ট আমি...
এসব দৃশ্যতো আমি দেখতে চাইনি! ব্যাটা ফাজিলকে বললাম কি আর সে করলোটা কি!
"এসব দেখাতে বলেছি নাকি? যেটা দেখতে চেয়েছি সেটা কই?" ধমকে উঠি আমি।
সে হন্তদন্ত হয়ে ক্যামেরাটি হাতে নেয়। তারপর পাংশুটে মুখ করে বলে,
"স্যরি, মুছে গেছে সব! দ্বিতীয় দৃশ্যটি বেশি সময় নিয়ে ধারণ করার কারণে প্রথমটি মুছে গেছে। তবে ব্যাপারনা...আবার যাবো দরকার হলে...আসলে হয়েছে কি..."
সে গড়গড় করে নানারকম অজুহাত পেশ করতে থাকে। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যায়।
"প্রথমে দেখে আপনাকে খুব স্মার্ট আর বুদ্ধিমান মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন দেখছি আপনি একটা অপদার্থ উজবুক! কে আপনাকে আসতে বলেছিলো? নিজের থেকে সেঁধে এসে..."
"আপনি আসতে বলেছিলেন" এতক্ষণকার দ্বিধা এবং কাঁচুমাচু ভাব ঝেড়ে ফেলে সে প্রত্যয়ী কন্ঠে বলে।
"আমি বলেছিলাম?"
"হ্যাঁ, আপনিই।"
তার এহেন স্পষ্ট উচ্চারণ আমাকে বিভ্রান্ত করে। আমি কি বলব বুঝে উঠতে না পেরে চুপ মেরে যাই।
"টোকেন নাম্বার ১৯৮৬, কাম হিয়ার প্লিজ। ইয়োর ফুড ইজ বিয়িং সার্ভড নাও"
আমি ১৯৮৬ সাল, দুঃখিত ১৯৮৬ নং টোকেন নিয়ে খাবার আনতে যাই।
কতদিন পরে সেই পুরোনো স্বাদ পাবো! রেস্তোরাটা ভালো। বড়'পার তৈরী সেই খাবারগুলো! আহ!
কিন্তু খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এসব কি দিয়েছে! আমি রেস্তোরার ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করতে যাই,
"এসব কি দিয়েছেন? চা চেয়েছিলাম দিয়েছেন বিষের পেয়ালা। মেরে ফেলতে চান নাকি? আরো যেসব চেয়েছিলাম কিছুইতো দেননি। পেয়েছেনটা কি আপনারা?"
"ওহহো! দুঃখিত। আপনাকে "১৯৮৬" এর বদলে "২০১০" পরিবেশন করা হয়ছে। আপনি যেসব চেয়েছিলেন তা আমাদের স্টকে নেই আর"
"ঠিক আছে, মানলাম। এমন ভুল হতে পারে। তাই বলে চায়ের বদলে বিষ? এটা কি ধরনের রসিকতা?"
ততক্ষণে ম্যানেজারের সাহায্যার্থে ওয়েটার ছোকড়াটি চলে এসেছে। সে মালিকের পক্ষালম্বন করে বলে ওঠে,
"মাথা গরম করবেননা। আপনাদের কেউ কি কখনও বিষ খায়নি? তো এরকম করছেন কেন? ২০১০ এর মেন্যু এরকমই"
নাহ, এদের সাথে তর্ক করে কুলিয়ে ওঠা যাবেনা। বড় একরোখা আর গোঁয়ার এরা। খামোখা কে বিষ খতে যাবে? বড়'পা থাকলে এদেরকে খুব একচোট দেখে নিত। সে ছিলো প্রতিবাদী আর আত্মবিশ্বাসী, আমি বড়'পার কথা আবার মনে করার চেষ্টা করি। কিন্তু এবার কিসব আজগুবী আর ভয়ংকর দৃশ্য ভেসে ওঠে! বড়'পার মুখ থেকে ফেনা বেড়ুচ্ছে। তার সুশ্রী মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে উঠছে...। নাহ, আমার মাথায় আসলেই পচন ধরেছে। কি সব দেখছি!
দৃশ্যগুলো আজকের মধ্যেই সংগ্রহ করে সাজিয়ে রাখতে চাই আমার স্মৃতির দেরাজে। তাই আম ঝগড়াটে ওয়েটার আর দাম্ভিক ম্যানেজারের সাথে অহেতুক তর্ক না করে আমার বোকাটে ক্যামেরাম্যান সঙ্গীকে নিয়ে রেস্তোরা ছেড়ে চলে আসি।
"এবার দৃশ্যগুলো ঠিকমত ধারণ করতে না পারলে আপনাকে দেখে নেব!"
তাকে হুমকি দিই আমি।
"এবার ঠিকমতই হবে" বলে সে, কিন্তু গলায় আগের মত সেই দৃপ্ত ভাবটা নেই।
অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশ। আজকে রাতে চাঁদের আলো নেই। বৈদ্যুতিক বাতিগুলোও কোন এক কারিগরী ত্রুটির কারণে নিভে গেছে। অন্ধকারে পুরোনো সে পটভূমি খুঁজে পাওয়া মুশকিল অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে। গাঢ়তর হয়।
"এ রাস্তাটা নিরাপদ না, আজকে নাহয় থাক। কাল সকালে আসি আবার?" ক্যামেরাম্যান তার শঙ্কার কথা জানায়।
"কেন থাকবে? সারাদিন আমাকে হেনস্থা করে এখন কেটে পড়ার তাল করছেন? সে হবেনা।" আমি সাফ জানিয়ে দিই।
"অন্ধকারে পথ ভুলে কোথায় না কোথায় চলে যাই..."
" না যেতেই হবে। চলুন"
আমি মুখে বললেও বুঝতে পারি যে তার আশঙ্কা একদম অমূলক নয়। কোথায় যে যাচ্ছি! খানাখন্দ আর গর্তে ভরা পথ। হোঁচট খাচ্ছি কিছুক্ষণ পরপর। হঠাৎ কিছু একটা পতনের শব্দ। উজবুক ক্যামেরাম্যানটা পড়ে গিয়েছে। বেশ জখমও হয়েছে বোধ হয়। তারস্বরে চেচাচ্ছে।
"চেচিয়ে লাভ নেই, যেতে হবে।"
"আমি পারবোনা। দেখছেন না কাঁচের টুকরোর সাথে লেগে পা কেটে দু ভাগ হয়ে গেছে?"
"ওকে! আপনাকে যেতে হবেনা, আমিই যাচ্ছি। ক্যামেরাটা দিন, তাতেই হবে"
"আমাকে এভাবে ডেকে এনে ফেলে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?"
সে করুণ স্বরে আকুতি জানায়।
"আমি ডেকেছিলাম?"
"হ্যাঁ"
"না তো!"
"মনে করে দেখুন"
আমার কিছুই মনে পড়েনা। দৃশ্যগুলো মুছে গেছে, যাচ্ছে। ক্যামেরাম্যানটাও অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে যাকগে। ও ব্যাটা কোন কাজের নয়। আমার আজকে শুধু মনে পড়ছে বড়'পার কথা। সেই দৃশ্যটার কথা। আবার যেতে হবে আমাদের পুরোনো সে বাসস্থানে। আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। অন্ধকারে বোঝা যায়না এটাই কি আমাদের সেই বাড়ি? আমাদের সেই সাদা বাড়ি? আমি দ্বিধাণ্বিতভাবে প্রবেশ করি।
হ্যাঁ! আমি ঠিকঠাক চলে এসেছি। খুশীতে ভরে ওঠে মন। ওই যে শুয়ে আছে বড়'পা। এখনই মা রুদ্রমূর্তিতে প্রবেশ করবে এবং সে চোখ কচলাতে কচলাতে জেগে উঠবে। আমি সানন্দে চুলটানা এবং কিল খাবার অপেক্ষা করতে থাকি।
বড়'পা তো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে! আগের সেই বেনী দুলানো কিশোরীটি নেই। তবে তার ঘুমোনোর ভঙ্গিটা এখনও একইরকম আছে। মা আসেন দৃশ্যপটে যথারীতি। মার'ও বয়স হয়েছে অনেক। তার সেই তেজও নেই।
"এই ওঠ, আর কত ঘুমুবি?" বড়'পা নড়ে ওঠে একটু।
"ওঠ না, কত কাজ বাকি!" মা আদরের সুরে বলেন
বড়'পা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আছে। ঘোলাচোখে তাকায়, কিছু যেন বলতে চায়, কিন্তু পারেনা।
তার ঠোঁট বেয়ে কষ গড়িয়ে পড়ে। ফেনা ভাঙতে থাকে মুখে।
আমার মনে পড়ে রেস্তোরার সেই ওয়েটারের কথা। ভুল টোকেন নং ২০১০। বিষের পাত্র। "আপনাদের কেউ কি কখনও বিষ খায়নি?" এ জিজ্ঞাসা।
আমার সব মনে পড়তে থাকে এখন। স্নেহশীলা কিন্তু মারকুটে বড়'পার যাবতীয় স্মৃতি। আমাকে রোজ রাতে ঘুমোনোর সময় সুকুমার রায় পড়ে শোনাতো বড়'পা।
স্কুলে যাবার সময়কার তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছোতে গুছোতে মায়ের বকুনির মুখে কোনমতে দু গ্রাস খাবার গলাধঃকরণ করে আমাকে আদর করে চলে যেত। চঞ্চল বড়'পা।
রাস্তায় মস্তান ছেলেদের দঙ্গল টিপ্পনি কাটলে পাল্টা প্রতিবাদ করতে যেত একমাত্র আমার বড়'পাই।
বাসায় যেবার রাতের বেলা চোর ঢুকেছিলো সেবার দাবড়ে বের করে দিয়েছিলো আমার সাহসী বড়'পা।
আমার সব মনে পড়তে থাকে। দৃশ্যগুলো মনের ক্যামেরাতে সংরক্ষিত হয়ে যায় বলে আমি যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত বেহাল দশার ক্যামেরাটা ফেলে দিই।
আমার মনে পড়তে থাকে...একদিন বিকেলে সে, আমার ইস্পাতদৃঢ় স্নায়ু এবং মনোবলসম্পন্ন বড়'পা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিলো। কেন আমরা কেউ জানিনি কখনও।
"এই উঠিসনা কেন! কি হয়েছে তোর? কি খেয়েছিস? কথা বলিসনা কেন?" মা'র কন্ঠে আকুলতা এবং ভীতি।
সেদিন স্বভাববিরুদ্ধভাবে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো সে। রাতে খায়নি, কারো সাথে কথা বলেনি।
সেই রাত! পরের দৃশ্যগুলো আমাকে আর ভাবতে হচ্ছেনা, চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। নিথর পড়ে থাকা বড়'পা। চারিদিকে কান্নার রোল। হাসপাতাল। ডাক্তার। স্টোমাক ওয়াশ।
একসময় আমিও দৃশ্যের একজন হয়ে যাই। হাসপাতালের পয়জন ওয়ার্ডে শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি।
"ও কি বাঁচবে ডক্টর?"
আমার প্রশ্নের কোন জবাব পাইনা। আমি দৃশ্যপট থেকে বেড়ুতে চাই প্রাণপনে। কিছুতেই পারিনা। স্মৃতি যেন এক বিরাট মাকড়শা, তার বোনা জালে আমি বন্দী অসহায় এক পতঙ্গ। আমাকে বাগে পেয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে থাকে সে জালে। আমি জাল ছিড়ে বের হবার চেষ্টা করি। আমার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, আমি পারিনা...পারিনা...অবশেষে সক্ষম হই। ছুটে বেরিয়ে আসি।
*************************************************************
আমার ঘূনে ধরা স্মৃতির দেরাজটা মেরামত করতে এসেছে মিস্ত্রীরা। কিন্তু বড্ড বেশি দাম হেঁকে বসেছে। বনিবনা হচ্ছেনা কিছুতেই। তাই আমি তাদেরকে বিদায় করে দেই। দেরাজটা বন্ধ করার মুহুর্তে এলোমেলো স্মৃতিগুলোর সাথে চোখাচোখি হয়। আমি সভয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই। কিন্ত বড়'পাকে এড়াতে পারিনা। আমার কৃপণতা দেখে সে স্বভাবসুলভ মারমুখী ভঙ্গিমায় চুল টেনে ধরে। কিন্তু উধাও হয়ে যায় নিমিষেই। আমার বড়'পা, যে ছিলো খুব মারকুটে, প্রতিবাদী, চঞ্চল, উচ্ছল আর তেজদীপ্ত, তার চলে যাওয়ার ভঙ্গিটা খুব অভিমানী আর ক্লান্ত লাগে...
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:৩২