শহরের ব্যস্ততা থেকে একটুখানি দূরে। গাড়ির হর্ণ এখানে মৃদু। হাজার হাজার ব্যস্ত চোখের আড়ালে। একটি বটগাছের নিচে বসে আছে শুভ্রা আর অম্লান। আবেগময় একটি সম্পর্কের তিন বছর পেরিয়ে গেছে। এই বটগাছটি ওদের অনেক আপন। দুজনের ভালোবাসা, আবেগ , কাঁন্নার সাক্ষী এই গাছটি। শুভ্রা কতবার যে কেঁদেছে এই গাছের নিচে বসে তা অম্লান কিংবা শুভ্রা কেউই হিসেব রাখেনি। কিন্তু এই বটগাছটি সব দেখেছে, সব জানে। যদি কথা বলতে কিংবা লিখতে পারতো হয়তো সব জানা যেত।
আজ বিকেলে শুভ্রা হঠাৎ অম্লানকে ডেকেছে। অম্লানের টিউশনি ছিল, আসতে দেরী হয়ে গেছে। এসে দেখে শুভ্রা কাঁদছে। শুভ্রার কাঁন্না দেখে অম্লান খুব একটা ঘাবড়ালো না। শুভ্রা নিয়মিতই কাঁদে। প্রত্যেক মানুষেরই কিছু কিছু বদ অভ্যাস থাকে। কাঁন্না শুভ্রার একটি বদঅভ্যাস। কারণে অকারণে কাঁদে।
অবশ্য অম্লান একটু মজার ছেলে। ওর সামনে কেউ বেশিক্ষণ কাঁদতে পারে না।ও দু-একটি কথা বললেই হাসতে শুরু করবে।
আজ কিছুতেই কাঁন্না থামছে না।কান্না ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। শুভ্রা সবসময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে কিন্তু আজ কাঁন্নার কোন আওয়াজ নেই।শুধু চোখ বেঁয়ে জল পরছে ।কেউ যখন শব্দ করে কাঁদে, তা হল বিলাসি কিংবা মৃত্যু কাঁন্না, মানুষ ফুঁপিয়ে কাঁদে জেদের বশে কিন্তু শব্দহীন কাঁন্নার অর্থ অনেক গভীর। এ কাঁন্না হৃদয় নিঙড়ানো দুঃখের জানান দেয়। শব্দহীন কাঁন্না নিসন্দেহে ভয়ংকর।
গতমাসে অম্লানের জন্মদিন ছিল। এজন্য আম্লান শুভ্রাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরেছে। চিকলির বিলে বিকেলে অনেক্ষন বসে ছিল দুজন। তারপর বাসায় যাবার সময় একই রিক্সায় চড়ে অম্লান শুভ্রার সাথে ওর বাসা পর্যন্ত গিয়েছিল। ছাদ থেকে শুভ্রার মা তা দেখে ফেলে। তারপর শুভ্রাকে ওর মা জিজ্ঞেস করায় সব বলে দেয়। ওর মা অনেক রাগারাগী করেছিল। আম্লানের সাথে আর যোগাযোগ করতে নিষেধ করেছিল। সেদিনের পর থেকে শুভ্রাকে ওর মা আর এ নিয়ে কোন কথা বলেনি। কিন্তু গতকাল রাতে শুভ্রার বাবা-মা ওকে ডেকে বলছে , শুভ্রা, পরশু তোমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। আমরা ঠিক করেছি তোমার বিয়ে দেব। আমরা মনে করি তুমি আমাদের কথায় দ্বিমত করবে না।
শুভ্রা দুশ্চিন্তায় পরে গেছে। বাবাকে আর কোন কথা বলেনি।গতকাল রাতে ঘুমাতেও পারেনি। ওর বাবা খুব রাগী মানুষ, তার সামনে অম্লানের কথা বলা সম্ভব না। এসব পছন্দ করেন না উনি। সকাল থেকেই অম্লানের ফোন বন্ধ ছিল। ওকেও কিছু জানাতে পারেনি সারাদিন। অম্লানের মেস চিনলে হয়তো মেসেই চলে যেত।
অনেকবার কল করার পর বিকেলে অম্লান ফোন ধরেছে। এখন দেখা পেয়ে কাঁদছে। অম্লান কি করবে কিছু বুজতে পারছে না। কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেছে মাত্র। মাষ্টার্সে ভর্তি হয়েছে, পাশাপাশি চাকরীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুটি টিউশনির টাকা দিয়ে টানাটানি করে দিন চলছে। এমন অবস্থায় শুভ্রাকে বিয়ে করাও মুশকিল । তাছাড়া অম্লানের বাবাও এতে খুব মন খারাপ করবেন।শুভ্রার বাসা থেকে তো রাজি হবেনই না। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে শুভ্রা। এমন একটা শিক্ষিত, সুন্দরী মেয়ের জন্য আরও ভাল পাত্র তারা আশা করতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই।
শুভ্রাকে বরপক্ষ দেখতে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থেকে মাষ্টার্স শেষ করে এখন একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করছে ছেলে। ছেলের বাবা মা শুভ্রাকে অনেক পছন্দ করেছে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলবে আজই। শুভ্রা কিছু বুজতে না পেয়ে ওর বাবাকে সব খুলে বলল। বাবা অনেক রাগারাগী করছে। উনি শুভ্রার কোন কথা শুনলেন না। বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেললেন। ছেলের বাবা একটু দেরী করতে চাইলেও শুভ্রার বাবা বেশি দেরী করবেন না। ১৮ই মে বিয়ে। হাতে সময় মাত্র সাত দিন।
দুই দিন পর। দুপুরে অম্লান এসেছে শুভ্রার বাবার সাথে দেখা করতে। বাসায় ঢুকে পরিচয় দেওয়ার পর শুভ্রার মা ওকে ভিতরে বসতে দিল। খালাম্মা, শুভ্রার সাথে একটু কথা বলবো। দুই দিন ধরে ওকে ফোনে পাচ্ছি না।
- শুভ্রার সাথে দেখা করা যাবে না। তুমি আমাকেই বলো, আমি ওকে বলে দিব।
- খুব দরকার ছিল । আমি অল্প সময় কথা বলেই চলে যাবো।
শুভ্ররার বাবাও চলে এসেছে। উনি অম্লানকে দুপুরে খেতে বললো। আম্লান খেতে চাইলো না। কিন্তু খুব জোর করছে।
খাওয়া শেষে শুভ্রার বাবা অম্লানকে বলে দিল, বিয়ের সময় তো তোমাকে দাওয়াত দিতে পারবো না, তাই আজই খেয়ে যেতে বললাম।
দুঃখ আর লজ্জা ভরা কন্ঠে এবার শুভ্রার বাবার কাছে মিনতি করছে, বিয়েটা যেন না দেয়। কিন্তু উনি কোনভাবেই রাজি নন। সেই সাথে অম্লানকে বলে দিল, ও যেন শুভ্রার সাথে আর কখনো দেখা না করে।
শুভ্রার সাথে দেখা হল না। বাসার নিচে নেমে দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো অম্লান। একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব । অনেক্ষন তাকিয়ে থেকেও কোন লাভ হল না।
মেসের বেডে শুয়ে শুয়ে একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে। শুভ্রার সাথে অনেক ভাল সময় কেটেছে। মেয়েটির অনেক গুন আছে ।পৃথিবীতে দুই ধরনের নারী আছে, একদলের খপ্পরে পরে পুরুষ জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। আর একদলের কাছে পুরুষরা সপ্ন দেখতে শিখে। শুভ্রা সম্ভবত দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত।
অম্লানের রুমমেট আজ রুমে গাঁজা এনেছে। গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস নেই অম্লানের, কিন্তু রুমমেটের কাছ থেকে জোর করেই নিল। শুনেছিল নেশা করলে মানুষ সব দুঃখ ভুলে থাকতে পারে। কিন্তু না! শুভ্রার সাথে কাটানো সময়গুলো বারবার চোখের সামনে উঁকি দিচ্ছে।খুব বেশিই মনে পরছে। নেশা করলে মানুষ অতীত নিয়ে ভাবে। আর অতীতের স্মৃতি সবসময় দুঃখ দেয়, হোক সে সুখের স্মৃতি কিংবা দুঃখের।
বিয়ের আগের দিন অম্লানের ফোনে একটি কল আসলো। আপরিচিত নাম্বার। কল রিসিভ করার সাথে সাথে ওপার থেকে শুভ্রার কথা ভেঁসে আসলো। আজ দেখা করতে চায়। শুভ্রার কথামত সেই বটতলায় চলে এল অম্লান।
দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। শুভ্রা কাঁদছে। অম্লানও আজ শুভ্রার কান্নার সাথী হয়েছে। শুভ্রা পালিয়ে বিয়ে করতে চাইছে। আম্লান রাজি নয়। বিয়ের পর কি খাওয়াবে। কোথায় থাকবে। অম্লানের বাড়িতেও শুভ্রাকে এখন নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া মুরুব্বিদের অমতে বিয়ে করলে তার ফল ভাল হবে না।
শুভ্রা অম্লানকে আর কিছু বলল না। নীরবে চলে গেল। নিজেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো অম্লান। যাই হোক, একটি ভাল ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে। সুখে থাকুক শুভ্রা। মানুষ যখন ব্যার্থ হয়, বিকল্প কিছু চিন্তা করে নিজেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সে নিজেও জানে এটা নিছক শান্তনাই।
আজ শুভ্রার বিয়ে। বাড়ি ভর্তি মানুষ এসেছে। সবাই অনেক অনন্দ উল্লাস করছে। এতদিন বাড়ির মানুষ আনন্দ করলে নিজেরই ভাল লাগতো কিন্তু আজ প্রথম খারাপ লাগছে। নিজে কষ্ট করে অন্যকে আনন্দিত করার মধ্যে প্রশান্তি আছে কিন্তু নিজের মৃত্যুর জন্য সবার আনন্দটাকে নষ্ট করতে অবশ্যই ভাল লাগবে না। হুম মৃত্যু। শুভ্রা আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুভ্রা একটি নীল কাগজে চিঠি লিখছে, “প্রিয় অম্লান……………।“
আজ ১৮ই মে ২০০৭। অম্লান সেই বটগাছটির নীচে বসে আছে। হাতে নীল চিঠি। আজ কেউ অম্লানের অপেক্ষায় চোখের জল ফেলছে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:০৮