হঠাৎ এত গুলি ছুড়ছে কেন পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদক
হঠাৎই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ। দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশের গুলিতে একের পর এক নিহতের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু হঠাৎই পুলিশ এত গুলি ছুড়ছে কেন? এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে অপরাধ-বিশেষজ্ঞদের। তাদের অনেকেই বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। গুলি করার আগে বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় আনছেন না পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের অতি-উৎসাহী কর্মকাণ্ডের ফল সরকারকেই ভোগ করতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অপরাধ-বিশেষজ্ঞ বলেন, 'আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দোহাই দিয়ে গুলি করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা কখনোই পুলিশকে শেখানো হয় না। বর্তমান পরিস্থিতি তো এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেনি যে, পুলিশকে নির্বিচারে গুলি করতে হবে। আইনে উল্লেখ করা না হলেও আগে পুলিশ হাঁটুর নিচে গুলি করত। এখন মেরে ফেলার উদ্দেশে সরাসরি বুকেই গুলি করছে। বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নয়।' সাবেক মুখ্য সচিব সা'দাত হোসেন এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'পুলিশ মনে হয় অনেক চাপে রয়েছে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। আবার তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। নইলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।'
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ড. এনামুল হক বলেন, 'পুলিশ তো হুকুমের চাকর। তাই হুকুম পালন তো করতেই হবে। তবে হুকুম দেওয়ার আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেরও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত। গুলির হুকুমটি আসলেই দায়িত্ববোধ থেকে দেওয়া হচ্ছে কি না।' ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হুকুমটিও অধস্তনকে নিজের বিবেকবোধ থেকে বিচার করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অনেক পুলিশ সদস্য গুলি করার ক্ষেত্রে ওপরের নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। তাদের সংখ্যাই বর্তমানে এ বাহিনীতে বেশি। আবার অনেক পুলিশ সদস্য হুকুম পাওয়ার পরও নিজের বিবেকবোধ থেকে বিবেচনা করার পর এর প্রয়োগ ঘটান।'
মানিকগঞ্জের ঘটনার বিষয়ে ড. এনামুল বলেন, 'এ ঘটনাটি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কারণে ওই এলাকার প্রতি আমার এক ধরনের টান কাজ করে। এ ধরনের ঘটনা যদি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যায় তাহলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। নীতি-নির্ধারকদেরও বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। আইন সবার জন্য সমান। তবে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা হয় কি? সম্প্রতি বরিশালে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছনার ঘটনাটিও আমাকে অনেকটা আহত করেছে।'
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো একেকটা একেক রকম। তবে জীবনের নিরাপত্তা কিংবা অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটলে পুলিশ গুলি ছুড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুমের প্রয়োজন হয় না। তবে বর্তমান যুগ তো মোবাইলের যুগ। সে ক্ষেত্রে পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি থাকলে সেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি তো নিতেই পারে পুলিশ। ঢাকায় তো পুলিশের গুলিতে কারও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি!' রায়ট কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে পুলিশের উচিত প্রথমে ওয়ার্নিং দেওয়া এমন বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিকল্প হিসেবে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল কিংবা ফাঁকা গুলি ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করার উদ্যোগ নিতে পারে পুলিশ। পুলিশের দায়িত্ব-কর্তব্য ও ক্ষমতা সম্পর্কে 'সিআরপিসি' ও 'পিআরবি' আইনে তো বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, 'জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ অবশ্যই গুলি চালাতে পারে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধিই পুলিশকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুমেরও প্রয়োজন নেই। মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে সহকারী কমিশনার থেকে তদূর্ধ্ব পুলিশ কর্মকর্তাদের তো নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়াই আছে।' হাঁটুর নিচে গুলির বিষয়ে তিনি বলেন, 'হাঁটুর নিচেই গুলি করতে হবে আইনে এমন কথা নেই। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশই গুলি চালানোর জন্য যথেষ্ট। তবে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়টি নিয়ে যথাযথ জবাবদিহির প্রয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষেই ওই পরিস্থিতিতে গুলিবর্ষণ করা প্রয়োজন ছিল কি না।'