somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রধানমন্ত্রী চাপে নয়, অন্তরাত্মা যা বলে তাই করুন

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রধানমন্ত্রী চাপে নয়, অন্তরাত্মা যা বলে তাই করুন

পীর হাবিবুর রহমান (বাংলাদেশ প্রতিদিন)

১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই আজ রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারও চাপে নয়। সবার সঙ্গে সংলাপ করে আপনার অন্তরাত্মা যা বলে সেই সিদ্ধান্তই নিন। দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া যায় না। হানাহানি, খুনখারাবি, রক্তপাত, সহিংসতা আর মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না। লাখো শহীদের রক্তেভেজা এই মাটিতে সহিংস সন্ত্রাসের হোলিখেলা নয়। জাতীয় ঐক্যের পথে শান্তি, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাই। সব উগ্রতা, হঠকারিতা, সন্ত্রাস আইন বিধান বলে নিয়ন্ত্রণ চাই। আগুন নিয়ে কাউকে খেলতে দেওয়া নয়। সবার প্রতি আইন সমান এই দৃষ্টিতে কঠোর অবস্থান চাই। উসকানির বদলে শান্তির সুবাতাস চাই। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনার ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এখনো অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার বুকে এক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বাংলাদেশ এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। একদিকে সরকার ও বিরোধী দলের যোজন যোজন দূরত্ব, অকার্যকর সংসদ, জাতীয় ঐক্যের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরাহত। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারকে ঘিরে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াত-শিবিরের সহিংস তাণ্ডব, অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি ও তাদের দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে শাহবাগ চত্বরে ছড়িয়ে দেওয়া অহিংস আন্দোলন, ব্লগারদের নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি, ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে বড় ধরনের আঘাত দিয়ে পরিস্থিতিকে অশান্ত অগি্নগর্ভ করেছে। সহিংস মূর্তিতে জামায়াত-শিবির উগ্রপন্থিদের নিয়ে রাষ্ট্রের ওপর আঘাত করেছে। বিপরীতে জাতীয় ঐক্য সুসংহত হয়নি। এক ত্রিশঙ্কু অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। রাষ্ট্রনেতার মতোই প্রধানমন্ত্রী আপনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, কোনো ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা যাবে না। জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে কেউ আঘাত করতে পারবে না। আপনার সরকারের তথ্যমন্ত্রীও প্রেস ব্রিফিং করে বলে দিয়েছেন, 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশ, ব্লগ বা ফেসবুকে লেখা ও প্রকাশ থেকে বিরত না থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।' আপনার সরকার এখানে সিদ্ধান্ত সঠিক নিয়েছে। যারা এই গর্হিত কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে আইনের আওতায় আনা জরুরি। গণতন্ত্র মানে এটা নয় মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পরিস্থিতিকে বেসামাল ও অশান্ত করা। গণতন্ত্র মানে এই নয় যে জাতির রক্তে কেনা পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া। শহীদ মিনারে দানবের হামলা। আজকের যুদ্ধাপরাধ মামলায় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো '৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ৯০ শতাংশ নেতা-কর্মী নামাজ পড়েন। একবার তার সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে তিনি বলেছিলেন, এরশাদের সেনা শাসনামলে বঙ্গবন্ধু ভবনে আপনাকে যখন অবরুদ্ধ করে রাখা হয় তখন সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন তার সেনা কর্মকর্তা পুত্র। সেই পুত্র নাকি তাকে বলেছিলেন আপনি নিয়মিত নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত করেন। গোটা বাংলাদেশ জানে আপনার দিন শুরু হয় তাহাজ্জুদের নামাজের মধ্য দিয়ে। ফজরের নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াতের পর আপনি চায়ের সঙ্গে সংবাদপত্র নিয়ে বসেন। আমাদের শৈশবে পাড়ায় সংখ্যালঘু হিন্দু-খ্রিস্টানদের সঙ্গে এক অসাম্প্রদায়িক আত্দীয়তার বন্ধনে বেড়ে ওঠা হলেও ফজরের এবং মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়তে বসা নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। মুমিন-মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়ে আল্লাহ-রাসূল (সা.)-এ বিশ্বাসী ধর্মভীরু হয়ে বেড়ে উঠলেও বন্ধু-বান্ধব, সামাজিকতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে কখনো মনে হয়নি স্বজনদের মধ্যে ধর্মের কারণে কোনো ভেদাভেদ রয়েছে। পারস্পরিক হৃদ্যতা ও সম্মানবোধের এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিতে এই মাতৃভূমির মানুষ বেড়ে উঠেছে। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ এলে মহানন্দে ভিন্ন ধর্মের স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত করে যেমন নিয়ে এসেছি তেমনি পূজা-পার্বণে তাদের নিমন্ত্রণেও ছুটে গেছি। আমাদের কবিতার মতো সাজানো সুনামগঞ্জ শহরের সাবেক মন্ত্রী অক্ষয় কুমার দাস এখন আর নেই। রমজান মাসে আমাদের অনেক বাড়িতে ইফতার পাঠাতেন। ঈদের জামাত শেষে ঈদগাহ ময়দান থেকে বের হয়ে দেখতাম বাইরে তিনি লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুসলি্লদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে তিনি প্রতি ঈদে এভাবেই ছুটে আসতেন। আমাদের ভাষার সংগ্রামে, আমাদের বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে, '৭০ ও '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শহীদের রক্ত এক হয়ে মিশে গেছে। এই দেশ তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। আর প্রতিটি মানুষের জান-মাল ও গণতান্ত্রিক অধিকার হেফাজত করার দায়িত্ব সরকারের। '৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহরা ধর্মের নামে এ দেশের মুসলমানদের শেখ মুজিবের নৌকা থেকে নামাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোটা জাতিকে এক সুতোয় বেঁধে আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমি উপহার দিয়েছিলেন।

২. প্রধানমন্ত্রী জানেন '৪৭ সালের মধ্য আগস্টে এক দিনের ব্যবধানে দুটো দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তার একটি ভারত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনায় হাঁটতে হাঁটতে দুনিয়ার বুকে আজ চতুর্থ শক্তিশালী বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে সেনাশাসন আর সাম্প্রদায়িকতার পথ হেঁটে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা গণহত্যা চালিয়েও ঠেকাতে পারেনি। যুদ্ধে পরাজয়ের কলঙ্ক মাথায় নেওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রটি অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে ফের সাম্প্রদায়িকতা ও সেনাশাসনের পথে হেঁটে আজ এক ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করছে। জঙ্গিবাদ পাকিস্তানকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে।

লাখো শহীদের রক্তের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়কে সুসংহত করতে বঙ্গবন্ধুর সরকার এক অসাধারণ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দিয়েছিল। সেদিন জামায়াতসহ দক্ষিণপন্থি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু আপনার মনে আছে, জাতির জনক অসহায়ের মতো দেখলেন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দাঁড়িয়ে একদিকে তার দলের কিছুসংখ্যক নেতা-কর্মীর চরম উন্মাসিকতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে ডুবে যাওয়ায় সৃষ্ট গণঅসন্তোষ; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসা তারুণ্যের শক্তিকে নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের নেতৃত্বে গঠিত জাসদের উগ্র হঠকারিতা, এক পর্যায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের মতো অবিশ্বাস্য কর্মসূচি দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া। সেদিন নিষিদ্ধ জামায়াতের অনেক তরুণ জাসদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেদিন আলবদর, আলশামসের কলঙ্ক মাথায় পরা জামায়াতের ক্যাডাররা পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। কেমন করে চীনারা অতি বিপ্লবের পথ নিয়েছিল। কীভাবে ঈদের জামায়াতে জনপ্রতিনিধি হত্যাসহ মানুষ খুনের বীভৎস রাজনীতিতে দেশকে অশান্ত, অস্থির করে তুলেছিল। সেদিন মস্কোপন্থিরা কার্যকর বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন না করে সরকারি দলের হেরেমে প্রবেশ করে এক পর্যায়ে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা, আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের জন্য একদলীয় বাকশাল গঠন করাল। '৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে বাঙালি জাতি নেতৃত্বহারাই হয়নি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্মম, নৃশংসভাবে বিশ্বসভ্যতার বুকে কলঙ্কের চিহ্ন এঁকে দিয়ে পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করল। সেদিন দেশকে ধর্মের রাজনীতির পথে হাঁটানো শুরু করলেও না উগ্রপন্থিরা পাশে এসে দাঁড়াল, না অতি বামেরা! মস্কোপন্থিরা বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খাল কাটা বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পথে বহু রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে দেশবাসী আপনাদের নেতৃত্বে '৯০ সালে গণতন্ত্র মুক্ত করলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা হলেও দিনে দিনে সংসদ অকার্যকর হলো। সংসদ বর্জনের রাজনীতি স্থায়ী হলো। সরকার ও বিরোধী দলের দূরত্বের মাঝখানে প্রতিহিংসার রাজনীতি কালো দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে গেল। গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার ও বিরোধী দলের আলাপ-আলোচনার দরজা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা নির্বাসিত হলো। এমনকি দিনে দিনে দুর্নীতি, দলীয়করণ সর্বগ্রাসী রূপ নিল। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হতে থাকল। দলে দলে গণতন্ত্র নির্বাসিত হলো। আপাদমস্তক আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন। ২১ বছর ধরে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ব্যক্তির খেয়াল-খুশিমতো মুঠোয় পুরে অনুগত দাসদের নিয়ে চলতে গিয়ে গোটা রাজনীতিকে বন্ধ্যা নদীর মতো শুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মী তৈরির কারখানাই কার্যত এখন বন্ধ। মুক্তচিন্তার কর্মীরা এখন আর ছাত্র রাজনীতির পথ হেঁটে জাতীয় রাজনীতিতে আসেন না গণতন্ত্র ও আদর্শের চেতনা বুকে নিয়ে। বিএনপি-জামায়াতের অপশাসন ও ওয়ান-ইলেভেনের ব্যর্থতায় হতাশ-ক্ষুব্ধ জনগণ বহু আশা নিয়ে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা আপনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে তিন-চতুর্থাংশ আসনে ব্যালট-বিপ্লবে অভিষিক্ত করেছিল। এই নিরঙ্কুশ গণরায় নিয়ে এত ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আপনি ক্ষমতায় এলেও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে রিক্ত-নিঃস্ব মানুষ ন্যায়বিচার পায়নি। দলীয়করণের অব্যাহত যাত্রা মানুষ গ্রহণ করেনি। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। হলমার্কের ঘটনা জনগণকে বিক্ষুব্ধ করেছে। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি মানুষের গণসমর্থন থাকলেও এ নিয়ে সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতাদের অতিকথন বিরক্তির কারণ হয়েছে বার বার। দিনরাত বড় বড় কথা বলে রেলের কালো বিড়াল কেলেঙ্কারি সরকারকে গণমানুষের হৃদয়ে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। তবুও মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচারে সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু সিভিল সোসাইটি বার বার বলেছে জামায়াত যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ততক্ষণ তাদের স্বাভাবিক সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়া হোক। কিন্তু পুলিশ জামায়াতকে পথে নামলেই বেধড়ক পিটিয়েছে আর জামায়াতও পাল্টা রুদ্রমূর্তি নিয়ে পুলিশের ওপর সহিংস আক্রমণ করেছে। এভাবেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়েছে। এখানেও সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতারা জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি তুলে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেননি। সরকার যদি চায় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করবে, তাহলে দল ও সরকারের এবং সমমনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলেই পারে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার প্রয়োজন ছিল না।

৩. জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন দণ্ড দিলে ব্লগের তারুণ্য শাহবাগ স্কয়ারে মোমবাতি জ্বালিয়ে গণজাগরণ তৈরি করে। এই গণজাগরণের আগুন জ্বলে ওঠে রায়ের আগের দিন হঠাৎ পুলিশ-শিবিরের ফুলের মহব্বত ও সৌহার্দ্য পরিবেশে সমাবেশ করার সুযোগ দেওয়ার কারণে। খবর রটে যায় সরকার ও জামায়াতের আঁতাত হয়ে গেছে। আঁতাতের রাজনীতি মানুষ অতীতে কখনো স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। এবারও করেনি। তাই গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয় তরুণ প্রজন্মের ডাকে। মঞ্চে সরকারের মন্ত্রী-নেতারা ছুটে যাওয়ায়, পুলিশ সংহতি ও নিরাপত্তা দেওয়ায়, স্কুলের ড্রেস পরা বালিকা থেকে শুরু করে নারী-শিশুরাও যেতে নিরাপদ মনে করে। সরকার যেখানে গণজাগরণ মঞ্চের দাবির সঙ্গে সংহতি ও একমত পোষণ করেছিল সেখানে শাহবাগের এই গণজোয়ার সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার দরকার পড়েছিল কি না তা চিন্তার বিষয়। এমনকি ইসলামী ব্যাংকের মতো বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গণরোষ তৈরি করা এবং কোথাও কোথাও হামলার ঘটনা সরকারের জন্য কতটা সুখকর, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য ইতিবাচক তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিল। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দাবি সরকার গ্রহণ করার পর টানা ১৭ দিন এটিকে অব্যাহত রাখার যৌক্তিকতা কেন দেখা দিল? যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। এটি ট্রাইব্যুনালের হাতে। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সমান সুযোগ সরকার নিশ্চিত করে দিয়েছে। বাকি জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধসহ নানা দাবি বাস্তবায়ন আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সংসদে আইন করলেই সম্ভব। সরকার তা না করে সারা দেশে গণজাগরণ মঞ্চকে বহাল রাখার উৎসাহ কেন জোগাতে গেল! ব্লগারদের ধর্ম নিয়ে সাইবার যুদ্ধ আপত্তিকর মন্তব্য গোটা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ব্যথিত করেছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়কোচিত অবস্থান নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হওয়ার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো যোগসূত্র নেই। ধর্মের নামে অতি বাড়াবাড়ি ও সন্ত্রাস উগ্রতার শামিল। '৭১-এর ভূমিকা ও পরবর্তীতে রগ কাটার রাজনীতির নৃশংসতা জামায়াত-শিবিরকে এই মুসলিম দেশের জনগণের হৃদয়ে ঠাঁই দেয়নি। ইসলাম আর জামায়াত এক নয়। তাই জামায়াতে ইসলামী যে রকম এ দেশে গণরায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে তেমনি উগ্রপন্থি নাস্তিকেরাও জনরায় আদায়ে ব্যর্থই নয় জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। শাহবাগের মঞ্চের পাশে যাদের দেখা গেছে স্বাধীনতা-উত্তরকালে শেখ মুজিবের শাসনামলে কিংবা পঁচাত্তর-উত্তর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কখনোই তারা পাশে ছিল না। তাদের ভূমিকা দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগ ও মুজিব বিদ্বেষী ছিল। এই গুটিকয় শাহবাগ মঞ্চের আঙিনা থেকে গণমাধ্যমের টকশোতে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি অব্যাহত রেখেছিল। এতে জামায়াতের সঙ্গে যেসব ইসলামপন্থি দলের বিরোধ বরাবর তুঙ্গে সেখানে আজ তাদের সম্পর্ক এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক উচ্চতার শিখরে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে এ দেশের জনগণ, এ দেশের মুসলমান তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে পেতে নফল নামাজ পড়েছিল, রোজা রেখেছিল। পঁচাত্তর-উত্তর অবরুদ্ধ সময়ে লুকিয়ে হলেও মিলাদ মাহফিল করেছে। তবুও বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারণে কবি দাউদ হায়দারকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। তখন নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল গণতান্ত্রিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির হলেও বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে নির্বাসনে যেতে হয়েছে সেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে। দুজনের কাউকে দেশে আনার দাবি আজকের অতি প্রগতিশীলরা তুলছেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে যে কমিশন হয়েছিল তার কো-চেয়ারম্যান করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের অনেকে আজ জামায়াতসহ ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বললেও বাস্তবতার নিরিখে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখতে বাধ্য হয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল করতে পারেননি। একই বাস্তবতা মাথায় নিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং এই সম্ভাবনাময় উদার গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশটির শান্তি ও উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। ৪২ বছর ধরে আমাদের রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা, মন্ত্রী-এমপিরা দুই হাতে মসজিদ, মাদ্রাসায় সরকারি অনুদান উদার হাতে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল দুবার ক্ষমতায় এলেও এই উদারতা নিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ ও বিকাশে তা করেননি। গতকাল সারা দেশে জুমার নামাজের আগে-পরে জামায়াত-শিবির ও সমমনা ইসলামপন্থি দলগুলো যে সহিংস বিক্ষোভ করেছে, যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর বর্বরোচিত হামলা করেছে, যেভাবে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়েছে, শহীদ মিনার থেকে গণজাগরণ মঞ্চ হয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলে পড়েছে তা সাম্প্রতিককালে ঘটেনি। রক্তক্ষয়ী এ ঘটনা সামনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আজ সংলাপের দুয়ার খুলে দিতে হবে। বিরোধী দলসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এমনকি ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গেও প্রয়োজনে আলোচনার সময় এসেছে। দেশের দলকানা বুদ্ধিজীবী-লেখক নয়, দেশবরেণ্য আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক ও শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই চলমান সংকট উত্তরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি। এ দেশের মানুষ ধর্মের নামেই হোক আর সাম্যবাদের নামেই হোক, কিংবা হোক সমাজতন্ত্রের নামে কোনো উগ্রতাকে কখনো ঠাঁই দেয়নি। ধর্মের নামেই হোক আর রাজনীতির নামেই হোক কোনো সন্ত্রাসকে সমর্থন দেয়নি। আমাদের সামনে দুর্নীতির অবসান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও তার পরিবেশ নিশ্চিত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এই সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আজকের এই দিনে বিনম্র অনুরোধ- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি রাগ-অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে নয়, কারও চাপের কাছে নতিস্বীকার করে নয়, আপনার অন্তরাত্দা যা বলে রাষ্ট্রনায়কোচিত অবস্থানে দাঁড়িয়ে সেই সিদ্ধান্তই নিন।


১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×