তারুণ্যের উচ্ছ্বাস : শাহবাগ থেকে হারিয়ে গেল আম-বামের কানাগলিতে!
শিকদার আবু নছর মঈনদ্দীন ঃ শাহবাগ মোড় আজ চত্বরে অভিহিত হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এর কারিগর। সত্যি বলতে কি, তারুণ্যের বয়সসীমা একটা তো আছে, যে বয়সে তারা অধিক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত হয় নানাভাবে। এটা তাদের দোষের নয়, বয়সই প্রধান চালিকাশক্তি। যেমন তারুণ্যের উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙা অগ্রপশ্চাত্, ন্যায়-অন্যায়, দিবারাত্রী, লাভক্ষতি বিবেচনা করে না। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই প্রজ্ঞা অনুপস্থিত থাকে স্বাভাবিক কারণে। তারা আনন্দ পেতে এবং দিতে যে কোনো ধরনের হৈ-হুল্লোড় পচ্ছন্দ করে, এখানে অভিজ্ঞতার প্রশ্ন গৌণ। অভিজ্ঞ বিবেচকরা দূরদৃষ্টি নিয়ে এদের আবেগকে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে যদি চালিত করে, তবে পরিবার-সমাজ-দেশ উপকৃত হতে পারে। বিপরীতে ধান্দাবাজরা যদি সস্তা আনন্দ দিয়ে এদের আবেগকে প্রভাবিত করে, তবে তা সবার জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। এগুলো বলছি তাদের আবেগকে ছোট করার জন্য নয়। তারা আমাদেরই সন্তান। আমাদের তরুণদের আমরা সেই পরিবেশ, শিক্ষা যে দিতে ব্যর্থ হয়েছি, তার চিত্র আমরা দেখি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সহ দেশের সর্বত্র। তরুণ অন্য তরুণের গলা কাটছে, টুকরো টুকরো করছে, ভয়াবহ মাদাকাশক্তিতে সম্পৃক্ত হচ্ছে, তরুণীরা ধর্ষিত-খুন হচ্ছে, শিক্ষককে শুধু অপমানই নয়, মারধর এমনকি খুন পর্যন্ত করছে, চাঁদাবাজি করছে, রাজনৈতিক দলবাজি করছে। চোখের সামনে এসব ঘটলেও অন্য তরুণরা রুখে দাঁড়াচ্ছে না। এজন্য তাদের দোষ দেয়া যায় না। দোষ, যারা তাদের চালিত করছে, সেসব অনৈতিক শক্তির। তবে নেতৃত্বে যাদের দেখছি, তারা অবশ্যই তারুণ্য ছড়িয়েছে অনেক আগেই। তারা বর্তমানে পুরোপুরি যুবক এবং কৌশলীও বটে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ডা. ইমরান এইচ সরকার, ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু ছাড়াও আওয়ামী এবং বাম অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন। এখানে আরও যারা প্রথম থেকেই উসকানি দিচ্ছেন এবং পরিচালন করছেন, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ কী তা দেশবাসী জানেন। তারা আওয়ামী ও বাম ঘরানার শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি এবং ছাত্রসংগঠনের নেতা। আমি স্থানীয় সমাবেশে অংশ নেয়া কয়েকজন তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আলাপ করেছি, যারা মুক্তিযুদ্ধ-’৭২-৭৫ বা এর পরবর্তী সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাই রাখে না, তারা স্বীকারও করেছে তাদের অজ্ঞতার বিষয়ে। আসলে তারা সত্য জানতে চায়, সত্য পথে চলতে চায়। অনেকেই বিষয়টাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন, ঠিক ঘরপোড়া গরুর মতো। তারা বলছেন, এটা সরকারের সাজানো নাটক।
ঢাকাসহ সারা দেশে তরুণদের সমাবেশ এখন ক্ষমতাসীনরা কূটকৌশলের মাধ্যমে কঠোরভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত করছে। জনবহুল রাস্তাগুলো বন্ধ করে নিরপত্তা প্রদানসহ প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। গত ১৪-০২-১৩-এর জন্য মোমবাতি কেনা হয় ১৫ লাখ টাকার। সাধারণ ব্লগারদের উচ্ছ্বাসকে তারা ছিনতাই করে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে জনসাধারণকে আবারও বিভ্রান্ত করছে বলেই সচেতন মহল মনে করছেন। প্রাথমিক পর্যায়ের কয়েকজন ব্লগারকে এরই মধ্যে এখানে আর দেখা যাচ্ছে না। জনৈক ব্লগার একজন প্রকৌশলী পল্লবীতে খুন হয়েছেন। তার রাজনৈতিক পরিচয় কী, কারা খুন করল সরকারকেই এর সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করে খুনির শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেয়া হবে না। রোববার আওয়ামী-বাম সাংস্কৃতিক কর্মী ও ছাত্রনেতারা এখানে বক্তব্য রাখেন। আওয়ামীপন্থী ব্লগার ডা. ইমরান এইচ সরকারের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, কোনো সামরিক শাসক দেশবাসীর প্রতি চরম ফরমান জারি করছেন। তিনিও নির্দলীয় নন, নন কোনো তরুণ।
’৭৫-এ পালের গোদা হিসেবে বামরাই আজীবন গণতন্ত্রের পূজারি বঙ্গবন্ধুকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে একদলীয় বাকশাল গঠনে প্ররোচিত করেছিল। এবারও উচ্ছিষ্টভোগী বামরা আবার আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে সমাজতন্ত্রের প্রেতাত্মাদের নিয়ে।
জনৈক প্রাথমিক শিক্ষকের মতে সরকার যেখানে ভিন্নমতের মানুষদের কোটি নাগরিকের নগরে কোনো স্থানেই দুই ঘণ্টার জন্য সমবেত হতে দেয় না ক্ষমতা হারানোর ভয়ে, সেখানে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড় যেখানে দুটি বৃহত্তম হাসপাতালসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বৃহত্ প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু সেখানে দু’সপ্তাহ ধরে বিরামহীন সমাবেশ সরকারের সহযোগিতা ও একাত্মতায় চলতে পারে কীভাবে?
অন্য একজনের বক্তব্যে উঠে আসে, যুদ্ধ অপরাধের বিচার তো মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সবাই চায়। তরুণ প্রজন্ম তাদের সামনে ঘটে যাওয়া অনেক মানবতাবিরোধী, দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে খামোশ কেন? তারা কি দেখেনি, বিডিআর ম্যাসাকার, জানবাজ প্রায় ৬০ সেনা অফিসার হত্যা, অসংখ্য সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী আর সাধারণ মানুষের গুম-খুন, হলমার্ক-ডেসটিনি-পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজারসহ দুর্নীতির সঙ্গে দলীয় উচ্চপর্যায়ের রাঘব-বোয়ালদের বিচার না করে দেশপ্রেমের খেতাব প্রদান, ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের পুলিশের সহায়তায় অস্ত্রহাতে সন্ত্রাস আর খুনখারাবি এবং ফেলানির মতো দরিদ্র তরুণীর সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশের ছবি নিয়ে কিছু তারুণের প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দেয়ার চিত্র? এ সবই তো বর্তমান শাহবাগ চত্বরের তরুণদের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এ তরুণরা তো এসব বিষয়ে কিছুই বলছে না। এগুলো কেন তাদের হৃদয় স্পর্শ করল না?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি যেমন খুব যৌক্তিক এবং জোড়ালো, ঠিক কেবল ফাঁসির দাবিও ঠিক তেমনি অযৌক্তিক ও দুর্বল, তা নৈতিক ও আইনি দৃষ্টিতে। কেউ বিচারের রায় নির্ধারণ করে দিয়ে বিচার প্রার্থী হতে পারে না। তাহলে আর বিচারের নামে দীর্ঘ প্রহসনের প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের দরকার কী? আইন যখন নিজের হাতেই সরকার তাদের মনমতো অভিযুক্ত করে একটা ময়দানে নিয়ে হত্যা করলেই তো গায়ের জ্বালা জুড়ায়, একদলীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়। এরকম হলে তা কেবল আমাদের দেশ কেন বিশ্বের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ দাবি বালখিল্য, এ দাবি আওয়ামী লীগসহ সমমনা কিছু নামসর্বস্ব দলের আর কিছু বুদ্ধিজীবীর। সাধারণের দেখা, সরকার সমর্থিত একটি টিভি চ্যানেলের জনৈকা প্রধান প্রতিবেদক সূচনালগ্নের প্রথম দিন ৪০-৫০ তরুণকে প্রভাবিত করে প্রতিবেদন বানায় এই জনগুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। এরপর উত্সুক তরুণ-তরুণীরা ধীরে ধীরে জমায়েত হতে থাকে, অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোও যে যার মতো ভূমিকা রাখে। আন্দোলনকারীরা ইসলামী ব্যাংকসহ দিগন্ত টিভি, নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকা বন্ধেরও দাবি জানায়। এটা বাকশালী মানসিকতার চরম প্রকাশ। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকী বীর-উত্তম দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং মহীউদ্দীন আলমগীর, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী। সরকারকে এ দু’জনের গ্রেফতার এবং বিচার করার কথা বলেছেন। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের মধ্যে আমাদের জানামতে অনেকেই ওই অপরাধে অপরাধী। তরুণ প্রজন্ম শাহবাগ থেকে কি এসব দাবি করতে পারবে? মনে হয় না।
শুধু আবেগ আর হিংস্রতা দিয়ে বিচারব্যবস্থাকে কলুষিত আর প্রশ্নবিদ্ধ করা জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই বিচার ত্বরান্বিত করতে হবে। চূড়ান্ত ফলাফল যা হবে সবাইকেই মানতে হবে। বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ সমাজের জন্য ভালো ফল দেয় না। অথচ তরুণ নামের আন্দোলনকারীরা যদি সচেতনভাবে ন্যায়ের পথে, আওয়ামীমুক্ত থাকে অন্তত মাহমুদুর রহমানের মতো সত্, দেশপ্রেমিক ও সাহসী, যিনি বিনা অপরাধে বছরকাল জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য করে বর্তমানে নিজ অফিসে দুই মাসের অধিক কাল ধরে অবরুদ্ধ, এরকম মানুষের কাগজটিকে আক্রমণ করত না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই একচোখা বিষয়টা বিশ্লেষিত হচ্ছে এভাবে যে, আওয়ামী নেতৃত্ব যখন জনগণের কাছে হালে পানি পাচ্ছে না, তখন উপায়ান্তর না দেখে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে কৌটিল্য-দর্শনের মাধ্যমে শাহবাগে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস সৃষ্টির প্রয়াস পায়। অথচ কোটি নাগরিকের শহরে প্রতিষ্ঠিত যে কোনো রাজনৈতিক দলই বিনা বাধায় এরকম সমাগম ঘটাতে সক্ষম। রাজনীতির এই কানাকাছি খেলা যে সরকারের জন্য বুমেরাং হতে পারে না, তা ধরে নেয়া হবে বোকামি।
এখন এই তরুণদেরই ঠিক করতে হবে যেন কোনো ধরনের অস্তিত্ব সঙ্কটে না পড়ে তাদের ভাবমর্যাদা। তাদের মাথায় রাখতে হবে, যেমন যুদ্ধ অপরাধ, তেমনি ’৭২ থেকে ’৭৫ এবং পরবর্তীকাল, আর অবশ্যই তাদের চাক্ষুষ দেখা বিগত চার বছর মাথায় না নিলে এই চত্বরের তারুণ্য হারিয়ে যাবে শাহবাগ থেকে কানাগলিতে। তরুণদের ইতিহাস-সচেতন হতে এবং বিবেকের দাসত্ব করতে হবে দেশপ্রেমের তাগিদেই। ইতিহাসে বিজয়ী বীর হতে হলে কোনো সংকীর্ণ দলীয় ইচ্ছার দাসত্ব না করে নৈতিকতার বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই বিপ্লব এবং বিপ্লবীরা চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার
স্থানীয় সময় ঃ ০১০৬ ঘণ্টা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩