ধর্ষণ চেষ্টায় আওয়ামীপন্থী চবি শিক্ষক চন্দন পোদ্দার গ্রেফতার : ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, নিন্দার ঝড়
বেলাল উদ্দীন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নারীর প্রতি সহিংসতার মহোত্সবে এবার যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক, সাবেক প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ও পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চন্দন কুমার পোদ্দার। গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণ করার চেষ্টার অভিযোগে গত শুক্রবার খুলশী থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। চন্দন কুমার পোদ্দারের স্ত্রী এবং গৃহপরিচারিকার অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গৃহপরিচারিকা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে খুলশী থানায় মামলা (মামলা নং-২৫) করেন। গতকাল সকাল ১১টায় তাকে আদালতে পাঠানো হয়। চন্দন কুমার পোদ্দারের এ কুকীর্তির কথা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে।
গ্রেফতারের পর সরকারদলীয় শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে ওই শিক্ষককে জামিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিষয়টি মিডিয়া কর্মীরা জেনে যাওয়ায় এবং অভিযুক্তের স্ত্রীর শক্ত অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হন। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২২ জানুয়ারি চন্দন কুমার পোদ্দার তার স্ত্রী মুন্না ভৌমিকের অনুপস্থিতিতে বিকাল পৌনে ৫টায় তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে চন্দন তার স্ত্রীর ওপরও চড়াও হন এবং মারধর করেন।
মুন্না ভৌমিকের ভাই সঞ্জয় ভৌমিক আমার দেশকে বলেন, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সম্মানের কথা ভেবে এতদিন পারিবারিকভাবে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সুরাহা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত থানায় আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগেও এ ধরনের একাধিক অভিযোগ আমার বোনের কাছে এসেছে। কিন্তু মান-সম্মানের ভয়ে তিনি মুখ খোলেননি।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল লতিফ গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ওই শিক্ষকের স্ত্রী এবং গৃহপরিচারিকার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে চন্দন কুমার পোদ্দারের এ কুকীর্তির কথা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ ঘটনা শিক্ষক সমাজের জন্য কলঙ্কজনক। এই ঘটনার পর তিনি আর কিছুতেই শিক্ষকতা করতে পারেন না। শিক্ষকরা তার বিরুদ্ধে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ করেন।
পোদ্দারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : গত আওয়ামী শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) নিয়োগ পাওয়া চন্দন কুমার পোদ্দারের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার সময় বিভাগের শিক্ষকরা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। তবে ওপর মহলের নির্দেশে সেই সময় বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয়।
২০০৯ সালে বর্ধিত বেতন ফি-বিরোধী আন্দোলনের সময় ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ছিলেন এই শিক্ষক। সেই সময় তিনি পুলিশের সঙ্গে লাঠি হাতে নিজে অনেক ছাত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। এর প্রতিবাদ করায় অনেক সিনিয়ার শিক্ষককেও পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন সেই সময়। বেতন ফি-বিরোধী আন্দোলনের সময় এ ধরনের আচরণের জন্য পরে শিক্ষার্থীরা তার গায়ে জুতা ছুড়ে মেরেছিল। এছাড়া মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীর জমা দেয়া থিসিস নিয়ে নিজের নামে আর্টিকেল ছাপানোর অভিযোগও রয়েছে পোদ্দারের বিরুদ্ধে।
এ ধরনের ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন বলেন, অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্রেফতারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সাময়িক ব্যবস্থা নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকার পরও কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
বিচারের দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন : কাজের মেয়েকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা শিক্ষক চন্দন কুমার পোদ্দারের অপসারণ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার চত্বরে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।
এ সময় শিক্ষার্থীরা বলে, এই সেই চন্দন কুমার, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও বর্ধিত বেতন-ভাতাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে লাঠি হাতে শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়েছেন। তার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দ্বারা কাজের মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় জাতি আজ লজ্জিত। অবিলম্বে এই ধর্ষক শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণের দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে আজ রোববার বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশন চত্বরে মানববন্ধন ও পোদ্দারের অপসারণের দাবিতে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।
ছাত্রদলের বিবৃতি : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও চন্দন কুমার পোদ্দার কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন বলে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। চবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন সালাম মিঠু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, এসব শিক্ষককে যদি বিচারের সম্মুখীন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না হয়, তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বিবৃতিতে অবিলম্বে এই ধর্ষক শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণের দাবিকরা হয়।