দেশের অন্যতম কৃতী চলচ্চিত্রকার, লেখক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের হাত ধরে আমাদের চলচ্চিত্র সমৃদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বেশকিছু তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, যা দর্শক দেখার সুযোগ পায়নি। দেশ স্বাধীনের পর তিনি নিখোঁজ হন। সেই থেকে আজও নিরুদ্দেশ। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্কের বাংলা পত্রিকা 'ঠিকানা'র সঙ্গে সম্প্রতি মন খুলে না বলা অনেক কথা বলেছেন জহির রায়হানের স্ত্রী অভিনেত্রী কোহিনূর আক্তার সুচন্দা ও তার বোন ফরিদা আক্তার ববিতা। চলচ্চিত্রে তাদের দু'জনের পথচলা জহির রায়হানের হাত ধরেই। সাক্ষাৎকারটিতে তারা দিয়েছেন জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।
তারই স্ত্রী সুচন্দার মুখ থেকে___
"দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির ছবি তৈরি করার কথা বলে একাই বিশেষ বিমানে বাংলাদেশে চলে আসে। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ভিডিও ক্লিপ ছিল। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রচার করে জহির ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। বাংলাদেশে আসার পর ১৫ দিনের মধ্যে তার কোনো খবর আমরা পাইনি। এদিকে ঘরে খাবার, টাকা-পয়সা নেই। ওই সময় চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবীর আমাদের বেশ সহযোগিতা করেন। একদিন শুনলাম জহিরের বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ভাইকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে আমাদের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। জহির প্রতিদিন তার সহকর্মীদের নিয়ে নানা পরিকল্পনা করত। ওই সময় বাসায় টেলিফোন করে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। জহির আমাদের কিছুই বলত না। আজও তিনি ফিরে আসেননি। তার মৃতদেহও আমরা পাইনি। কাউকে কি সন্দেহ হয় এ প্রশ্নে সুচন্দা বলেন_ বিষয়টি আড়ালে রয়ে গেছে, আমি জহিরকে মনের অন্তরালেই রাখতে চাই। সব কথা সবসময় বলা যায় না। যে বিপদটা তার জীবনে এসেছিল। তিনি প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে এক বক্তব্যে বলেছিলেন, 'যারা এখন বড় বড় কথা বলেন, নিজেদের বড় নেতা মনে করেন_ তাদের কীর্তি-কাহিনী, কলকাতায় কে কি করেছিলেন, তার ডকুমেন্ট আমার কাছে রয়েছে। তাদের মুখোশ আমি খুলে দেব।' এ কথা বলার পরই তার ওপর বিপদ নেমে আসে। একই প্রশ্নের জবাবে ববিতা বলেন, জহির ভাইকে বলা হয়েছিল, তোমার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত আছেন। তার চোখ উৎপাটন করে মিরপুর ১১ নম্বর সেক্টরে একটি বাড়িতে রাখা হয়েছে। তুমি যে তোমার ভাইকে উদ্ধার করতে যাচ্ছ এটা তোমার পরিবারের সদস্যদের বলো না। দিনটি স্মৃতি সম্পর্কে সুচন্দা বলেন, জহির যখন যায় তখনকার দু'তিনটি স্মৃতি আমার মনে এখনো গেঁথে আছে, যেটা কোনোদিনই ভুলার নয়। আমি বুঝতেই পারিনি যে, আমার স্বামীকে হারাতে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল এখনই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে এসে আমাকে ডাকবে_ সুচন্দা দরজা খুল, আমি এসেছি। এভাবেই কেটে গেল অনেক দিন। জহিরকে কে মারবে? এ দেশের সবাই জহির রায়হানকে চেনে। তাকে কারা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল এ সম্পর্কে ববিতা বলেন_ জহির ভাই যেদিন বাসা থেকে বের হয়ে যান সেদিন একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার তার সঙ্গে ছিলেন এবং ওইদিন রাতেই আমাদের বাসায় ডিনার ছিল। তিনিই আমাদের ফোন করে জানান, সরি তোমাদের ডিনারে যাওয়া হচ্ছে না। আমি জহিরের সঙ্গে যাচ্ছি। সুচন্দা বলেন_ ঘটনার দিন সকালে আমাদের বাসায় একজন লোক আসে। তড়িঘড়ি জহির তার সঙ্গে বেরিয়ে যায়। ওইদিন বাংলাদেশে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিস, ওয়াহিদা রহমান, লতা মুঙ্গেশকর এফডিসিতে এসেছিলেন। হাসান ইমাম আমাকে ফোন করে বললেন, ম্যাডাম_ জহির ভাই কোথায়? আমি বললাম জহির বাইরে গেছে। তিনি বললেন, জহির ভাই না হলে তো হবে না। তবে উনি যেহেতু নেই, আপনাকে তো অবশ্যই আসতে হবে। এত বড় বড় শিল্পী এসেছেন আপনি এবং জহির ভাই না এলে কেমন দেখায়? এফডিসি থেকে আসার পর আমি দেখলাম সবাই বসে রয়েছেন। টেলিফোন সেট সামনে। আমি বাসার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম_ তোমাদের মেজদা কোথায়? তারা বলল, মেজদা তো মিরপুর গেছেন, আমাদের সঙ্গে নেননি। উনার তো এখনো কোনো খোঁজ নেই। আমি বললাম, খোঁজ নেই মানে? তারা মিরপুর থানায় মেজর মইন এবং মেজর মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। উনারা জানান, উনিতো অপারেশনে আমাদের পুলিশ এবং আর্মির সঙ্গে ভেতরে ঢুকেছেন; কিন্তু ওখানে একটু গণ্ডগোল ও গোলাগুলি হয়েছে, উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বললাম, উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? তারা আরও জানাল, আমাদের অনেক লোক উন্ডেড হয়েছে, এ কথা বলেই টেলিফোন রেখে দিলেন। পরবর্তীতে আমি মেজর মইন এবং মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তাদের কাছে জানতে চাই_ জহির কোথায় গেল, কীভাবে গেল? উনারা উত্তর দিতে পারেননি। আমি কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। আমি কল্পনাই করতে পারিনি জহির আর ফিরে আসবে না। অনেক খুঁজেও আমরা জহিরকে পাইনি।''
কারা জহির রায়হানের মতো আরো কতোশত বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে লাশ গুমকরে দিয়েছে!!!
তারাই আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরবেশ ধরে সুশীল সমাজের রুপ ধরেছে...
প্রকৃত সত্য গোপন করছে....
জাতি আজ সেই সত্য জানতে চায়....
সূত্র:দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১১:২৫