১.
"আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল,
শুধাইল না কেহ।
সে তো এল না,সে তো এল না
যারে সঁপিলাম এই প্রাণ মন দেহ"
চোখ খুলে দেখলাম ভোর ৬টা বাজে।
উপর তলায় নতুন ভাড়াটে মেয়েটা রোজ সকালে নিত্য নতুন বিরহের গান দিয়ে আমার ঘুম ভাঙায়। তবে অভিমানী গলায় রবীন্দ্রগীতি শুনতে ভালই লাগে!
চুপচাপ শুনি, মেটাল গানে অভ্যস্ত কানে বেশ লাগে। কখনো পুরনো প্রেমিকা কিংবা না পাওয়ার কথা মনে পড়ে চোখে রবীন্দ্র ঢং এ দু'ফোটা জল ও চলে আসে, কি আশ্চর্য!
আমি থাকি পুরান ঢাকার এক দোতলা বিল্ডিং এর নিচতলায়। একরুমের সংসার আমার,ব্যাচেলর মানুষের যা হয়! ছোটখাটো চাকরী আর ইউনিভার্সিটি শেষে উপর তলার মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই! প্রতিদিন সকালের গানটুকু আমার জন্য গাওয়া হচ্ছে ভাবতে আমার বেশ লাগে! আজকাল মেটাল গান শুনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি! কোন এক কারণে মনে হয়,মেটাল গান শুনলে মেয়েটার অভিমান বেড়ে যাবে। এরপর যদি আর গান না গায়!
"আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে
একতারাটির একটি তারে গানের বেদন বইতে নারে,
তোমার সাথে বারে বারে হার মেনেছি এই খেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে.। "
মেয়েটিকে আমি দেখেনি! তবুও সে খুব যতনে আমার চারদিকে সুরের খেলা ছড়িয়ে দিচ্ছে,যে সুরের খেলায় আমি হেরে যাচ্ছি!
কখনো কখনো আমি প্রচন্ড ঘোরে চলে যাই! মেয়েটিকে কল্পনা করি, কখনো অভিমান নিয়ে কখনো বা মৃদু হাসি নিয়ে সে একের পর এক সুরের জাল বুনে যাচ্ছে!
আজকাল আমিও গুণগুণ করে রবীন্দ্র সংগীত গাই,
"ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো
তোমার মনেরও মন্দিরে
আমারও পরাণে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো
তোমার চরণ মঞ্জিরে"
২.
কোন এক শ্রাবণ মাসের বিকেলবেলায় বিধাতা আমার কথা শুনলেন।
আমি ইউনিভার্সিটি শেষে বাসায় ঢুকছিলাম, এক ভদ্রলোক হাতের ইশারায় থামতে বললেন!
- "আমরা উপরতলায় থাকি,বেশ কিছুদিন হলো এসেছি!"
- "জ্বি! "
- "আমার ছোট মেয়েটার আজ জন্মদিন,আপনি আসবেন কিন্তু !"
- "চেষ্টা করবো! "
- "আসলে আমার মেয়ে খুশি হবে, জন্মদিনে তেমন কেউ আসে না"
আমি মনে মনে অভিমানী মেয়েটার অভিমানী চোখদুটোকে কল্পনা করলাম, এরপর বললাম, "আমি আসবো"
সন্ধ্যা ৬টায় আমি সময়মত পৌছে গেলাম, ভদ্রলোক আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন!
ছিমছাম রবীন্দ্র ঢং এ সাজানো বাসা, একপাশে সারি সারি বই আর অন্যপাশে হারমোনিয়াম,তানপুরা।ভদ্রলোকের দুই মেয়ে! স্ত্রী প্রায় ৪ বছর আগে মারা গেছেন!
বড় মেয়েটি চাকরীর কারণে স্বামীর সাথে চট্টগ্রামে,ভদ্রলোক আর ছোট মেয়ে ইন্দ্রানীকে নিয়ে ছোট সংসার !
কথায় কথায় জানলাম,ভদ্রলোকের স্ত্রীর খুব শখ ছিল রবীন্দ্রসংগীত,মেয়ে মায়ের ধারা ধরে রেখেছে!
আমি চুপচাপ অপেক্ষা করছিলাম,হাতে ছিল উপহার হিসেবে ছিল রবীন্দ্র সংগীতের একটি ক্যাসেট! ভয়ে ছিলাম,এই যুগে কেউ ক্যাসেট কিনে না,তবে এখানে এসে বুঝলাম কতিপয় আধুনিকতা ইন্দ্রানী কিংবা তাঁর বাবাকে এখনো স্পর্শ করে নি!
মৃদুভাবে ইন্দ্রানী বললো,"বাবা"
কথা বলার কোন সময় ইন্দ্রানী কখন আমার পিছে এসে দাঁড়ালো আমি টের পাই নি!
ভদ্রলোক উঠে গিয়ে ইন্দ্রানীর হাত ধরে বললেন, " ইন্দ্র চোখে দেখতে পায় না "
আমি ইন্দ্রানীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, চোখদুটোতে ভীষণ অভিমান নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে!
আমার সামনে বসতে বসতে বললো "আপনি আসাতে খুব ভাল লাগলো, গান শুনবেন?"
আমি মৃদুভাবে হ্যা বললাম,
ইন্দ্রানী চোখদুটো বন্ধ করে গাওয়া শুরু করলো,
"বধু কোন আলো লাগলো চোখে
বুঝি দীপ্তি রূপে ছিলে সুর্যলোকে
বধু কোন আলো লাগলো চোখে
ছিল মন তোমারই প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি
ছিল মর্ম বেদনা ঘন অন্ধকারে
জনম জনম গেল বিরহ শোকে
বধু কোন আলো লাগলো চোখে ...."
আমি ইন্দ্রানীর চোখে জল দেখতে পেলাম। অভিমানী মেয়েটার অভিমানের উৎস খুঁজে পেতে আমার কষ্ট হলো না!
এভাবেই এক সন্ধ্যায় আমি এভাবেই অভিমানী এই রবীন্দ্রপ্রেমী মেয়েটিকে ভালবেসে ফেললাম,
"মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দরবেশে এসেছ,
তোমায় করি গো নমস্কার।
মোর অন্ধকারের অন্তরে তুমি হেসেছ,
তোমায় করি গো নমস্কার ....."
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ২:০২