কতক্ষণ যাবৎ অন্ধকার ঘরটায় শুয়ে আছি বলতে পারবো না। সোডিয়াম বাতির মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে ! একটা বিচিত্র গন্ধ চারদিকে,খুব সম্ভবত ফরমালিনের।
সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো,আমার শীত লাগছে। আমার মনে আছে,এখন শীতকাল না। সবথেকে বড় কথা আমি মৃত ! মৃত মানুষের অনুভূতি থাকে না,কিন্তু আমার আছে এবং তা খুবই বিচিত্র !
ঘরের শেষ কোণা থেকে নিকোটিনের তীব্র গন্ধ আসছে। মজার ব্যাপার হলো,এই অবস্থাতেও আমার নিকোটিনের তীব্র অভাব বোধ হচ্ছে ।
-" শালার জীবন,এই রাতে মরার ঘরে ডিউটি দিতে হইতেছে!"
- "ব্যাটা মইরাও শান্তি দিলো না "
আমি কান পেতে ঘরের শেষ কোণায় বসা লোক দুটোর কথা শুনার চেষ্টা করছি। যদিও আমার মস্তিষ্কের অনুভূতির অংশটুকু এখনো সচল কিন্তু মনে রাখার অংশটুকু অচল হয়ে গেছে।
ফরমালিনের এই ঘরে কিভাবে আসলাম এটা আমার কাছে রহস্য !
- "চা খাবি?"
চা..আমার আবার চা এর তৃষ্ণা পেলো ! কার হাতের চা যেন আমার ভীষণ প্রিয় ছিল।
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম।
- " এই মরাডারে ফালায়ে কেমনে যামু? শিয়ালে নিয়া যাইবো ! "
আমার নিজের উপর রাগ হলো,মারা যাবার পরও শান্তি দিচ্ছি না।
শান্তি! হ্যা মনে পড়েছে, আম্মা এই কথা বলতো !
আব্বাকে বিয়ে করে আম্মা শান্তি পায় নি কোনদিন। বকুলের জন্মের পর আম্মা আত্মহত্যা করে। বকুল আমার ছোট বোন।
যাক,কিছু মনে পড়েছে!
বকুল কে নিজের হাতে বড় করে ছিলাম।আব্বা ছিলেন প্রচন্ড উদাসীন। প্রায় সময়ই তার চাকরী চলে যেতো,আর আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো ! বকুলকে দু টাকার আচার টা কিনে দিলেই খুশি হয়ে যেতো ! সে আচারটুকুও অনেক সময় নিয়ে খেত যাতে আবার ক্ষুধা না লাগে। অল্প বয়সেই মেয়েটা কত বুঝতো।
বকুলের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম। নাহ,মস্তিষ্ক এখনো পুরোপুরি সচল না। তবে রুমের আলোটা উজ্জ্বল লাগছে আগের থেকে। চোখ খুলে মারা যাবার এই সুবিধা,সব দেখা যায়।
লোক দুটোর একজন এখন খুব বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
- " মরছে কেমনে?"
- "বিপক্ষদলের গুলি খাইছে মাথায়।"
আমি আমার মনে করতে না পারার কারণ বুঝতে পেলাম।
কিন্তু বিপক্ষদল বলতে কি বুঝানো হচ্ছে,তা বোঝানোর জন্য কান দিয়ে রাখলাম।
- "হের নামে বহুত মামলা আছে,এমন খারাপ কাম নাই যা করে নাই।"
-" হারাজীবন মানুষ মাইরা হারামজাদা এখন শান্তিতে ঘুমায় আছে"
আমি শুনছিলাম আর আমার গল্প আমার কাছেই স্পষ্ট হচ্ছিলো।
প্রচন্ড অভাবে আমি জীবন পার করেছি। মা মারা গেলেন,বোনটাকে বিয়ে দেবারও সামর্থ্য ছিল না বাবার।
খাবারের জন্য এমন কিছু নাই যা করি নাই।
বাবাকে ভালবাসতাম প্রচন্ড,সাথে সাথে ঘৃণাও কাজ করতো।
তার একটা লাল ডাইরী ছিল। বিকালে তার একমাত্র কাজ ছিল, লাল ডাইরীতে লেখা উপদেশ বাণীগুলা আমাদের মুখস্থ করানো।
খিদা পেটে নিয়ে আমরা দু ভাইবোন দুলতে দুলতে মুখস্থ করতাম।
- সদা সত্য কথা বলিব
-জীবে দয়া করিবো
-সৎ পথে চলিবো
কোনটাই মানতে পারি নি। বাবা মারা যাবার পরপরই লাল ডাইরী পুড়িয়ে কাসেম চাচার দোকানে চুরি করতে গিয়েছিলাম।
লোকদুটা এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখের দিকে আমি মৃত চোখে তাকিয়ে আছি।
"মানুষ মারার সময় চোক্ষের দিকে চাইস না,মায়ায় পড়বি। চোক্ষের মাঝে যাদু আছে।" - নুরুল ভাইয়ের এই কথাটা আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে ছিলাম।
আমার মৃত মস্তিষ্কে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। কেউ আমার চোখ দুটো বন্ধ করে দিচ্ছে না কেন !
মৃত মানুষের চোখ খোলা রাখতে নেই !
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৫ রাত ১:২২