পর্ব ১ঃ
ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরেই পিছে পিছে হাঁটছে। আমি মানা করতে পারি নি।ছেলেটার মাতাল চোখের দিকে তাকালে আমার কিছুটা ভয়ই লাগে।তবুও একবার যা তাকালাম,কিন্তু কিছু বলতে পারি নি।
সামনের মোড়টা পার হলেই সফুরের চা দোকান।ছেলেটার গন্তব্য অতটুকুই এর বেশি সে কোনদিন আগায় না।প্রথমে প্রথমে আমার ভয় করতো! মাতাল চোখের একটা উঠতি বয়সের ছেলের এলোমেলো হাঁটাকে আমি গ্রহণ করতে পারতাম না । কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।মজার ব্যাপার হলো,আমি কখনো তাকে জিজ্ঞাসা করি নি কেন সে পিছে পিছে আসে।আমি বড্ড ভিতু! সত্যি হলো যে,মাঝরাতের এই মাতাল সঙ্গটা আমার খুব একটা খারাপ লাগে না!
আমার নাম না হয় এই গল্পে আর নাই বা বললাম। নিম্নবিত্ত, আবেগপ্রবণ মেয়েরা কখনো গল্পের নায়িকা হয়ে ওঠে না। আমার ভুমিকা পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে! এই চরিত্র ভিটেমাটিহীন দরিদ্র পরিবারের প্রতিনিধি! পেটের দায়ে কিংবা ভাগ্যের দায়ে শহরে এসেছি। গভীর রাত পর্যন্ত অভারটাইম করে যা জোটে তা এই মাতাল ছেলেটা থেকে বেশি কিছু না ! লাল চুড়ি পড়ে মেলা ঘুরবার শখ তখন পায়ের ছিঁড়া জুতাজোড়ার নিচে চাপা পড়ে যায়। যাক গে সে কথা..যা বলছিলাম,হ্যাঁ ছেলেটা! ছেলেটা বড় অদ্ভুত! অদ্ভুত বলার কারণ,খুব সম্ভবত তার অনুভুতি ভোঁতা! নেশায় ঢুলুঢুলু চোখে সে যখন আমার পিছে পিছে এলোমেলো পা ফেলে,তার আচরনে আমি কোন কামনা দেখি না। দুই বছরের শহরে জীবনে কাছের কিছু মানুষ থেকে এমন কিছু আচরণ পেয়েছিলাম যে সব পুরুষকেই আমার নোংরা লাগতো ! আমি তাদের চোখে শুধু কামনা দেখেছি! কিন্তু এই ছেলেটা আমার চিন্তায় পরিবর্তন এনেছে।মাঝেরাতে সে যখন পিছে পিছে আমার ছায়ার সাথে ছায়া মিলিয়ে হাটে আমি তখন নিজেকে বড় নিরাপদ মনে করি।
ল্যাম্পপোষ্টের হলদে আলোতে তাকে দেখতে বড় মায়াবী লাগে।তার বড় বড় দুটো চোখ, ঢুলুঢুলু চাহনি, ময়লা প্যান্ট আর এলোমেলো চুলে তাকে বড্ড বেশি আপন মনে হয় !
ছেলেটা বড় রহস্যময়! মাঝরাতে সে পিছে পিছে হাটে কিন্তু কোন মানুষ আশেপাশে আসলেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! তাই তার গন্তব্য মোড়ের ল্যাম্পপোষ্ট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে!
আমার মত ছাপোষা মেয়েদের হয়তো ভালবাসতে নেই।কিন্তু সত্য হল কি,যতবারই আমি ছেলেটাকে দেখি আমার ভালবাসার শখ জাগে!
ছোটবেলায় পুকুরে পানি আনতে যাবার সময় আনিস ভাইও এভাবে আমার পিছে পিছে আসতো।আনিস ভাই খুব কম কথা বলতো! কথা বলার ভার আমার কাধেই বেশি ছিল! একদিন কথায় কথায় আনিস ভাই আমার হাত চেপে ধরেছিল। ভয় পেয়েছিলাম,নিজেকে হারানোর ভয়! এরপর অনেকদিন আনিস ভাইয়ের সাথে দেখা হয় নি
শুনেছি স্ত্রিসহ ঢাকায় আছেন।মাঝেমধ্যে আনিস ভাইয়ের মত আমারো ছেলেটার হাত ধরতে ইচ্ছা হয়! এরপর ছেলেটা কি করবে? ভয় পাবে?
পর্ব ২ঃ
আমার ছোট একরুমের ঘরটাতে আলো ঢুকে না। না চাঁদের আলো না দিনের আলো। মাঝেমধ্যে আমার ভিতরে একটু আলোর জন্য প্রচন্ড হতাশার সৃষ্টি হয়! আমার মত মেয়েদের জন্য হয়তো এতো আলো বাতাসের বিলাসিতা করা উচিৎ না।কিন্তু দিনের পর দিন ঝুপড়ি ঘরে বসে থাকলে অন্ধ উইপোকাও এক সময় আলো খোঁজে।
হ্যা,গত এক বছর যাবৎ আমি নিজেকে একঘরে করে রেখেছি।খুব প্রয়োজন ছাড়া আমি বের হই না।আমার জীবন কিভাবে চলছে সে সম্পর্কে আমার নিজেরেও কোন ধারণা নেই।শুধু এইটুক জানি,আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি !
আমাকে আর ল্যাম্পপোষ্টের আলোর নিচে ছেলেটাকে খুঁজতে যেতে হয় না।সেই ছেলেটা যাকে আমি অজান্তেই সবটুকু ভালবাসা দিয়েছিলাম,সেই ছেলেটা প্রায়ই আমার অন্ধকার ঘরটাতে আসে।আমার কেন জানি মনে হয়,সে ঝাপসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।এতটাই মমতা যা কাছের মানুষ থাকি আমি পাই নি।
আজও আমি ছেলেটার নাম জানি না! তবে দিনের আলোতে তাকে দেখার সুপ্ত ইচ্ছা পুরন হয়েছে,যার ফলে আজকে আমি একঘরে!
সবার মতে,ছেলেটার কোন অস্তিত্ব নেই। দিনের আলোতে কেউ আমাকে দূর থেকে লক্ষ্য করে না কিংবা চাঁদের আলোতে কেউ আমার পিছু নেয় না! যে ছেলেটাকে আমি দিনের পর দিন ভালবেসেছি তার অস্তিত্ব নেই, এটাই বা আমি কিভাবে মেনে নিবো? এরপর অনেক ভেবে নিজেকে একঘরে করে ফেলেছি!
খুব যে কষ্টে আছি তা কিন্তু নয়! শুধু মাঝেমধ্যে মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হয়।যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকি।ছেলেটা তখন মাথায় উষ্ণ হাত বুলিয়ে দেয়!
আমি জানি,এভাবেই একদিন আমার মৃত্যু হবে! সত্য হল,এতে আমার খুব একটা খারাপ লাগে না।যে ভালবাসা আমি এপাড়ে পরিপূর্ণভাবে পাইনি হয়তো সেই ভালবাসা আমি ওপাড়ে পুরোটাই পাবো!
সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিকে আমাদের নিয়ে খেলা করার আলাদা ক্ষমতা দিয়েছেন।কেও কেও বলে,আমি সেই খেলার শিকার! আমি তা মানি না।গভীর রাতে আমার প্রায়ই মনে হয়, এটাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত এবং তখনই ছেলেটা আমার পাশে এসে বসে...তখন পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে খেলা লাগে না!
ছেলেটার গায়ে তিব্র কাঁঠালচাঁপার গন্ধ করে।এই গন্ধ আমার আমার ভীষণ প্রিয়। ছোটবেলায় শুধু এই গন্ধের লোভেই শিমুদের বাড়ি ফুল কুড়োতে যেতাম। কাঁঠালচাঁপার সাদার মাঝে হলদে রংটা আমার অদ্ভুত ভাল লাগতো। মাঝরাতে যখন ছেলেটার শরীরে আমি পুরানো সেই গন্ধটা খুঁজে পাই,আমার ভালবাসতে ইচ্ছা হয়!
ছোটবেলায় শিমুদের টিভিতে দেখা সেই নায়িকার মত আমারো তাকে জরিয়ে ধরবার ইচ্ছা হয়! কিন্তু সত্য হল যে,নিম্নবিত্ত মেয়েরা কখনো গল্পের নায়িকা হয়ে ওঠে না ।
তীব্র কাঁঠালচাঁপার গন্ধ এখনো আমার পাশে তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছে।মাথার যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে।আমি চাই,আজ যেন এই যন্ত্রণা আমাকে আর আমার সুপ্ত যন্ত্রনাগুলোকে ছাড়িয়ে যায়।আজ রাতে আমি আবার তার উষ্ণ হাত চাই..আমি চাই,সে যেন আমাকে আজ তার সবটুকু মমতা দিয়ে যায়!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২৪