আমি ফুলস্টপ। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন; সেই ফুলস্টপ যার আকার নাই, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ-ক্ষেত্রফল কিছুই নেই শুধু অবস্থান আছে মাত্র। অবস্থান তাও সবার শেষে! কতগুলো সরল লাইন, নিরপেক্ষ ঘটনা আর গতানুগতিক ঘটনার বর্ণনার পর আমি জুড়ে বসি। আমি নেহাতই অপ্রয়োজনীয়। আনন্দ বা দুঃখের শেষে বিস্ময়চিহ্ন জায়গা করে নিয়েছে, প্রশ্নের শেষে প্রশ্নবোধক। তাই বলতে পারেন আমি জিজ্ঞাসাহীন, অনুভূতিহীন এক বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নই। আমার প্রয়োজনীয়তা বাক্যের অবসানে, সমাপ্তিতে আর ঘটনা বর্ণনায় মুহূর্তের বিশ্রামে। আমি আসলে একটা একাকী প্লাটফর্মের মতো যেখানে মানুষ আর ট্রেন আসে আর তারপর খানিক দাঁড়িয়ে চলে যায়। আমি পড়ে থাকি কারো ভ্রমনের শুরুর সাক্ষী হয়ে আবার কারো ভ্রমনের শেষ হয়ে। গতিশীল মানুষ আর তার রচনায় আমি যে প্রান্তীয় অবস্থানে ছিলাম এখনো সেখানেই আছি, আর ভবিষ্যতেও সেখানেই থাকবো। রাস্তার পাশের পড়ে থাকা মাইলস্টোনগুলোও আমার চেয়ে অনেক বেশি তথ্যদায়ী কারন তারা জানাতে পারে চূড়ান্ত গন্তব্যের দূরত্ব; আর আমি? বলতে পারিনা শেষ শেষের ঠিকানা শুধু বাক্যের শেষে বসে তাকে শেষ করি। অত্যন্ত একঘেঁয়ে রকম সংখ্যাধিক্য নিয়ে আমি রচনায় সংখ্যাগুরু কিন্তু গনতান্ত্রিক রচনার বিন্যাসে আমার গুরুত্ব আমার অবস্থান পরিমান। আমার সময় কাল এক সেকেন্ড কিন্তু মানুষ তাও মানতে নারাজ। আইবুড়ো মেয়ের বাপের মতো সেও আমার বয়স কমিয়ে দিতে সদা তৎপর! যদি বোঝে ভুল জায়গায় পড়েছি তো সাথে সাথেই আমার একটা লেজ লাগিয়ে কমা বানিয়ে দেয়। বিরাম মহলে কানাঘুঁষা চলে আমার আর কমার মাঝে অস্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে। তারা প্রায়ই বলে কমা আসলে একটা শাড়ি পড়া মেয়ে ফুলস্টপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ওদের কি করে বুঝাই যে কমার ক্ষমতা আমার চেয়ে কত্ত বেশি! উদ্ধরণের প্রয়োজনে সে উদ্ধ্বতভাবে বাক্যের মাথায় চেপে বসতে পারে। একই বাক্যে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারে একাধিকবার। লোকে যা বলে বলুক। আসলে তো সে সর্বচারিনী, সর্বস্যগামিনী, বাক্যেশ্বরী। আমি বামুন মানুষ, ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের আলোতেও আমার চোখ ঝলসায়; চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর আত্মঘাতী বিলাসীতা আমাকে মানায়না।
কমা আমায় ক্ষমা করো। একসাথে চলা মানেই ভালোবাসা না।
আমি বিন্দু। ভালোবাসার অনুভূতিহীন বিন্দু। তাইতো অনুভুতি প্লাবিত কবিতাতে আমাকে খুব একটা দেখা যায়না কারন সেখানে লাইনগুলো কেমন শেষ হয়েও হয়না! রেললাইনের মতো কিছু অনুভুতি চলতে থাকে কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করেনা। অনেকদিন ভেবেছি আমার কি কোন শেষ নেই? কেঊ কি আমার সমাপ্তি টানবেনা কোন দিন? সমাপ্তি আর অবসানের এই অফুরান বোঝা কি শুধু আমাকেই ব’য়ে বেড়াতে হবে আজীবন? হয়তো তাই! শেষের জন্যই হয়তো আমার শুরু! তবে সেদিন ঘটলো এক দারুন ঘটনা! চার-পাঁচ বছরের এক বাচ্চা মেয়ে তার খাতায় অনেক করে আঁকলো আমাকে। তারপর খাতাটা নিয়ে গেলো তার মা’র কাছে! গিয়ে বললো-“মা দেখো, আমার তারার ছবি। এর মধ্যে বাবা কোনটা? আমাকে দেখাও আমি তাকে বাড়ি আসতে বলবো, আমাদের কাছে। আমি ডাকলে বাবা আসবেনা মা”? প্রথমে খুব খুশী হয়েছিলাম যে আমি নক্ষত্রও হতে পারি ভেবে। কিন্তু পরে মনে মনে ভেবেছি- ‘ইশ! যদি প্রতিটি সরল বাক্যের মতো করে এই ছোট্ট মেয়েটার অপেক্ষারও অবসান করতে পারতাম’! কিন্তু আমার এই আক্ষেপ আমি সচেতন ভাবে লুকিয়ে রেখেছি। পাছে অনুভূতির অজুহাতে একটা দখলদার বিস্ময়চিহ্ন আমার জায়গা কেড়ে নেয়! আমি এখন খুকীর আকাশের ঠিকানা, তারা হয়েও বাঁচতে পারি! খুকীর খাতা-ই আমার স্বর্গ। আমার অনুভুতিহীন অবস্থান মাত্রের জীবন আজ স্বার্থক।
------------------ ০৫ অক্টোবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়