দশ মিনিটের এই সিনেমা আমার কাছে এককথায় অসাধারন, দুর্দান্ত! এটা একটা অন্য রকম বাঁচার গল্প। প্রাত্যহিকতার খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে একটু অন্যের হয়ে বেঁচে থাকার গল্প। অনেক সময় অনেক সামান্য অবলম্বনে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার এবং অন্যকে তার সত্যিকারের নিজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার গল্প হলো- “First Flight”.
একজন প্রফেসর তার পথ ধরে হাঁটছিলেন কর্মস্থলে যাবেন বলে। রাস্তার মাঝখানে এসে তিনি তার বাস দেখতে পান এবং দৌড়াতে থাকেন বাসে উঠবেন বলে। কিন্তু বাস তাকে রেখেই চলে যায়। খানিকটা হতাশা আর অনেকটা বিরিক্তি নিয়েই তিনি বসে থাকেন রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চিতে। তিন একজন পারফেক্সনিস্ট। তার ব্রিফকেস সোজা থাকে, তিনি নিজেও সোজা হয়ে বসে থাকেন। পৃথিবীর যে অবিরাম গতি একমনে নির্দিষ্ট সময় পর বয়ে আনে এক একেকটি দিন-রাত, ঋতু তাতে তিনি কোন বাধা দেননা। তিনি সময়-কাল-স্থান ভেদে আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট পার্সন।
ধুপ—প—প—প—প--!!!!!!!!!
কোত্থেকে একটা নীল রং-এর পাখির ছানা এসে পড়লো বেঞ্চে। বড় বড় চোখের সেই পাখির বাচ্চা শুধু ডাকতে পারে কিন্তু ডানা থাকতেও সে ঊড়তে পারেনা। প্রফেসর সাহেব বিরক্ত হন খানিকটা পাখিটাকে দেখে। মনে প্রাণে চান পাখির ছানা-টাকে অবজ্ঞা করতে। ব্রিফকেস দিয়ে তার আর নিজের মধ্যে তুলে দেন চীনের প্রাচীর। তার পর ধুপ করে ব্রিফকেস প’ড়ে গেলে ভয়ে ভয়ে তুলে দেখেন ছানাটা চ্যাপ্টা হয়ে গেলো কিনা! না! তাকে অবাক করে দিয়ে তার কানের পাশে ট্যাও ট্যাও করে ডেকে ওঠে সেই নীল পাখির ছানা। এরই মধ্যে প্রফেসর সাহেবের কলম লিক করে তার সাদা শার্টে লেপ্টে গেছে নীল কালি। প্রফেসর এই প্রথম মুখোমুখি হন পাখির ছানাটির। কলমের উপর তাকে বসিয়ে দেখেন তার নীল শরীর, বড় চোখ, পিচ্চি লেজ। খেয়াল বশে পাখির মতো শিষ দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বেশ কয়বার। কিন্তু যেহেতু তিনি একজন পারফেকসনিস্ট এবং জীবন তার কাছে গণিতের সূত্রের মতই যুথবদ্ধ তাই পাখির ছানাটির গুটানো, অব্যবহৃত ডানা তার নজর এড়ায়না। তাকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সে পাখি তাকে উড়তে হবে। ব্রিফকেসে থাকা একটা কাগজ দিয়ে তিনি তৈরী করেন কাগজের প্লেন আর উড়িয়ে দিয়ে দেখান পাখির ছানাটিকে যে তাকেও এভাবেই উড়ে যেতে হবে দূরে, বহুদূরে; অনন্ত আকাশের মাঝে। কিন্তু কাগজের প্লেনেরও শেষ পরিণতি তার বা ছানাটির চোখ এড়ায় না যখন সেটা ঝুপ করে নেমে এসে রাস্তার মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আর তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় বয়ে চলা গাড়ির হাওয়া। পাখির ছানাটি সাথে সাথে বেঞ্চ থেকে প’ড়ে যাওয়ার অভিনয় করে বুঝিয়ে দেয় যে তাকে ছাড়া তারও পরিণাম হবে ঐ কাগজের অরিগ্যামির মতোই। প্রফেসর সাহেব তখন দ্বিধার দোলনায় দুলছেন। একদিকে তার রুটিন কাজ, সময়ের গাড়ি, ব্রিফকেসে ভ’রে রাখা গাণিতিক সূত্র আর জ্যামিতিক নকশা আর অন্য দিকে মুহূর্তের পরিচিত এক পাখির ওড়ার স্বপ্ন। কোনটায় আজ সাড়া দেবেন তিনি? নিজেকে ভুলে উনি কি মেতে উঠবেন আজ এই ছেলেমানুষি খামখেয়ালে? কি হবে তার কাজের? তার বাস, তার প্রতিদিনের নিয়মবদ্ধ জীবন?
ভাবতে ভাবতে বাস চলে আসে। হাতে ব্রিফকেস নিয়ে বাসেও উঠে পড়েন তিনি। পেছনে তখন তার ক্ষণিকের বন্ধু আর তার না ঊড়তে শিখার গল্প। বড় বড় চোখ করে যেন সে তার কাছে মিনতি করছিলো থেকে যাবার জন্য। তার সে চোখের ডাক ফেলতে পারেননি প্রফেসর। রুটিনের শেঁকল ভেঙ্গে নেমে পড়েছেন বাস থেকে আর মুখে নীল কালি লাগিয়ে বলেছেন- “চলো, তোমার জন্য আমিও না হয় পাখি হলাম এই বেলা”। নিজের দুহাত তুলে পাখির ছানাটিকে বলেছেন তার ডানা মেলে ধরার জন্য। পাখিকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে শূণ্যে ঘুরিয়েছেন কিছুক্ষণ। আর তারপর তার হাত ফসকে যখন শূণ্যে পড়েছে পাখির ছানা তখন অবাক হয়ে দেখেছেন তার উড়তে শেখা, মুক্তির আনন্দ; খুঁজে পেয়েছেন স্বাধীনতার নিঃসীম সীমারেখা। যে জীবন তিনি এইমাত্র দিয়েছেন পাখির ছানাটিকে তা মুহূর্তে ভর করে তার নিজের জীবনেও। তিনি বুঝতে পারেন তার নিজের জীবনটাও তো আসলে সেই পাখির ছানাটির-ই মতো। প্রাত্যহিকতার শৃংখলে তার নিজের ডানা বদ্ধ ছিলো এতকাল। শুধুমাত্র নিজের জন্য বেঁচে বেঁচে, এক সময়ে একই বাস ধরে যাতায়াত করে করে তার অন্যভাবে বেঁচে থাকার যে ভাবনা তা এতোদিন হয়তো বন্ধক ছিলো ঐ ছোট্ট পাখিটির ডানায়, বাসস্টপের বেঞ্চে আর তার পাশের ফুলের গাছে। তিনি নিজে নিজেকে চিনতে পারেননি এতোদিন যেমন পাখি হয়েও সেই পাখির ছানাটি উড়তে পারেনি একা একা; তাকে যখন তিনি ওড়ালেন তখন নিজেকেও খুঁজে পেলেন এক অন্য মানুষ হিসেবে অথবা একটা পাখি হিসেবে। ব্রিফকেস থেকে সব নিয়মের সূত্র বাতাসে উড়িয়ে তিনিও চোখ বুঁজে দুহাত নাড়িয়ে উড়তে লাগলেন সকল পারফেকশনের নীরব নিয়ম ভেঙ্গে। তিনি বুঝলেন বাঁচতে হবে সবাইকে নিয়ে। নিজের মুক্তি; সেটা হয়তো লিখা আছে অন্য করো আনন্দের মাঝে। থেকে থেকে একজন অন্যের জয়ে অনেক বেশী জয়ী; তার প্রাপ্তি হয়তো আকাশছোঁয়া!
সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় রাস্তায় খোলা প’ড়ে আছে প্রফেসর সাহেবের সেই পুরোনো ব্রিফকেস। ভেতরের কাগজ আর সূত্রকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। আর তার সেই ব্রিফকেসের উপর ধীরে ধীরে এসে পড়ছে একটা নীল রঙ এর ঝরা পালক। হয়তো পাখি আর প্রফেসর দুজনেই তাদের পরাধীন, একঘেঁয়ে জীবনের শেষ নিদর্শন অর্ঘ্য দিয়ে গেলো চেনা রাস্তাকে যে রাস্তার পাশে তারা দুজনেই পেয়েছিলো মুক্তির স্বাদ।।
এজন্যই আমি মানুষকে পাখি ভাবতে পছন্দ করি।