মন খারাপ করে ভাবছি যে আমাকে হল ছেড়েই দিতে হবে। মাকড়সার জালটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তাতে ধুলো পড়ে এমনই অবস্থা যে সকালবেলা চোখ খুললেই দেখি পরাক্রমশালী সূর্য্যদেবতার অস্তিত্ত্ব সে জালে চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে। ও জালের ছায়া মুখে নিয়েই ঘুম ভাঙ্গে আমার। ‘কেহেরমান’- নাম দিয়েছি মাকড়সা টার, তার গার্লফ্রেন্ড সারারা গুল কে নিয়ে কোন রকম গোল না করে জালের উপর বসে কোয়ান্টামের মেডিটেশন করছে। আর তাদের বাচ্চা গুলো দুর্ধর্ষ প্যারাট্রুপারের মতো বাতাসে ভর করে নামছে আমার সাধের কনভোকেশন হ্যাটে। আমি ওদের সংসার ভাঙ্গিনি, কোন দিন তছনছ করিনি এদের তন্তুজ এপার্টমেন্ট! তার বদলে প্রতি সন্ধ্যায় ওরা আমাকে জ্বালাতন করা কয়টা মশাকে জালে আটকায় আর শাস্তি দেয় যাবতজীবন কারাদণ্ডের। গত কয়েক বছর ধরে দেখছি ওদের ভরা সংসার।
আমার জানলার সবুজ রঙ এখন ধূলো আর মরিচা মিলে ধূলোট লাল। জানলাটার নাম দিয়েছি ‘আকাশের বায়োস্কোপ’। পাঁচটা বছর ধরে নীল, সাদা, লাল, হলুদ, কালো, ছাই রঙ আকাশ দেখিয়ে চলেছে সে আমাকে। দিনে পাখি, কাঁচা-পাকা বড়ই, তণ্বী সজনে ডাঁটা, পুরুষ পায়রার অহংকার আর রাতে তারা ঝকমকে অন্ধকার, ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা একটা চাঁদ, ল্যাম্পপোস্টের বিষাদগ্রস্থ সোডিয়াম বাতি এবং একটা পথ ভোলা জোনাকীর উদ্ভ্রান্ত ছোটাছুটি দেখিয়েছে সে।
আমার চারকোণা পৃথিবী; ভালোবাসা হারানোর পর কে জানি পাকা রেজিস্ট্রী করে লিখে দিয়েছিলো আমাকে এই পয়ত্রিশ স্কয়ার ফিটের আকাশটা।
রোজ সকাল আট-টায় সবুজ আসে। নিখুঁত লিপস্টিক দেয়া ঠোঁটে পরিপাটি বেশভুষা। শাড়ির সবুজ জমিনের পাড়ে হালকা নীলের ছটা। সবুজ একটা টিয়া। বকফুলের মৌসুমে রোজ সকাল আট-টায় নিয়ম করে চলে আসতো আমার জানলার পাশের বকফুলের ডালে। ঠোঁটে ছিঁড়তো বকফুল তারপর দু’পায়ে ধরে ঠোঁট দিয়ে চিরে ফেলতো পাঁপড়ি আর খুঁটে খুঁটে খেতো শাঁসালো গর্ভাশয়ের অংশটা। শালিকের সাথে মিলে মিশে চেঁচাতো সমাল তালে আর জানিয়ে দিতো- ‘রাস্তা মাপো, এখানে সুবিধা হবেনা’। একটু পরে উড়ে যেতো কোন পরিচিত ঝাঁকের সাথে। সে ছিলো নিতান্তই আমার অতিথি। প্রথম দিনে ক্যামেরায় ধরতে পারিনি। দ্বিতীয়-তৃতীয় দিনেও না। দিনে দিনে যখন বুঝেছে যে আমি স্রেফ খাঁচাবন্দী এক মানুষ তখন তার শখ হয়েছে কোন ফরাসী মডেল হবার। উদ্ধত পোজ দিয়ে মনে মনে বলেছে-“ আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে ”? চড়ুই গুলো সদাব্যস্ত। আমি মুড়ি ছিটালেই ইমার্জেন্সী ল্যান্ডিং করে ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে নিচ্ছে সাদা মুক্তোর মতো মুড়ির দানা। ওদের ব্যস্ত ঘাড় নাড়াই বলে দিচ্ছে খাওয়ার ব্যাপারে ওরা কতটা সিরিয়াস!
১২; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পঞ্চাশ জনের একটা বিশাল গনরুমে আমার বেড নম্বর। অমসৃণ চুন টানা দেয়ালে খুবই অযত্নে লেখা এই ১২ সংখ্যাটি-ই এতোদিন ছিলো আমার ঠিকানা। গত পাঁচ বছর এই রুমের উড়ে বেড়ানো ধুলোর সাথে আমি বড় হয়েছি। আমার চিন্তা-চেতনা-ভাবনা সব কিছুর সাথে জড়িয়ে আছে এই রুম। জীবনের অনেক ভালো লাগা, খারাপ লাগা সময়ের সাক্ষী এই রুমের প্রতিটা জীব আর জড়। অনেক কাঁচা স্বপ্নকে আমি তারে ঝুলিয়ে রেখেছি আমার ভেজা গামছার পাশে। অনেক স্বপ্নই শুকিয়ে ঝুপ করে পড়ে গেছে আমার অজান্তেই। কতগুলো কবিতার জন্ম হয়েছে যে এইখানে তা শুধু আমি-ই জানি!
আসল কথা এই যে আমাকে এসব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। ফ্লোরে পেতে রাখা আপাত নশ্বর ধূলোময় কার্পেট-টাও আমার চেয়ে বেশি দিন টিকে যাবে এই রুমে। কারন আমাকে যে যেতেই হবে! সময় আমাকে থাকতে দেবেনা। ভিন্নচিন্তার প্রেমিকার মতো সেও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে- “ আই থিংক, ইটস নট ওয়ার্কিং এনি মোর ”। তাই শুভবিদায়। শিঘ্রী আমার জায়গা দখল করে নেবে অন্যকেউ। তাকেও মুগ্ধ করবে কেহেরমানের সংসার, চৌকোণা আকাশ, দিগভ্রান্ত একক জোনাকি বা পূর্বসুরীর ধূসর মানচিত্র। সেও হয়তো অনুভব করবে জানালার মোহ, আমারই মতো। “তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি”; আমি ফিরে ফিরে আসবো অন্য কেউ হয়ে। আমার মতো অনেকেই লিখে যাবে একটা অসাধারন সময়ের কথা। প্রাকৃতিক বিদায় নাকি এমনই হয়! তবে তাই হোক।।