ব্ল্যাক হোল থেকে কোন কিছু বের হতে পারে না, এমনকি লাইটও। এটাই চিরায়ত পদার্থবিদ্যার স্বীকার্য। তবে এই নীতিকে আর মানতে পারছেন না গবেষকরা, যাদের কাতারে প্রথমে আছেন " ব্রিটিশ পদার্থবিদ প্রোফেসর স্টিফেন হকিং ( Stephen Hawking), এই তত্ত্বকে আরও শক্তিশালী করেছেন মার্কিন পদার্থবিদ " এডওয়ার্ড উইটেন (Edward Witten)"।
ব্লাক হোলের প্রাথমিক ধারনা সম্পর্কে জানতে আমার আগের পোস্টটি কষ্ট করে পড়ার দরকার নেই, এখানেই আবার পুরোটা তুলে দিলাম।
ব্ল্যাক হোল কি?
এমন কিছু তারকা বা নক্ষত্র আছে, যাদের অস্বাভাবিক আকার, ভর ও ঘনত্ব থাকে, আর এর জন্যে এই সব তারকা থেকে নির্গত আলো বাইরে আসতে পারে না বলে তারকা টি কে কালো দেখায় বলে আমরা একে কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল বলে চিনি।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে - যখন একটি তারকার জীবনকাল শেষ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার অভিকর্ষ শক্তি এতই প্রবল হয় যে আলো ওখান থেকে বের হতে পারে না। এই অভিকর্ষীয় শক্তির প্রভাবে বস্তু বা ম্যাটার অই জায়গায় খুব সংকুচিত হয়ে একটি ক্ষুদ্র ভাবে অবস্থান করে!
পবিত্র কুরআন বলে- " فَإِذَا النُّجُومُ طُمِسَتْ"
- "অতঃপর যখন নক্ষত্রসমূহ আলোহীন হবে/ হয়ে পড়বে - Then when the stars will lose their lights"
- [আল - কুরআন- সূরা ৭৭; ৮]
আর এই ঘটনা তখনই ঘটে যখন একটি তারকার জীবন কাল অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। অস্বাভাবিক রকম ভরের কারনে মহাশূন্যে টিকে থাকতে তাকে অনেক বেশি উজ্জল হতে হয়, যার ফলে তার আভ্যন্তরীণ হাইড্রোজেন জ্বালানিও দ্রুত ফুরিয়ে যায়- আর এই ঔজ্জল্যতা কে আল কুরআন এ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-
* وَالسَّمَاء وَالطَّارِقِ * وَمَا أَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ * النَّجْمُ الثَّاقِبُ *
- * [s u]শপথ আকাশের এবং রাত্রিতে আগমনকারীর। * আপনি জানেন , যে রাত্রিতে আসে সেটা কি? * সেটা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
- (By the heaven and the Tarik * Ah, what will tell thee what the Tarik is! * The piercing Star!) (Al- Quran 86:1-3)
- [আল-কুরআন সূরা- ৮৬, আয়াত- ১-৩]
একটি তারকা উজ্জল রুপ তখনই লাভ করে যখন তার জীবনকাল শেষ হয়ে যায়।
যাইহোক, যেহেতু অই জায়গা থেকে কোন আলো বের হতে পারে না, তাই আমরাও ব্ল্যাক হোল কে দেখতে পারি না। তা অদৃশ্য। কিছু বিশেষ স্পেস টেলিস্কোপ ব্ল্যাক হোল কে খুঁজে বের করতে পারে। যখন কোন তারকা এমন ভাবে আচরন করে অর্থাৎ তার আয়ুকাল শেষ হয়ে আসে এবং ব্ল্যাক হলে পরিনত হতে যাচ্ছে, তখন এই বিশেষ যন্ত্রপাতি সম্বলিত টেলিস্কোপ তাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।
কতো বড় এই ব্ল্যাক হোল?
ব্ল্যাক হোল ছোট হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষুদ্রতম ব্ল্যাক হোল একটি পরমাণুর সমান হতে পারে। এই জাতিও ব্ল্যাক হোল গুলো অনেক ক্ষুদ্র কিন্তু তাদের এক একটার ভর হতে পারে বিশাল কোন পর্বতের সমান। ভর হচ্ছে বস্তুর পরিমান অথবা একটি অবজেক্ট এ অবস্থিত মোট পদার্থ বা বস্তুর উপাদান।
অন্য এক ধরনের ব্ল্যাক হোল কে বলা হয় "স্টেলার" বা "নাক্ষত্রিক";
এর ভর আমাদের সূর্যের ভর এর চেয়েও ২০ গুন বেশি হতে পারে। খুব সম্ভবত অনেক অনেক বেশি ভরের ও নক্ষত্র রয়েছে পৃথিবীর ছায়াপথে। আর পৃথিবীর এই ছায়াপথ কে বলা হয় "মিল্কি ওয়ে"।সব চেয়ে বৃহৎ ব্ল্যাক হোল কে বলা হয় "সুপারমেসিভ";
এই জাতিয় ব্ল্যাক হলের ভর হয় ১ বিলিয়ন সূর্যের ভর এর ও অধিক। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে প্রতি টি বৃহৎ গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের কেন্দ্রে এই রকম একটি সুপারমেসিভ ব্ল্যাক হোল থাকে। আর যে সব ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে এই ব্ল্যাক হোল থাকে তাকে বলা হয় "Sagittarius A" । এর ভর প্রায় ৪ বিলিয়ন সূর্যের ভরের সমান এবং একে একটি সুবিশাল বল এর ভিতর সেট করা যাবে, এমন বল যা প্রায় আমাদের পৃথিবীর মতো কয়েক মিলিয়ন প্রিথিবি ধারন করতে সক্ষম।
ব্ল্যাক হোল-এর জন্মঃ
বিজ্ঞানিদের মতে- সব চেয়ে ছোট ব্ল্যাক হোল টির জন্ম ঠিক এই মহাবিশ্বের জন্মের সময়।আর স্টেলার ব্ল্যাক হোলের গঠিত হয়ে যখন বিশাল একটি তারকার কেন্দ্র নিজে থেকেই তার উপর পতিত হয় বা আপনা আপনি সঙ্কুচিত হতে থাকে। আর এই পর্যায়ে তার থেকে জন্ম নেয় "সুপারনোভা"। "সুপারনোভা" হলো বিস্ফোরিত তারার একটি অংশ যা মহাশূন্যে ভেঙ্গে পড়ে।
আর সহজ করে বলি- একটি নক্ষত্রের নির্দিষ্ট জালানি নিঃশেষ হয়ে গেলে এর মৃত্যু ঘটে। যতক্ষণ পর্যন্ত এর আভ্যন্ত্যরিন হাইড্রোজেন গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভিতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে। হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে এর কেন্দ্রিও মূল বস্তু সঙ্কুচিত হতে থাকে। কিন্তু এর বাহ্যিক অংশ তখনও প্রসারিত হতে থাকে। এমন পর্যায়ে যখন নক্ষত্রটির ভর পাঁচ সৌর ভর এর মধ্যে থাকে, তখন সঙ্কোচন এর সময় এর বহিঃস্থ আস্তরন ছুড়ে ফেলে অত্তাধিক উজ্জ্বল হয়ে উঠে। যাকে আমরা "সুপারনোভা" বলে চিনি। ধারনা করা হয়- ছাপথের জন্মের সময় এই সুপারনোভার সৃষ্টি।
ব্ল্যাক হোল যদি ব্ল্যাক অর্থাৎ কালো হয়, তাহলে বিজ্ঞানিরা কিভাবে তা দেখতে পান?
সাধারন ভাবে একটি ব্ল্যাক হোল কে দেখা প্রায় অসম্ভব কারন এর অতি শক্তিশালী অভিকর্ষীয় শক্তি এর সব টুকু আলো এর কেন্দ্রের দিকে টানে। কিন্তু এর আসেপাশের তারকা এবং গ্যাস কিভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হয় বা হচ্ছে বিজ্ঞানীরা এটা দেখতে পারেন। যে সব তারকারা ব্ল্যাক হোল কে ঘিরে উড্ডয়মান অথবা ঘূর্ণ্যমান, গবেষক রা সেই সব তারকাদের উপর স্টাডি করতে পারেন। যখন একটি ব্ল্যাক হোল ও তারকা পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসে, তখন অনেক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আলো উৎপন্ন হয়। এই ধরনের আলো মানব চক্ষে দেখা যায় না। বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট এবং কিছু বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন এই উচ্চ ক্ষমতার আলো কে পর্যবেক্ষণ করতে।
ব্ল্যাক হোল কি পৃথিবী তে বিপর্যয় বা ধ্বংস সৃষ্টি করতে পারে?
ব্ল্যাক হোল মোটেও স্পেস বা মহাশুন্যের এতোটা কাছে ভ্রমন করে না কোন তারকা, চাঁদ বা গ্রহ কে তার শিকার বানাতে। আর পৃথিবীও কোন দিন ব্ল্যাক হলে গিয়ে পতিত হবে না কারন, কোন ব্ল্যাক হোল কিন্তু পৃথিবীর সৌরজগতের এত টা কাছাকাছি নয়। যদি একটি সূর্যের সমান ভরের একটি ব্ল্যাক হোল সূর্যের জায়গায় প্রতিস্তাপিত হয়, তবুও নয়। কোন কোন ব্ল্যাক হলের ভর সূর্যের সমতুল্য হতে পারে। তখনও কিন্তু পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ গুলো ও কিন্তু ওই ব্ল্যাক হলে কে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান থাকবে, যেমন টা থাকতো পৃথিবী কে কেন্দ্র করে। আর সব চেয়ে মজার কথা হল, আমাদের সূর্য কিন্তু কখনই একটি ব্ল্যাক হলে পরিণত হবে না। কেন?কারন সূর্য তত টা বিশাল নয় যত টা প্রয়োজন হয় একটি তারকার ব্ল্যাক হলে পরিণত হতে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে- ব্লাক হোল থেকে কোন কিছুই বের হতে পারে না, এমনকি আলোও। কিন্তু "কোয়ান্টাম মেকানিক্সের" তত্ত্ব অনুসারে, এই তত্ত্বকে এখন বিজ্ঞানীরা আর মানতে পারছেন না।
চিরায়ত পদার্থবিদ্যার মতে- ব্লাক হোল হলো অবিশ্বাস্য ঘনত্বপূর্ণ, যেখানে স্থান ও কাল অর্থাৎ স্পেস ও টাইম এতই ছোট যে কোনকিছুই তার অভিকর্ষ শক্তি অতিক্রম করতে পারে না।
কিন্তু এখন এই তত্ত্বের সাতে বিতর্কিত রুপে উপস্থিত হয়েছে "কোয়ান্টাম মেকানিক্স", যা মহাবিশ্বের সকল অতিপারমাণবিক বস্তুর ব্যাখ্যা করে।
ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের তত্ত্ব মতে এবং সর্বজন স্বীকৃত ভাবে ব্লাক হোল- এর নিকটবর্তী সব কিছুকেই শোষণ করে নেয়, কিন্তু তা যে কোন সময় নিঃসরণ করতে পারে না। কিন্তু এইখানেই বিতর্ক দেখা দেয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাতে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতে- যদি একটি ক্রিয়া সম্ভব হয়, তবে তার প্রতিক্রিয়া সম্ভব। " এডওয়ার্ড উইটেন" ব্যাখ্যা করেন। প্রক্রিয়া আসলে বিপরীত ভাবে হতে পারে। এইভাবে যে- যদি একজন মানুষ ব্লাক হোল ধারা শোষিত হতে পারেন একটি কিঞ্চিৎ বড় ব্লাক হোল সৃষ্টি করতে, তবে একটি বৃহৎ ব্লাক হোলও একজন মানুষ কে উধগিরন করে ছোট ব্লাক হলে পরিণত হতে পারে। যদিও এই পর্যন্ত ব্লাক হোল থেকে কোন কিছুই মুক্তি পেতে পারে না বলেই প্রচলিত।
এই উভয়সঙ্কট নিরসনে, পদার্থবিদগণ এন্ট্রপি তত্ত্বে নজর দিচ্ছেন। থার্মোডায়নামিক্স এর সূত্রমতে- অতিপারমাণবিক বিশ্বে, মহাবিশ্বের এন্ট্রপি হ্রাস করা অসম্ভব- যা সুধু বৃদ্ধি পেতে পারে। যদি একজন ব্যক্তি ব্লাক হলে পতিত হয়, তবে এন্ট্রপি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। আর যদি অই ব্যাক্তি তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তবে এন্ট্রপি হ্রাস হওয়ারই কথা। একই ভাবে- একটি কাপ থেকে পানি মাটিতে ছিটকে পড়তে পারে, কখনই মাটি থেকে পানি কাপে উঠবে না।
দেখা যাচ্ছে এই মূলনীতি ব্যাখ্যা করে যে, ব্লাক হলে পতিত একটি বস্তু কেন সংরক্ষিত থাকার কথা নয়, এখন পর্যন্ত যা শুধুমাত্র আণুবীক্ষণিক ভাবেই গ্রহণযোগ্য।
"স্টিফেন হকিং" এই ঘটনা আণুবীক্ষণিক ও কোয়ান্টাম মাত্রায় অনুধাবন করেন যে- "বস্তু ব্লাক হোল থেকে মুক্তি পেতে পারে" । তিনি দাবি করেন ব্লাক হোল অবিরত ভাবে পার্টিকল নিঃসরণ করতে পারে, যা তিনি একটি সমীকরণেও ব্যাখ্যা করেছেন- যার নাম দেয়া হয়েছে "হকিং রেডিয়েশন (Hawking radiation)" ।
তাসত্ত্বেও, একটি ব্লাক হোল কখনই একজন নভোচারী অথবা একটি চেয়ার কে নিঃসরণ করবে না, বাস্তবে, ইহা শুধুমাত্র সাধারন কিছু পার্টিকল যেমন- পরমাণু ই নিঃসরণ করতে পারে- বললেন - "উইটেন"
যাইহোক, গবেষকরা এখন হকিং রেডিয়েশন পর্যবেক্ষণে ব্যস্থ।
ইনশাল্লাহ আগামী পর্বে "হকিং রেডিয়েশন" নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো ।
-------------------------------------------------------------------------
নববর্ষের অফুরন্ত শুভেচ্ছা সকল কে।
ভালো থাকা হোক, নিরন্তর।