কী কী কারণে রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা অত্যাবশ্যকঃ
কী কী কারণে রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা অত্যাবশ্যক সে বিষয়ে আমার সীমিত জ্ঞানের আলোকে কিছু যুক্তি ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করলাম। এই প্রকল্প সুন্দরবনের মতো একটা সমৃদ্ধ বনাঞ্চল বিনষ্ট করার অপপ্রয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এতে শুধু সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্থ হবেনা বরং সমগ্র দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বৈষম্যহীন হয়ে পড়বে। আমি মনে করি সরকার এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বিষয়টি নিয়ে পুনরায় ভাববেন।
১। প্রয়োজনীয় কাঁচামালঃ রামপালে যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সেই প্রকল্পের মূল কাঁচামাল “কয়লা”, যার পুরোটাই ভারত থেকে আমদানী করা হবে। দেশীয় সম্পদ ব্যবহারের কথা এই প্রকল্পে মোটেও বিবেচনা করা হয়নি। বাংলাদেশের যে অঞ্চলে অর্থাৎ “বড় পুকুরিয়া” এলাকায় প্রচুর কয়লা মজুদ আছে সেখানে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প বাবস্তবায়নের কথাও বিবেচনা করা হয়নি। নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার না করে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানীকৃত কয়লার উপর নির্ভর করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কতটা যুক্তিযুক্ত?
২। বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়ঃ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল কাঁচামাল কয়লা এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও ভারত থেকে আমদানীকৃত কয়লার উপর নির্ভর করে এই প্রকল্প চালিত হবে। যে উন্নতমানের কয়লার কথা বলা হয়েছে তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত হয়না এবং তা সংগ্রহ করতে হবে দক্ষিণ ভারতের ময়ুরভঞ্জ বা বিশাখাপত্তম এলাকা থেকে যা মূল্যের দিক থেকে কখনোই সাশ্রয়ী হবেনা বরং দেশীয় কয়লার ব্যবহার বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে দেবে। তাই প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করে কয়লা আমদানীর মাধ্যমে রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প শখে হাতি পোষার সামিল হবে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিটেন্সের মাধ্যমে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এহেন অপচয় একধরণের বিলাসিতা।
৩। আর্থিক ক্ষতি ও সময় বিবেচনাঃ আমদানীকৃত কাঁচামাল বা কয়লার উপর পূর্ণ নির্ভরতা, পরিবহন সংকট ও বন্দর ব্যবহার জটিলতা, সময়মত শিপমেন্ট এবং সুদূরপ্রসারী আমদানি জটিলতা সাথে মূল্যবৃদ্ধি, মৃদ্রিষ্ফীতির কথা বিবেচনা করলে প্রকল্পের উৎপাদন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
৪। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা রেল ও সড়ক যোগাযোগের দিক থেকে তেমন উপযুক্ত নয়। বর্ষা মৌসুমে জলপথে কিছুটা সুবিধা হলেও সড়ক পথ স্যাঁতসেঁতে ও কর্দমাক্ত বিধায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে। শুষ্ক মৌসুমে জল পথেও পরিবহন সংকট দেখা দেবে।
৫। রিহ্যাবিলিটেশনঃ রামপাল এলাকায় জনবসতি অপেক্ষাকৃত কম তাই উচ্ছেদের ঝামেলা কম হলেও সেখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই প্রকল্পের তেমন কোন ভূমিকা থাকবেনা বরং এখানে যারা কাজ করবে তাদের আবাসিক সুবিধা, যাতায়াত ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে বিশাল পরিমাণ জমি ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
৬। বায়ু দূষণঃ সাধারণত বায়ু দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ধাবিত হয়। রামপাল প্রকল্প দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে নির্মাণ হচ্ছে বিধায় বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে বাতাস দেশের উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হবে। এই প্রকল্প থেকে নির্গত ধোঁয়া, সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বণ-ডাই-অক্সাইড, তাপ তরঙ্গ এবং সূক্ষ্ম ছাই ও ধূলিকণা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে যাবে। ফলে শুধু সুন্দরবন নয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সকল সবুজ বেষ্টনী ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এছাড়া সুন্দরবনের গাছপালা, জীবজন্তু, পশুপাখী, মানুষ, গবাদি পশু বায়ু দূষণে আক্রান্ত হবে এবং জীবকূলের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। এতে জীববৈচিত্র ধ্বংশ হবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে, পুরো ইকো-সিস্টেমের উপর প্রভাব পড়বে। আমরা এই দেশে চেরনোবিল বা ভূপালের মত দূষণ আক্রান্ত হতে চাইনা।
৭। জল দূষণঃ রামপাল প্রকল্পের ভয়াবহ থাবা সবচাইতে বেশী প্রভাবিত ও তরান্বিত করবে পানি দূষণকে। প্রকল্প এলাকাজুড়ে বিভিন্ন নদী, শাখা-নদী, হাওর, বিল- এমন কি অদূরেই রয়েছে বঙ্গোপসাগর। বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে নির্গত তরল বর্জ্য ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-অভ্যন্তরের পানি স্তরে ও আশেপাশের নদী-খাল-বিলে ছড়িয়ে যাবে। ফলে এই এলাকার মাছ, জলজ উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই এলাকার বিশাল এলাকা জুড়ে যে চিংড়ি ঘের বা চিংড়ি উৎপাদন প্রকল্প রয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলের দূষিত পানি বিভিন্ন নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে দেশের নদী-খাল-বিল ও হাওড়গুলোকে দূষিত করবে। উপরন্তু শুষ্ক মৌসুমে এই এলাকার পানি নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলকে দূষিত করবে ফলে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের ব্রিডিং ব্যহত হবে, মাছের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যাবে।
৮। তরল বর্জ্য পরিশোধন প্রক্রিয়া বা ট্রীটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রতিস্থাপনের বিশাল ব্যয়ভারঃ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ু ও পানি দূষিত হবে তা শোধন করার মতো ব্যয়ভার বা প্রক্রিয়া দুঃসাহসিক চিন্তার সামিল এবং এই বিশাল ব্যয়ভার প্রকল্পে সংকুলান করা সম্ভব কিনা তা’ও ভেবে দেখবার বিষয়। তরল বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা করা গেলেও বায়ু দূষণ কোনভাবেই সম্ভব নয়, বিশ্বের কোথাও তেমন নজির নেই। অনেক কথাই মুখে বলা সহজ কিন্তু বাস্তবে কতটা কঠিন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হাজারিবাগের ট্যানারী বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা এবং তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার অব্যাহত দূষণ প্রক্রিয়া যার সুরাহা আজও সম্ভবপর হয়নি। এমনকি ওয়াসা তার ওয়াটার ট্রীটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে পানি শোধন ও সরবরাহে কতটা সফল তা আমরা সকলেই জানি। একটু চিন্তা করে দেখুন ১ লিটার দূষিত তেল সাগরের ৭৫০০ মেট্রিক লিটার পানিকে দূষিত করতে পারে আর তা পরিশোধনের খরচ মিলিয়ন ডলারের বেশী। সুতরাং রামপালের দুষিত বায়ু ও তরল বর্জ্য পরিশোধন কিভাবে সম্ভব আর এই শোধন প্রক্রিয়ার শেষে অবশিষ্ট তলানি বা উচ্ছিষ্ট বর্জ্য কোথায় ডাম্পিং করা হবে এবং সেটা ঐ এলাকার পরিবেশের জন্য নিরাপদ হবে কিনা সেটাও ভেবে দেখবার বিষয়।
৯। বন উজাড়, গ্রীন-হাউস এফেক্ট ও এসিড বৃষ্টির আশংকাঃ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনের কাছাকাছি এলাকায় অবস্থিত আর সুন্দরবন হলো বিশ্বের অন্যতম সেরা ম্যানগ্রুভ ফরেস্ট। সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেম, বায়ো-ডাইভারসিটি, ইকোলজিক্যাল ভ্যাল্যু বিশ্বব্যাপি সমাদৃত। সুন্দরবনের বিশাল বনাঞ্চলের কারণে বাংলাদেশ অনেকটাই গ্রীন-হাউস এফেক্ট ঝুঁকি থেকে মুক্ত, এসিড বৃষ্টির প্রকোপ রোধে সক্ষম। আর এই বনাঞ্চলের আশেপাশে এই ধরণের বিদ্যুৎ প্রকল্প শুধুই ঝুঁকিপূর্ণ নয় বরং পুরো ইকো-সিস্টেম বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। এখনো যে কয়টি বিলুপ্তপ্রায় পশুপাখী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টিকে আছে সেটাও চিরতরে ধ্বংশ হবে। মিঠা পানির কুমীরও থাকবেনা। কালক্রমে এর প্রভাব মানুষের উপর আসবেই। আমাদের সুস্থ হয়ে টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে আসবে।
১০। অবকাঠামোগত নির্মাণ ও ভূমি ব্যবহারে সমস্যা, বৈদ্যুতিক পোল স্থাপন ও বৈদ্যুতিক তারের বিদ্যুৎ প্রবাহের ভয়াবহতাঃ রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা অপেক্ষাকৃত নীচু, অসমতল, বন্যা প্রবণ ও জলমগ্ন এলাকা হওয়ার কারণে অবকাঠামো নির্মাণ কাজে ব্যপক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এলাকার আশেপাশে জলাভূমি থাকার কারণে মাটি ভরাটের প্রয়োজন হবে এবং এই মাটি সংগ্রহের জন্য ভূমি ব্যবহারে প্রভাব ফেলবে। বৈদ্যুতিক পোল ও বৈদ্যুতিক তার যে পথে বিস্তৃত হবে সেই এলাকার আশেপাশে পশুপাখীর বসতি বিনষ্ট হবে, অনেক গাছ কাটা পড়বে ফলে পশুপাখীর প্রজনন কমে আসবে। প্রকৃতি একটা ভারসাম্যহীন অবস্থায় বিরাজ করবে।
আরও অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও বিশদ ব্যাখা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতামত ও বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট পর্যালোচনা করা আবশ্যক। একটা দেশ ও জাতির ভবিষ্যত চিন্তা করেই এমন ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়া উচিৎ। আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে একথা সত্য তবে স্থান নির্ধারণে সতর্ক না হয়ে শুধুই আবেগের বশবর্তী হয়ে বা রাজনৈতিক চাপে কোন ভুল সিদ্ধান্ত একটা জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া কোনভাবেই সমীচীন নয়। বরং দেশের উত্তারাঞ্চলে কথা “বড় পুকুরিয়া” বা তার আশেপাশের এলাকায় যেখানে কয়লার প্রাচুর্যতা আছে সেখানে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে একটা মহামূল্যবান বনাঞ্চল বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। আমাদের সকলকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে, লাভ ক্ষতির হিসেবটা নানাদিক থেকে নানাভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ টীম করে রিভিয়্যু করা যেতে পারে। তাতে প্রকল্পের কোন ক্ষতি হবেনা বরং জাতি উপকৃত হবে।