Tue, Oct 4th, 2011 2:12 am BdST
সুলাইমান নিলয়
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক
ঢাকা, অক্টোবর ০৩ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- একাত্তরে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী তার বিভিন্ন 'ওয়াজ মাহফিলে' নারী বিষয়ে নানা কথা বলতেন পুরুষদের আকৃষ্ট করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে করা গবেষণায় এমনি দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তপন মাহমুদ তার পড়াশোনার স্নাতকোত্তর পর্বে রিসার্চ মনোগ্রাফ হিসেবে ২০০৮ সালে এ গবেষণা করেন।
একাত্তরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী ২০টি অপরাধে 'রাজাকার বাহিনীর সদস্য' এবং জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয় সোমবার।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দেড় বছর পর সোমবার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নেতা সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলো। তার বিচার শুরুর দিন ঠিক হয়েছে আগামী ৩০ অক্টোবর।
অভিযোগে বলা হয়, "স্বাধীনতা যুদ্ধকালে আপনি অন্য সহযোগীদের সঙ্গে বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে নিজ বাড়িতে আটকে নিয়মিতভাবে ধর্ষণ করেছেন।"
নারী প্রসঙ্গে যেভাবে বলেন সাঈদী
গবেষণার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গবেষক বলেন, "দেলোয়ার হোসেন সাইদীর ওয়াজের অডিও ক্যাসেট ও সিডি থেকে শুনে ২৮০ মিনিটের ট্রান্সক্রিপ্ট করা হয়েছে। তার পুরো ওয়াজকে কয়েকটি মূল আধেয়তে ভাগ করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "ওয়াজ বলতে সাধারণ অর্থে ইসলামী বয়ান বোঝায়। ইসলামী নিয়মকানুন সম্পর্কে ব্যাখ্যা ও প্রচার এই ওয়াজের মূল লক্ষ্য । কিন্তু সাইদীর ওয়াজে আরো অনেক কিছু আধেয় হিসেবে পাওয়া গেছে।
সাঈদী তার ওয়াজে বলেন, "মানুষের চোখ খুব নান্দনিক জিনিসকে দেখতে পিয়াসী। এর জন্য ফুলের দিকে মানুষ বেশি তাকায়। ময়লার দিকে তাকায় কম। এটা মানুষের ফিৎরা (স্বভাব)। এটা মানুষের প্রকৃতি। সুন্দর জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া মানুষের ফিৎরা। এই জন্য যাতে আকৃষ্ট না হতে পারে সেজন্য বোরকা সাদামাটা হওয়া উচিত...।"
তপন বলেন, "এই উদ্ধৃতি থেকে বেশ কয়েকটা বিষয় দেখানো যায়। প্রথমত মানুষ বলতে আসলে পুরুষ বোঝানো হয়েছে। আর নারীকে সুন্দর জিনিস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
"পুরুষ যেন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে না পারে সে জন্য তাকে সাদামাটা থাকতে বলা হয়েছে।"
সাঈদীর তার ওয়াজে বলেন, "বোরকা, হিজাব এসব হলো পর পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এখন বোরকাটা যদি আকর্ষণীয় হয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা। এমন বোরকা পড়া উচিত যাতে নজর না পড়ে যায়। যাতে কেউ বারবার না তাকায়। বোরকা পড়লে মর্যাদা বাড়ে।
"বোরকাটা এইজন্য পড়বেন যাতে কেউ খারাপ নজরে না তাকায়। কমেন্ট না করে। খারাপ মন্তব্য না করে। সেখানে বোরকাটা যদি সুন্দর ডিজাইন করা হয়, অনেক এম্ব্রয়ডারি করা হয় তাহলে ওগুলোর দিকে একবার চোখ পড়লে আবার চোখ পড়ে। মানুষের চোখ খুব নান্দনিক জিনিষকে দেখতে পিয়াসী। এর জন্য ফুলের দিকে মানুষ বেশি তাকায়...?"
আরেক ওয়াজে সাঈদী বলেন, "...একদিন এক মহিলা পুলিশের সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা হলো। বললাম, মা তুমি পুলিশ হলা কেন? সে বলল, জাতীয় সম্পদ হেফাজত করতে গভর্মেন্ট আমাদেরকে পুলিশ বানাইছে।
"আমি বললাম, মা, আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছে সেটা হেফাজত করতে ১০টা পুলিশ হিমশিম খায় আর তুমি করবা জাতীয় সম্পদ হেফাজত!"
অন্য আরেক ওয়াজে সাঈদী বলেন, "নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ স্বাভাবিক। এই আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যেন তার প্রতি কোনো কুনজর না করতে পারে। সেজন্য ইসলাম বলেছে তাকে পর্দায় রাখার জন্য। এই জন্য সব ভালো ভালো খাবার আল্লাহ পর্দা করে দিয়েছেন।
"কলা ভালো খাবার না মন্দ খাবার? কলাটা আল্লাহ প্যাকেট করে দিয়েছেন না? আনারসটা প্যাকেট করে দিয়েছেন না? লিচুটা প্যাকেট করেছেন না...। সবরি কলা, ল্যাংড়া আম, কাঁঠাল সব ছিলাইয়া যদি বায়তুল মোকারমের সামনে নিয়া বসে, কেউ কিনবে? কেনবো তা নাই, এর উপর পড়বে মাছি।"
"সুতরাং জিনিস যতো ভালো আল্লা তাকে পর্দা করে রেখেছেন। নারী হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কে বলেছেন? আল্লার রাসুল বলেছে। এ শ্রেষ্ঠ সম্পদকে আল্লা হেফাজত করতে বলেছেন।
"হেজাব শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ হলো, নারীকে পর পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা থেকে রক্ষা করা।"
কেন এ গবেষণা
গবেষণায় ভূমিকায় তপন মাহমুদ লেখেন, তিনি [সাঈদী] আসলে কী বলেন ওয়াজে? কীভাবে উপস্থাপন করেন? তার এই ওয়াজ কী ধরনের সামাজিক অর্থ তৈরি করে- এসব প্রশ্নকে সামনে রেখে গবেষণাটি করেন তিনি।
'মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর ওয়াজের আধেয় বিশ্লেষণ' শিরোনামের গবেষণায় সাঈদীর ওয়াজের তিনটি অডিও ক্যাসেট ও দুইটি সিডির বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করেন তিনি।
এগুলো হলো- স্বামী-স্ত্রীর অধিকার (অডিও ক্যাসেট), ইসলামে নারী ও অমুসলিমের অধিকার (অডিও ক্যাসেট), মুমিনের গুণাবলী (অডিও ক্যাসেট), পর্দা: মর্যাদা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি (ভিডিও ক্যাসেট), জিহাদের মূল প্রেরণা (ভিডিও ক্যাসেট)।
এতে দেখা গেছে, দুশ ৮০ মিনিটের ওয়াজে একশ ১৬ মিনিট সাঈদী কথা বলেছেন নারী প্রসঙ্গে। শতকরা হিসাবে যা ৪১ দশমিক ৭৬ ভাগ।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাঈদীর ওয়াজের বিষয়বস্ত হিসাবে থাকে দোয়া (শুরুর), মোনাজাত (শেষে), নারী বা স্ত্রী বিষয়ক আলোচনা, মুসলিম জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ, রাজনীতি প্রসঙ্গ, অমুসলিম প্রসঙ্গ, ধর্মীয় আইন কানুন ও প্রথা, ইসলামী প্রতিপক্ষ সম্বন্ধীয় আলোচনা, হামদ নাত/ ইসলামী গান।
তপন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বিশ্লেষণে দেখা গেছে 'জিহাদের' মূল প্রেরণা বিষয়ক আলোচনাতেও নারী বিষয়ে ব্যাপকভাবে বলা হয়েছে।"
"পুরুষ দর্শককে আকৃষ্ট করা জন্য, বিনোদন দিতে বিষয়টিকে বেশি বেশি আলোচনা করা হয়", মন্তব্য করেন তিনি।
"সাইদী রাজনীতিবিদ হওয়ায় তিনি একটু বেশিই আলোচিত," মন্তব্য করে তপন বলেন, "ওয়াজে ধর্মীয় নানা ধরনের বিষয় আলোচিত হয়। তবে অভিযোগ আছে ধর্মের মোড়কে তিনি আসলে এক ধরনের উত্তেজনা ছড়ান সমাজে।"
একটি 'বিশেষ শ্রেণীর কাছে সাঈদী জনপ্রিয়' উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এই জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজতে গিয়েই এই গবেষণায় হাত দিই।"
মোট ২৮০ মিনিটের ওয়াজের মধ্যে ১১৬ মিনিট নারী বিষয়ক। যার শতকরা হার ৪১ দশকি ৭৬ শতাংশ। এরপরেই আছে ধর্মীয় নিয়ম-কানুন। প্রথা মূল্যবোধ সম্পর্কিত আলোচনা, যার শতকরা হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ।
হামদ ও নাত ও ইসলামী গান ও ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে এটা মূল ওয়াজের অংশ নয়। ক্যাসেটের ফিলার হিসেবে এটা ব্যবহার করা হয়েছে।
দোয়া সাত দশমিক ৫৬ শতাংশ ও মোনাজাত দুই দশমিক ৮৮ শতাংশ। এছাড়া আট দশমিক ৫৬ শতাংশ আলোচনা হয়েছে মুসলিম জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে। রাজনীতি প্রসঙ্গে চার দশমিক ৬৮ শতাংশ। অমুসলিম প্রসঙ্গে সাত দশমিক ৯২ শতাংশ আর প্রতিপক্ষ ইসলামী গ্র"প সম্পর্কে তিন দশমিক ২৪।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/এসএন/পিডি/০১৫৭ ঘ.
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১১ রাত ৯:২১