রাজধানীর বনশ্রীতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিকিকিনির জন্য আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে একটি 'স্টক মার্কেট'। গ্রীন বাংলা গ্রুপ পরিচালিত এ কার্ব মার্কেটে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনাবেচা হয়। বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য চলে এখানে। এই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। সংসদ সদস্য, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীসহ অনেকের মোটা অঙ্কের টাকা আটকে আছে গ্রীন বাংলা গ্রুপের কাছে। তাঁদের মধ্যে মাহী বি চৌধুরী আড়াই কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করে পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা উদ্ধার করেন। কুমিল্লার এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরীও গ্রীন বাংলার মাধ্যমে আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন বলে জানা যায়। তবে নাসিমুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি টাকা তুলে নিয়েছেন।
প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে এক বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নবী উল্যাহ নবীকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। এসইসির তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল। মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো চলছে। তবে অবৈধ এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না গ্রীন বাংলার।
গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে। নবী উল্যাহ নবী এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আটটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে চালানো হচ্ছে অবৈধ প্লেসমেন্ট ব্যবসাসহ পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানামুখী প্রতারণা। ২০১৪ সাল পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসতে পারে_এর প্রায় সব কটির শেয়ার এখনই নবী উল্যাহ নবীর কাছে রয়েছে বলে তাঁর সহযোগীরা প্রচার করছে। এই চক্র ইতিমধ্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে ৬০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন এমন দেড় শতাধিক ব্যক্তির তালিকা রয়েছে কালের কণ্ঠের কাছে।
ফাঁদে আটক যাঁরা : ১৫০ টাকার জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে করা 'বিনিয়োগ চুক্তি' দলিলের মাধ্যমে জহিরুল ইসলাম নামে একজন বিনিয়োগকারী নবী উল্যাহর কাছ থেকে দেশবন্ধু পলিমারের দুই লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন। শেয়ারপ্রতি ৩৫ টাকা হিসাবে জহিরুল ইসলাম ৭০ লাখ টাকা দেন নবী উল্যাহকে। চুক্তিনামায় নবী উল্যাহর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মিনু এবং কে এম নাজমুল হাসান নামে এক ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। জহিরুল ইসলামের বিনিয়োগকৃত অর্থের জামানত হিসেবে নবী উল্যাহর পক্ষ থেকে সমপরিমাণ অর্থের নিরাপত্তামূলক চেক দেওয়া হয়েছে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। চুক্তিপত্রে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রির পর বিক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগের লভ্যাংশ নির্ধারিত হবে। আর শেয়ার বিক্রি করে লোকসান হলে বিনিয়োগকারীর ৭০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ারও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা সম্ভাব্য ক্রেতাদের বলছেন, বর্তমান জাতীয় সংসদের ১১ জন সদস্য, বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা, উচ্চপদস্থ আমলা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, উঠতি শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগকৃত টাকা উত্তোলনের জন্য গত ১৩ জুলাই বনশ্রীর গ্রীন বাংলা কার্যালয়ে গিয়েছিলেন কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নাসিমুল আলম চৌধুরী। এ সময় এই প্রতিবেদকও প্রতিষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন। গ্রীন বাংলার এক কর্মকর্তার সঙ্গে সেদিন কথা বলে জানা যায়, নাসিমুল আলম গ্রীন বাংলায় আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ওই দিন তাঁকে আরো সাত কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
কয়েক দিন আগে যোগাযোগ করা হলে নাসিমুল আলম চৌধুরী এমপি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবীর কাছে আমার কিছু বিনিয়োগ ছিল। সেটা আমি কিছুদিন আগে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। তবে আমার এলাকার অনেকের টাকা আটকে গেছে বলে শুনেছি।' প্লেসমেন্ট শেয়ার এভাবে কেনা বৈধ কি না_এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সেটা জানি না।' তিনি আরো বলেন, 'এখন শেয়ারবাজার ভালো, ফলে মূল মার্কেটের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগের দরকার পড়ে না।'
ডিএসইর কয়েকজন সদস্যও গ্রীন বাংলায় বিনিয়োগ করেছেন বলে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা দাবি করেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, বনশ্রীর ওই অফিসে একাধিক এমপির যাতায়াত রয়েছে। তাঁরা সবাই প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছেন।
বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে সম্প্রতি বড় ধরনের বিপাকে পড়েন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিকল্পধারার নেতা মাহি বি চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবী উল্যাহ সিন্ডিকেটের সদস্য আলাউদ্দীনের মাধ্যমে তিনি বীকন ফার্মার দুই কোটি ৬১ লাখ টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছিলেন। গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে তাঁদের নামে চেক লিখে দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও তিনি রাজি হননি। কথা ছিল, মাহির নিজস্ব বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখা হবে এবং সেখানে নির্ধারিতসংখ্যক শেয়ার জমা হওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করা হবে। সে অনুযায়ী মতিঝিলে সাদ সিকিউরিটিজের একটি শাখায় পরিচালিত বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার জমা হয়নি। এ কারণে ব্রোকারেজ হাউস থেকে সব টাকা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, বিও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়নি।
মাহি বি চৌধুরী জানান, তিনি তাঁর স্ত্রী, শ্যালক ও শাশুড়ির নামে নবী উল্যাহর কাছ থেকে বীকন ফার্মার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনেন। শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের সহায়তায় তিনি ওই টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হন। বিষয়টি তিনি ডিএসই সভাপতি শাকিল রিজভী ও সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটুকে মৌখিকভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন। গ্রীন বাংলার বনশ্রী অফিসে একাধিক বৈঠক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পান মাহি।
মাহি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটা বেআইনি, তা প্রথমে বুঝিনি। পরে যখন বুঝতে পারি, তখন টাকাটা তুলে আনার চেষ্টা করি।' তাঁর মতে, টাকার রসিদই প্রমাণ দেয়, সাদ সিকিউরিটিজ জড়িত।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার হাউসে মাহি বি চৌধুরীর বিও হিসাব থাকলেও সেখানে ওই টাকা জমা হয়নি। আলাউদ্দীনের মাধ্যমে গ্রীন বাংলার নবী উল্যাহ নবী ওই টাকা নিয়েছেন। ইতিমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে।' প্রতারক চক্র তাঁর হাউসের জাল রসিদ বই ছাপিয়ে নিয়েছে বলেও তিনি জানান।
গ্রীন বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার এই ব্যবসা বৈধ। আইনগত কোনো বাধা নেই।' তিনি আরো বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে এসইসি ৫৪ ধারায় একটা মামলা করেছে। আশা করি, শিগগিরই মামলাটির মীমাংসা হয়ে যাবে।' প্রতারণার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সাত-আট বছর ধরে এ ব্যবসা করছি। কেউ বলতে পারবেন না, আমি কারো টাকা মেরে দিয়েছি।'
প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে গড়ে ওঠা আলাদা কার্ব মার্কেট প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতি শাকিল রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'একজন আইনজীবীসহ কিছুদিন আগে মাহি বি চৌধুরী ডিএসইর অফিসে আসেন। তাঁর অভিযোগের সূত্র ধরে জানতে পারি, মূল শেয়ার মার্কেটের বাইরে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির জন্য বনশ্রীর লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে আলাদা কার্ব মার্কেট। যেন শেয়ার মার্কেটের বাইরে আলাদা স্টক মার্কেট। এটা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। এটা মূল শেয়ার মার্কেটের জন্য মারাত্মক হুমকি। এখনই তা বন্ধ করা উচিত।'
অবৈধ ব্রোকারেজ হাউস : ২০০০ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালা অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানকে এসইসির কাছ থেকে স্টক ব্রোকার বা স্টক ডিলারের নিবন্ধন সনদ পেতে হলে অবশ্যই কোনো স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্য হতে হবে। কিন্তু দেশের দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের কোনোটির সদস্য না হয়েও ব্রোকারেজ হাউস প্রতিষ্ঠা করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ_নাম গ্রীন বাংলা সিকিউরিটিজ। ডিএসইর আওতাধীন সাদ সিকিউরিটিজের সদস্যপদ কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলেও দাবি করেছেন গ্রীন বাংলার কর্মকর্তারা। তবে সাদ সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, এসব একেবারেই ভুয়া প্রচারণা, তবে তাঁর (দেলোয়ার) ছোট ভাইয়ের ব্রোকারেজ হাউস আরাফাত সিকিউরিটিজ কেনার বিষয়ে একবার কথা হয়েছিল।
অবৈধ প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের বিষয়টি জানানো হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশনের অনুমোদন ছাড়া যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন সম্পূর্ণ বেআইনি। আইনগত প্রক্রিয়ার বাইরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি বলেন, 'এ ধরনের তৎপরতা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। যে বা যারাই অবৈধ পন্থায় শেয়ার লেনদেনে জড়িত থাকুক না কেন_প্রমাণ পেলে কমিশনের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
সরেজমিন প্লেসমেন্ট হাটে : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি দেশবন্ধু পলিমারের প্রতিটি শেয়ার গত বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ৮১.৫০ টাকা দরে। অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের শেয়ারের দাম ছিল ৮৮.৫০ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জে এই দরে বিক্রি হলেও বনশ্রীর ওই স্টক মার্কেটে এ দুটি কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা করে। আগামী অক্টোবরে দেশবন্ধু ও অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালের 'লক-ইন' উঠে যাবে বলে গ্রীন বাংলার পক্ষ থেকে ক্রেতাদের জানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তখন যদি এসব শেয়ারের বাজারদর বর্তমান স্তরেও থাকে, তাহলেও প্লেসমেন্ট শেয়ারের ক্রেতারা লাভ পাবেন শেয়ারপ্রতি যথাক্রমে ৪৬ ও ৫৩ টাকারও বেশি।
একই কায়দায় বিক্রি হচ্ছে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ও রংপুর ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের প্লেসমেন্ট শেয়ার। পিপলস লিজিংয়ের ১২৫ টাকার শেয়ার ৫০ টাকায় আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই ২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে রংপুর ডেইরির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার।
জানা যায়, এর আগে গ্রামীণফোন, আরএকে সিরামিকস, ফিনিঙ্ ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ বেশ কয়েকটি কম্পানির প্লেসমেন্টে শেয়ার নিয়েও বাণিজ্য করেছে গ্রীন বাংলা গ্রুপ।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত যেকোনো কম্পানি পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে এর শেয়ারের একটা অংশ বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) পূর্বানুমতি প্রয়োজন। এ ধরনের শেয়ারই প্লেসমেন্ট শেয়ার, যা কম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বা লক-ইন উঠে না যাওয়া পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া এসব প্লেসমেন্ট শেয়ারই অবাধে কেনাবেচা হচ্ছে গ্রীন বাংলা পরিচালিত 'কার্ব মার্কেটে'। এসইসি আইন ১৯৯৩ অনুযায়ী এসইসির নিবন্ধন ছাড়া স্টক ব্রোকার, সাব ব্রোকার, শেয়ার হস্তান্তরকারী প্রতিনিধিসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট যেকোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা বেআইনি। এ ছাড়া ২০০০ সালের এসইসি (স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার ও অনুমোদিত প্রতিনিধি) বিধিমালায়ও এসইসির নিবন্ধন সনদ ছাড়া কোনো সিকিউরিটি (শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইউনিট ইত্যাদি) ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে পাঁচ বছরের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অথচ এসইসির কোনো নিবন্ধন সনদ ছাড়াই গ্রীন বাংলা গ্রুপ চার বছর ধরে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বাণিজ্য চালিয়ে আসছে।
রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য : বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসইসির অনুমোদনের বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এরই মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের রাইট শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন নবী উল্যাহ নবী ও তাঁর সহযোগীরা। গত বৃহস্পতিবার পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার ১২৫.২০ টাকায় লেনদেন হয়েছে। গ্রীন বাংলা শেয়ারটি বিক্রি করছে ৫০ টাকায়।
২০০৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই কম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রীন বাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের কাছে পিপলস লিজিংয়ের ৮০ লাখ শেয়ার আছে। এসইসিতে রাইট শেয়ার পাস হলে সেখান থেকে আরো ৪০ লাখ শেয়ার পাওয়া যাবে। এ কারণেই তাঁরা ছয় মাসের লক-ইন হিসাব করে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার বিক্রি করছেন। অথচ এই কম্পানির রাইট শেয়ার ইস্যুর আবেদন এসইসির অনুমোদন পাবে কি না, সে বিষয়টি এখন নিশ্চিত নয়।
কোনো একটি কম্পানি শেয়ারবাজারে আসার প্রক্রিয়া শুরু করা মাত্রই ওই কম্পানির শেয়ার বাগিয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন নবী উল্যাহ নবী। কম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালক কিংবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে প্লেসমেন্ট শেয়ার প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন তিনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্লেসমেন্ট শেয়ার পাওয়া না গেলে উদ্যোক্তা শেয়ারের একাংশ কিনে নেন। এসইসির বিধি অনুযায়ী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্লেসমেন্ট ও উদ্যোক্তা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা (লক ইন) বলবৎ থাকে।
গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নবী উল্যাহ : ২০১০ সালের ১৫ জুলাই গ্রীন বাংলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নবী উল্যাহ নবী ওরফে শফিউল আলম নবী এবং তাঁর সহযোগী সাত্তারুজ্জামান শামীমকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব-৩ কার্যালয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নবী উল্যাহ বিভিন্ন কম্পানির প্লেসমেন্টের শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণার কথা স্বীকার করেন। বিষয়টি নিয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তের ভিত্তিতে কমিশনের পক্ষে উপপরিচালক (আইন) এ এস এম মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে নবী উল্যাহ নবী, সাত্তারুজ্জামান শামীম এবং গ্রীন বাংলা কমিউনিকেশনস লিমিটেডের নামে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলার আরজিতে ১০টি কম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আট কোটি টাকার প্লেসমেন্ট ব্যবসার হিসাব দেখিয়ে নবী উল্যাহ নবীর লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়, 'তার মোট ক্লায়েন্ট সংখ্যা ১০০ জন এবং ৩-৪ বছর যাবত তিনি অবৈধ শেয়ার প্লেসমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রীন বাংলার নিয়োজিত এজেন্টদের নামে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের (সিএসই) বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে অনেক বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব বিও অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টকে প্লেসমেন্ট শেয়ার থাকার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয় বিনিয়োগকারীদের সামনে। বিষয়টি আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের প্রত্যয়নপত্রও দেখানো হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই ভুয়া পোর্টফোলিও তৈরি করে তাতে ব্রোকারেজ হাউস সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর বসিয়ে দেওয়া বা একই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্ট দেখিয়ে একই শেয়ার একাধিক ক্রেতার কাছে বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। কখনোই আইপিও বা প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোনো শেয়ার ইস্যু করেনি_এমন কম্পানির শেয়ারও রয়েছে গ্রীন বাংলার পোর্টফোলিওতে।
নথিপত্রে দেখা যায়, গ্রীন বাংলা গ্রুপের নামে আইআইডিএফসি মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের একটি সিডিআই হিসাবের পোর্টফোলিওতে (হিসাব নম্বর ০৩১৩) ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ৩০ লাখ এবং বাংলালিংকের ৫০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। পোর্টফোলিওতে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রীন বাংলা গ্রুপ ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিটি শেয়ার ১০০ টাকা দরে মোট ৩০ কোটি টাকায় এবং বাংলালিংকের প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা দরে পাঁচ কোটি টাকায় কিনেছে। একই হিসাবে গ্রামীণফোনের ৫০ লাখ, গোল্ডেনসনের ১০ লাখ, ক্রাউন সিমেন্টের ১০ লাখ এবং আরএকে সিরামিকের ৭০ লাখ শেয়ার দেখানো হয়েছে। অথচ ইনসেপ্টা ফার্মা ও বাংলালিংক এখনো কোনো প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুই করেনি।
পোর্টফোলিওটির সত্যতা জানতে আইআইডিএফসিতে যোগাযোগ করা হলে গ্রীন বাংলা গ্রুপের প্রতারণার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই পোর্টফোলিও স্টেটমেন্টে প্রত্যয়নকারী হিসেবে আইআইডিএফসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) রাসেল আহমেদের নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে এই নামে কোনো ডিএমডি নেই এবং কোনোকালে ছিলও না। রাসেল শাহরিয়ার নামে একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের এসএমই ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাসেল শাহরিয়ারের কাছে গ্রীন বাংলার ওই পোর্টফোলিও বিবরণী দেখানো হলে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, প্রদর্শিত স্বাক্ষরটি তাঁর নয়। রাসেল আহমেদ নামের কোনো কর্মকর্তা আইআইডিএফসিতে নেই। প্রকৃতপক্ষে আইআইডিএফসিতে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব চালু নেই। তা ছাড়া 'সিডিআই' কোডের কোনো হিসাব তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নয়।
সূত্র- কালের কণ্ঠ, রবিবার, ৩১ জুলাই ২০১১