১ :
সুইডেনে আমাদের পরিচিত এক বাংলাদেশী ছেলে বিয়ে করবে। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশে বিয়ে দিতে। কিন্ত ছেলে বাংলাদেশে বড় হয়েছে বা এখনো বাংলাদেশে থাকে এমন মেয়ে বিয়ে করবে না । তখন বাবা,মা ছেলেকে বলেছে যে দেশেই বিয়ে কর মেয়েটা যেন অন্তত বাংলাদেশী হয় । তাদের দুর সম্পর্কের এক আত্বীয় অনেক বছর ধরে দুবাই থাকে, উনার মেয়ে আছে, মেয়ের জন্ম ওখানেই । বাবা, মা সেই মেয়েকে ছেলের বৌ হিসেবে পছন্দ করে । একদিন হঠাৎ আমরা জানলাম মা-বাবা ছেলেকে নিয়ে দুবাই গিয়েছে মেয়ে দেখাতে ।
ছেলে ইথিওপিয়ানদের মত কালো হলেও ফ্রেঞ্চকাট দারিতে বেশ ভালই লাগে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো সে সিভিল ইন্জিনিয়র, পড়াশুনা শেষ করে ভালো জবও শুরু করেছে । কয়েকদিন আগে শপিং মলে সেই ছেলের সাথে দেখা ।
-হাই হ্যালো বলার পর জিগেস করলাম। দুবাইতে যে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে তার কি খবর?'
-'মেয়েটা বেশ সুন্দরী আর ষ্মার্ট ছিল কিন্ত তার একটা মূর্দ্রাদোষ আছে সেটা আমার পছন্দ হয়নি' ।
-'কি এমন মূদ্রাদোষ' ?
-'মেয়ে কথায় কথায় “ইনশা আল্লাহ” বলে !
এ'কথা শুনার পর আর কোন কথাই বলতে পারিনি । আল্লাহ হাফেজ বলে চলে আসি।
২:
আমার এক পাকিস্থানি ক্লাসমেটের বড় বোন যখন কলেজ শেষ করে ইউনির্ভাসিটিতে ভর্তি হয় তখন তার বাবা,মা তাদের পরিচিত এক ফ্যামেলীর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা শুরু করে । ছেলে ও তার ফ্যামিলি থাকে ইংল্যান্ডে । গার্জিয়ানরা কথা বার্তা বলে দুই পরিবার সিন্ধান্ত নেয় এখন ছেলে মেয়ে কথা বার্তা বলে তারা পরস্পরকে জানুক, তারপর তারা ওকে বললেই, ছেলে পক্ষ সুইডেন আসবে আর তখন আকদও হবে। পর পর কয়েকবার ছেলে মেয়ে কথা বলেছে দুইজনেই মোটামুটি পজেটিভ।শেষবার যখন ছেলে ফোন দেন তখন মেয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল, মেয়েটা দরজার তালা খুলে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে ।
কিন্ত কেউ সালামের জবাব দিচ্ছে না দেখে ছেলেটা জানতে চায় ।
-'তুমি যে সালাম দিলে কেউ তো জবাব দিল না’?
-'কেউ তো নেই ঘরে জবাব দিবে কে!' উত্তরে মেয়েটা বলে ।
-'তাহলে তুমি সালাম দিলে কেন ?'
-'ঘরে মানুষ না থাকুক ঘরে ফেরেশতা আছে । তাই সালাম দিয়েছি' !
-'পাগল কোথাকার তুমি ফেরেস্তাদের সালাম দাও!' বলেই খটাশ করে ছেলে ফোন কেটে দেয়। ছেলে তার গার্জিয়ানদের জানায় এই মেয়ে পাগল সে তাকে বিয়ে করবে না !
এই দুটো ঘটনাতেই আমি এতটা অবাক হয়েছি, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না আসলে কতটা!!
‘ইনশা আল্লাহ’ বলাটা যে কারো মূদ্রাদোষ হতে পারে বা এ'রকম কেউ মনে করতে পারে সেটা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।
আলহামদুলিল্লাহ ! জাজাকাল্লাহ, ইনশাআল্লাহ ! মাশাআল্লাহ, সুবহানাল্লাহ সেই ছোট বয়সে কত কষ্ট করে আম্মু এগুলো শিখিয়েছে। প্রথম প্রথম এগুলো আম্মুর সাথে বলতাম । আস্তে আস্তে একাই বলা শুরু করি কিন্ত অনেক সময়ই বলতে ভুলে যেতাম বা উলটা পাল্টা বলতাম আম্মু ঠিক করে দিতেন আর এভাবেই বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আর এতটাই অভ্যাস হয়েছে অনেক সময় বা অনেকের সাথে কথা বলার সময় বলতে চাই না তবু বলে ফেলি।
এতদিন জানতাম এগুলো বল্লে যেমন আল্লাহর প্রশংসা করা হয় তেমনি ভাষার সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পায় আর এতদিনে জানলাম এগুলো নাকি মূদ্রাদোষ !!
আর সালাম দেয়াও শিখেছি সেই ছোট বেলা থেকে । ছোট বেলা দেশে যখন বাইরে থেকে বাসায় ফিরতাম তখন আম্মু দরজা খুলে আমার আগেই সালাম দিতো । এরপর শিখলাম যে বাহির থেকে ঘরে আসবে, সে সালাম দিবে আর যে দরজা খুলবে সে সালামের জবাব দিবে। দেশে এটা কোন সমস্য হত না । ঘরে কেউ না কেউ থাকত । বেল টেপার পর কেউ দরজা খুললে সালাম দিয়েই ঘরে ঢুকতাম । এছাড়া আমাদের বাসায় সালামের প্রচলন সব সময়ই ছিল । যেহেতু আমাদের ভাইবোনদের যার যার রুম আলাদা ছিল তাই দিনে যতবার আমরা ভাইবোন বা আব্বু আম্মুর মুখামুখি হতাম তখনই একে অপরকে সালাম দিতাম ।
এখনেও আমাদের বাসায় এটা আমরা করি, আমাদের বাসার পিচ্চিগুলো তো প্রতিযোগীতা করে কার আগে কে সালাম দিবে।কিন্ত প্রথম যখন ভাইয়া ভাবীর সাথে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না, ভাইয়া, ভাবীর সামনা সামনি দিনে যতবার হতাম ততবারই সালাম দিতাম।
কিন্ত এখানে পরিবারের সবাই বাইরে চলে যায় । সবার হাতেই ঘরের চাবি থাকে। সবাই যার যার সময় মত বাইরে যায়, যার যার সময় মত বাসায় ফিরে।আমাদের বাসাতেও তাই হয়। অনেক সময় আমি যখন বাসায় ফিরি কেউই তখন থাকে না । তাছারা হাতে চাবি থাকলে বেল টিপে অন্যকে কেন বিরক্ত করব। আমি নিজেই তালা খুলে ঘরে ঢুকি, সামনে কেউ থাকে না সালামও দেই না ।
তো ভাইয়া, ভাবি একদিন বলে দিল দরজা খুলে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকবে। আমরা কেউ থাকি বা না থাকি । ভাইয়া ভাবীর কথা শুনে শূন্য বাসাতে ঢুকেও সালাম দেই মাঝে মাঝে । আবার দেইও না অনেক সময়ই । এমন ভাবেই চলছিল ।
আমাদের বাসায় গল্প,উপন্যাসের বই বেশি না থাকলেও হাদীস, কোরআনের বই এর অভাব নেই। যখনই সময় সুযোগ পাই হাদীস কোরআন পড়ি। হাদিস পড়তে পড়তেই ঘরে প্রবেশ করার আদবের ব্যাপারে কয়েকটাই হাদীস পেলাম । কিন্ত যেই হাদীসটা শুনে সবচেয়ে বেশী আলোড়িত হয়েছি , আমি এই হাদীসের রেফারেন্স দিতে পারব না তবে হাদীসটা এখনো মনে আছে ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন” “আল্লাহতায়ালা তিন ব্যাক্তিকে গ্যারান্টি দিয়েছেন, দুনিয়াতে রিজিকের ও আখেরাততে জান্নাতের। সেই তিন ব্যাক্তি হল:
১: যে ব্যক্তি সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
২: যে ব্যক্তি মসজিদে যায় নামাজ পড়তে ও দ্বীনি এলেমের চর্চা করতে ।
৩: যে ব্যক্তি দ্বীনের কাজ করার উদ্দেশ্য ঘর থেকে বের হয়।
এই হাদীসটা আমি প্রায় পাঁচ বছর আগে একজন ইসলামী স্কালারের মুখে শুনেছি। সেদিন থেকেই পণ করেছিলাম ২/৩ নাম্বার পারি বা না পারি ১ নাম্বারটা আর কখনো মিস করবো না ।
সেদিন থেকেই সালাম দিয়ে ঘরে ঢোকার চর্চাটা আমার চলছে। এর জন্য কেউ যদি আমাকে পাগল বলে বলুক না, তাতে আমি কাউকে কেয়ার করি না।
ছবি আমার তোলা ।