আমি মনে করি, মানুষের চেয়ে হিংস্র, শ্বাপদসংকুল, স্বার্থপর, বিষধর প্রাণী আর দুটি নেই। আবার এই আমিই মানুষকে নির্বিশেষে ভালোবাসতে পারি, ভালোবাসি, তাদের দুঃখে আমার মন কাদেঁ, চোখে জল আসে। মানুষের প্রতি আমি দ্বৈত মনোভাব পোষণ করি।
এখন কথা হচ্ছে যে, মানুষকে আমি এত হিংস্র, বিধ্বংসী ভাবি কেন?
প্রথমত, মানুষ কোন কারণ ছাড়াই হিংস্র। অন্যান্য প্রাণী যাদের আমরা হিংস্র বলে আখ্যায়িত করি যেমন বাঘ, সে ও ক্ষুধা না লাগলে অথবা তার রাস্তা না মাড়ালে সে হিংস্র হয়ে ওঠে না। কিন্তু, আপনি একা রাতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, কোন কারণ ছাড়াই আপনি মানুষের হিংস্রতার শিকার হবেন, তাদের বর্বরতার সাক্ষী হবেন। এই মানুষই কোন কারণ ছাড়াই অন্য দেশে যুদ্ধ করছে, আরেকজনকে হত্যা করছে, হানাহানি মারামারি যেন এদের নিত্যকার রুটিন।
দ্বিতীয়ত, মানুষ বিষধর। অতি বিষধর সাপটিও আপনি গুতোঁ না দিলে আপনার দিকে ফোঁস করে উঠবে না। কিন্তু, আপনি কোন এক ভালো জায়গায় পৌছেঁছেন। মানুষ আপনার বিরুদ্ধে বিষ ঢালবে। বেশিরভাগ মানুষ একজনের কানে অন্যজনের বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে ব্যস্ত থাকে। এই বিষ মানুষের মধ্যকার সুন্দর সম্পর্কগুলোকে ধীরে ধীরে বিষাক্ত করে দেয়, স্লো পয়জনিং এর মতোন।
তৃতীয়ত, মানুষ বিধ্বংসী। মানুষের মতে, তারা আধুনিক, সভ্যতার উন্নয়নের ধারক, বাহক, তারা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে, দিচ্ছে, দিবে হোয়াটেভার। আমি বলব, মানুষ বিধ্বংসী, মানুষ স্বার্থপর। পৃথিবীর যেখানেই মানুষ তার কদম রেখেছে, সভ্যতার উন্নয়নের তকমা লাগিয়ে সে জায়গার অস্তিত্ব নষ্ট করে দিয়েছে। সে নিজের সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উজাড় করে দিয়েছে হাজার হাজার নাম না জানা গাছপালা, কত শত পশু-পাখি। মানুষের তাড়নায় এসব পশুপাখি পালিয়ে বেড়িয়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, অবশেষে হার মেনে নিয়েছে মানুষের কাছে, চারিদিকে মানুষের জয় জয়কার, তারা হারিয়ে গেছে এ মানুষের পৃথিবী থেকে। যদিও এ পৃথিবীতে তাদেরও সমান অধিকার ছিল।
হারিয়ে যাওয়া এসব পশুপাখিদের মধ্যে কতশত ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত। তার মধ্যে অন্যতম স্মৃতি হচ্ছে বাড়ির পাশের তালগাছটায় বাবুই পাখির বাসা। আজকাল যদিও তালগাছ খুব কম চোখে পড়ে, তবুও তালগাছ দেখলে মাথা উচুঁ করে তাকাই, তবে বাবুই পাখির বাসা তেমন করে চোখে পড়ে না। বাড়ির গাছে কাঠবিড়ালিটাও আর আসেনা। হলদে কুটুমটাও দুপুর বেলা আর কুটুম কুটুম বলে ডাকে না।
এতদস্বত্তেও এই মানুষকেই আমি আবার দল, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভালোবাসি, তাদের দুঃখে আমার মন কাদেঁ, চোখে জল আসে। কি অদ্ভুত তাইনা!!
কেন এই অদ্ভুত ভালোবাসা? কেন এই অদ্ভুত টান??
এই হিংস্র, শ্বাপদসংকুল মানুষগুলোই কেউ বিপদে পড়লে উদ্ধার করতে ঝাপিঁয়ে পড়ে। এমন অনেক সময় হয়েছে, আমি বিপদে পড়েছি, চিনি না জানি না কখনও দেখিও নি এমন কেউ সাহায্যের হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রামের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এমতাবস্থায়, মানুষ তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার নেগেটিভ রক্ত, আমার রক্ত নেন, মানুষ সিরিয়াল দিচ্ছে রক্তদান করার জন্য। তারা টাকার জন্য আসেনি, এসেছে শুধু মানুষগুলো বাচুঁক এই আশায়। ওষুধ ফ্রি করে দিচ্ছে অনেক ফার্মেসী, অটো সিএনজি ভাড়া নিচ্ছে না। যে যার জায়গা থেকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছে। কেউ খাবার নিয়ে আসছে, কেউ নিয়ে আসছে পানির বোতল, শিক্ষার্থীরা বাস নিয়ে চলে এসেছে রক্ত দেবার জন্যে। এদেরকে ভালো না বেসে থাকা যায়??
ভুপেন হাজারিকার গানটি মনে পড়ছে-
মানুষ মানুষের জন্যে
জীবন জীবনের জন্যে
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?
ছবি: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪১