কিছুদিন আগে ফেসবুকে স্ক্রলিং করতে গিয়ে দেখি, বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে জাবি ছাত্রের মৃত্যু। খবরটা শুনেই খুবই মর্মাহত হলাম। আহা, ছেলেটা কি শখ করে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিল, আর কেমন দুর্ঘটনা হল। কয়েক ঘন্টা পর শুনি যে, ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। তার হলের রুমে ছোট্ট একটি চিরকুট রাখা ছিল। সেখানে লেখা ছিল, " নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। এবার মুক্তি চাই" ( দৈনিক জনকন্ঠ, ২০২২)।
এই ছেলেটির মতো আরও শত শত ছেলেমেয়ে মুক্তি চাইছে, তারা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, অবসন্ন। কিন্তু প্রশ্ন হল, যখন যৌবনে উত্তাল-উদ্দাম-দুর্বার থাকার কথা, তারুণ্যের স্ফুলিঙ্গের বিস্ফোরণ হওয়ার কথা, ঠিক সেই বয়সেই তারা এমন বুড়িয়ে যাচ্ছে কেন? কেন তাদের জীবন হতাশার কুয়াশায় আচ্ছন্ন? তাদের মুক্তির পথ কি একমাত্র আত্নহত্যা?? যখন এমন খবর চোখের সামনে দেখি, এমন হাজারও প্রশ্ন মনের মধ্যে উকিঁ দেয়।
প্রথমেই জানি আত্নহত্যা কি? ল্যাটিন শব্দ সুই সেইডিয়ার থেকে সুইসাইড শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। এ্যারোন এর মতে, আত্মহত্যা হল আত্মহত্যাকারী কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ঘটনা, যা মৃত্যু ঘটায় ( ঢাকা টাইমস, ২০২২)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর ৭ লক্ষ ৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে মারা যায়, তন্মধ্যে ২০১৯ সালে ৭৭ শতাংশ আত্মহত্যাই ঘটেছে নিন্ম এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ( বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)। আরেকটু তথ্য দেই, ২০১৯ সালে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ ছিল আত্মহত্যা( বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২১)।
এ তো কেবল কলির সন্ধ্যে। আরো শুনুন। শুধুমাত্র করোনাকালীন সময়েই বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪,৪৩৬ । তরুণদের সংগঠন আচঁল ফাউন্ডেশনের দাবি, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪.৩৬ শতাংশ (প্রথম আলো, ২০২১)। ভাবা যায়??
ঢোক গিলে আবার পড়তে শুরু করুন। ২০২০ সালে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭৯ জন শিক্ষার্থী এবং ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন (প্রথম আলো, ২০২২)। কেন এত এত প্রতিভাবান ছেলেমেয়েগুলো অকালে ঝরে যাচ্ছে? স্বপ্নের কাঙখিত প্রতিষ্ঠানে পড়ার পরও কেন এইভাবে মুক্তির পথ চাইছে তারা?? কেউ কি খোঁজ রেখেছে তাদের??
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এক বছরে এতগুলো প্রাণ চলে যাওয়ার খবর ভীতিকর। তার মতোই ভীতিকর হলো বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছু ভাবছে না। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবছর আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ২০২২)।
সত্যিই বড় উদ্বিগ্নের বিষয়। কেন হচ্ছে এসব আত্মহত্যা? চলুন, একটু ভেবে দেখি।
আমরা একটা রোলার কোস্টার সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যখন থেকে আমাদের অক্ষরজ্ঞান হয়, বাবা মায়েরা একটা প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেন। "বাবা, তোমাকে প্রথম হইতে হবে" এটা আমাদের মননে-মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। শুরু হয় আমাদের ম্যারাথন রেস। যে সময় বাচ্চাদের আকাশের মেঘ কেমন হয় আর গাছের পাতা আর ফুল দেখে সময় কাটিয়ে দেয়ার কথা, ওইসময় তারা দৌড়াতে থাকে কোচিং সেন্টারে, শহরের নামীদামি স্কুলে এডমিশন পাইতেই হবে, তারা রেসে আছে, ফাস্ট তাদের হইতেই হবে। যখন তাদের মাটি দিয়ে হাড়িপাতিল বানিয়ে রোদে শুকাতে দেয়ার কথা, তখন তারা জ্যামিতি আকেঁ, সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করে, ভোকাবুলারি শিখে। যখন তাদের ময়ূরের পালক বইয়ের ভেতর রেখে একটু পর পর সেই পালক বাচ্চা দিয়েছে কিনা সেটা দেখার কথা, বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে লাফঝাঁপ করার কথা, তারা সেই সময়টুকু দেখে এনিমি, খেলে পাবজি। তাদের শৈশব কোথায় হারিয়ে গেল??
কৈশোর তো আমাদের সেই কবেই হারিয়ে গেছে। যবে থেকে ক্লাস ফাইভ, ক্লাস এইটের বোর্ড পরীক্ষা চালু হয়েছে। আর যাই করো, বৃত্তি তোমাকে পাইতেই হবে। ক্লাস, কোচিং, প্রাইভেট টিউটর- এগুলো থেকে অবসর পেলে তবে তো কৈশোরযাপন করব তাইনা??
এতসব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আরো দুইটা বোর্ড পরীক্ষা পাস করে, এডমিশন যুদ্ধ ডিঙিয়ে যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাই, জীবনীশক্তি তখন শেষের দিকে। প্রথম বর্ষ তো নতুন ক্যাম্পাস, নতুন বন্ধুবান্ধবের সাথে ঘুরতে ঘুরতেই চলে যায়।
হতাশা বাসা বাধঁতে শুরু করে দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে। এসময় বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যা কমে যায়, অনেকে পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়, অনেকে চাকরির প্রিপারেশন নেয়, আর অনেকে হতাশায় ডুব দেয়। এই হতাশার পেছনে অনেক কারণই থাকে। কারো সিজি ভালোনা, কারো বাসা থেকে বলছে, আর কতকাল বাপের পয়সায় খাবি? এবার একটা কিছু কর, কারো আবার বাবার চাকরি চলে গেছে, সংসার তার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু চাকরিটা হচ্ছে না। কারো আবার বেলা বোস অন্যের সাথে ঘর বাধঁছে, কেউ বা জীবনে করার মতো আর কিছু পাচ্ছে না, কেউ মানসিক অশান্তিতে ভুগছে, কেউ খুব কষ্টে আছে কিন্তু বলার কোন মানুষ নেই, কেউ অন্যের সিজি ভালো চাকরি ভালো এইসব নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগছে, কারো আবার খুব কাছের মানুষটা হুট করে পালটে গেছে আরো কত ইত্যাদি ইত্যাদি কারণ।
সবকিছুর সমাধান একটাই। আত্মহত্যা।।। আসলেও কি তাই??
অবশ্যই না। একটা কথা মনে রাখবেন, মরে গেলেন, তো হেরে গেলেন। কিন্তু যখন এসব আত্মহত্যার খেয়াল চাপে, তখন আর এসব নীতিবাক্য মাথায় থাকে না, অথবা মাথায় থাকলেও এগুলো খুব একটা অর্থবহ লাগে না।
অথবা আমরা নিজেদেরকে আর তখন ভালোবাসি না। তখন মরতে পারলেই বাচিঁ, শান্তি আর শান্তি। আসলে এইযে ছোটবেলা থেকে যে আমরা ফাস্ট হওয়ার ম্যারাথন রেসে দৌড়াই, আমরা নিজেদেরকে ভালোবাসতে ভুলে যাই, একদমই ভুলে যাই। ফাস্ট হব, ফাস্ট হব, ফাস্ট হওয়া লাগবে এর বাইরে আমরা কখনো দুদণ্ড সময় নিজেদের নিয়ে ভাবি না। এখন বলবেন, আরে কি ভাবব নিজেকে নিয়ে? এত সময় আছে নাকি?
এইযে সময় নেই, এজন্যই আজকের এই অবস্থা। আমরা গোলপোস্ট ছাড়া আর কিছু চোখে দেখিনা। আর যখন গোল হয়না তখন মরে যেতে ইচ্ছে হয়, সেটাকে আমরা আবার বাস্তবে রুপও দেই।
এইযে পড়াশোনা, ফাস্ট হওয়া, ভালো চাকরি, ভালো সিজি, ভালো বাড়ি গাড়ি এইসবের বাহিরেও একটা জীবন আছে। সকালের সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত অসম্ভব সুন্দর, শরতের পরিস্কার আকাশ যেমন সুন্দর, বৈশাখের কালো মেঘের আকাশও সুন্দর, প্রজাপতির রঙিন পাখা থেকে শুরু করে গাঙের খলিশা মাছটাও সুন্দর। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা সমসময় উপরের দিকে চেয়ে থাকি, নিচের দিকে তাকানোর অবসরই আমাদের নেই, জীবন আমাদের নেগেটিভ এ ভরপুর। রেজাল্ট ভালো হয়নি? তো কি হয়েছে, পৃথিবীর কত বিখ্যাত মানুষ স্কুল পাস করতে পারেননি। সিজি খারাপ? পৃথিবীর অনেক মানুষ লো সিজি নিয়ে বড় বড় কাজ করছে। চাকরি হচ্ছে না?? এখন হচ্ছে না তো কি হইছে?? একসময় হবে। প্রেম টিকল না?? তোমার ভালোবাসা তো সত্য ছিল। তা নিয়েই সুখে থাকো। টাকার অভাবে আছো? তোমার চেয়ে খারাপ অবস্থায় কত মানুষ আছে অনাহারে, অভুক্ত অবস্থায়। তার চেয়ে তুমি ঢের ভালো আছো।
জীবন একটাই, এবং জীবন অনেক অনেক সুন্দর। শুধু নিজেকে একটু ভালোবাসো, দিনের একটু সময় শুধুমাত্র নিজের জন্যই রাখো। নিজে যা ভালোবাসো, যা ভালো লাগে তাই ই করো। কেউ নেই কথা বলার? জোর করেই একজনকে বলো, আমি অনেক দুঃখে আছি। একটু শুনবা?? না শুনতে চাইলেও জোর করে শুনাব।
রেফারেন্স:
১. Click This Link
২. Click This Link
৩. Click This Link
৪. Click This Link
৫. Click This Link
ছবি: গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২২ রাত ১:০৭